ভারত থেকে কমলিকা দত্ত’র তুলনা মূলক বিশ্লেষণ ধর্মী লেখা “গ্রামীণ মিউরাল ও আধুনিক টেকনোলজি”

356
কমলিকা দত্ত’র তুলনা মূলক বিশ্লেষণ ধর্মী লেখা “গ্রামীণ মিউরাল ও আধুনিক টেকনোলজি”

গ্রামীণ মিউরাল ও আধুনিক টেকনোলজি

কমলিকা দত্ত

সকলেই যেন এখানে শিল্পী।  নাম নেই, খ্যাতি নেই, নেই চারুশিল্পের পাঠ, না পান শিল্পী ভাতা।অথচ নিজেদের অনন্য সৃষ্টি দিয়ে গড়ে তুলেছেন মুক্ত প্রদর্শনশালা। ইতি উতি ছড়িয়ে রয়েছে অকৃত্রিম,হৃদয়গ্রাহী শৈল্পিক  বর্ণমালা।

প্রান্তিক   পুরুলিয়ার এই মানুষগুলি যেন জন্ম শিল্পী। কাউকে বলতে হয় না কিভাবে সাজাতে হবে,কিভাবে রাঙাতে হবে।

লাল মাটির রাস্তা ধরে হাঁটতে হাঁটতে চোখ পড়ে যায় নানা রঙের ছোঁয়ায়, পটচিত্রের আদলে তৈরি দেওয়ালের গায়ে অঙকিত  গ্রামীণ লোককথা। হাতিমারা, লক্ষণপুর, শুকনিবাসা বান্দোয়ান বা বাঘমুন্ডির পথে এক চিলতে ঘরের  মাটির দেওয়ালগুলি এইভাবেই হয়ে উঠেছে আকর্ষণীয়।

 কি সহজ সরল, অনাড়ম্বর অথচ কি নিপুন, নিখুঁত মনোলোভা! এত প্রাণবন্ত  শৈল্পিক নিদর্শন প্রশিক্ষিত শিল্পীদেরও লজ্জায় ফেলে দেয়। অথচ এঁরা শিল্পী হিসেবে কতটুকু কদর পান? অনগ্রসর এলাকায় জন্ম নেওয়া এই খেটে খাওয়া মানুষজনেরা তাদের প্রতিভার প্রাপ্য মর্যাদা কদাচিৎ পান বা হয়ত পানই না।

যদিও দেওয়ালচিত্র অঙকনের এই ধারা মূলত পুরুলিয়াকে ঘিরেই, তবে বীরভূম, বাঁকুড়া,মেদিনীপুর  ও পশ্চিম বর্ধমানেও এর প্রভাব সুস্পষ্টরূপে   পরিলক্ষিত হয়।

ল্যাটিন শব্দ “মুরুস” যার অর্থ দেওয়াল। মুরুস থেকে আসা ম্যুরাল বা মিউরাল হল এমন একটি চিত্রকলা যা দেওয়াল, ছাদ বা স্থায়ী পৃষ্ঠতলে আঁকা হয়। গুহার দেওয়ালে গুহাবাসী মানুষের খোদাই করা বিভিন্ন চিত্র যা থেকে সমসাময়িক জীবনযাত্রার ধারণা পাওয়া যায়,তারই পূর্বসূরিরূপে গণ্য করা যায় বর্তমান সময়ের ম্যুরাল চিত্রকলার।হাজার বছর পেছনে গেলে, আলতামিরার গুহাচিত্র আজও চুম্বকের মত আমাদের আকর্ষণ করে।

বাংলার গ্রামীণ স্থাপত্যের এক বিশাল অংশ জুড়ে রয়েছে এই দেওয়ালচিত্র বা মিউরাল। যাঁরা পুরুলিয়া বা বীরভুম গেছেন তাঁরা অবশ্যই এই গ্রামীণ মিউরাল গুলো দেখে মুগ্ধ হবেন।

এই দেওয়ালচিত্র আজকের নয়। সেই প্রস্তরযুগ থেকেই আদিম মানুষজন গুহায় ছবি আঁকতেন।

মিউরাল শিল্প রীতি যেমন অনেক পুরোনো, তেমনই এর সহজ, সরল, কাল্পনিক বিষয়বস্তুর মধ্যে দিয়েই ফুটে ওঠে হাজার বছরের পুরোনো গ্রামীণ জীবনের প্রতিচ্ছবি।

শরৎকালে নতুন শস্যকে স্বাগত জানানোর জন্য সোহরাই বা বাদনা পরবের আয়োজন করা হয়। আদিম গুহাচিত্রের সাথে এই সোহরাই আর্টের অনেক সাদৃশ্য আছে। উৎসবের বহু আগে থেকে চলে ঘর রাঙিয়ে তোলার প্রস্তুতি।

দেওয়াল জুড়ে থাকে তাদের জীবনকথা– সুখ দুঃখ, হাসি কান্না।

 পরব চলাকালীন বাড়ির মেয়েরা বর্ষার জলে ধৌত মাটির দেওয়ালের গায়ে নতুন মাটি লেপন করে। উঠোনে আল্পনা দেয়। তারপর বাঁশের ছোট কঞ্চি দিয়ে দেওয়ালে বিভিন্ন বাস রিলিফ বানিয়ে তার ওপর ভেষজ রঙ ব্যবহার করে।পুরুলিয়া বা বীরভূমের এইসব দেওয়াল চিত্রের  বৈশিষ্ট্য হলো এর ক্ষণস্থায়ীত্ব। অংকনের পর বৃষ্টি না আসা পর্যন্ত এগুলো থাকে।

বিভিন্ন ধরনের লতাপাতা,ফুল,পাখি,গাছ, মানুষের চিত্র অঙকন করে দেওয়ালগুলিকে সুশোভন করে তোলা হয়। ফুলের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয় পদ্মের ছবি।পদ্মকে মানভূমী দেওয়াল চিত্রের প্রতীক বলা হয়।এরপর আসে মোরগঝুঁটি ফুলের নাম।এছাড়া লাল,নীল, সাদা,গেরুয়া ইত্যাদি বিচিত্র বর্ণের সমাবেশে আঁকা হয় নানারকম পাখি,খেজুর গাছ,ইস্কাবন , হরতনের নক্সা। সাঁওতাল,হো,কোল,শবর,বীরহড় প্রভৃতি জনজাতির মধ্যে এই অঙকনের প্রচলন আছে। দেওয়ালচিত্রের জন্য বিষয়বস্তু বা উপকরণ তারা তাদের নিজস্ব পরিবেশ ও জীবনযাত্রা থেকেই খুঁজে নেন। সহজলভ্য মাটি,ধানের শীষ,  কঞ্চি, আলকাতরা,চিটে গুড় আর সহজাত প্রবৃত্তি–মিলিয়ে মিশিয়ে অপূর্ব চিত্রায়ণ।

এগুলি একদিকে যেমন বাড়ির দেওয়ালকে সুশোভিত করে, তেমনই বর্ষার সময় মাটির দেয়ালকে রক্ষাও করে।

 সহজ সরল প্রাকৃতিক বিষয়বস্তুকে  উপজীব্য করে প্রাঞ্জলভাবে ফুটিয়ে তোলা হয় দেওয়ালচিত্রে। আলতা বা খড়  পোড়ানো কালি, গিরিমাটি,পাতার সবুজ রং,পলাশ, অপরাজিতা ফুলের পাপড়ির নির্যাস নিয়ে, নানা রঙের সেরামিক যুক্ত করে ঘর রাঙান গ্রামের মানুষেরা। সৌন্দর্য ও ভাবনার মিশেলে সৃজনশীলতার ছোঁয়ায় সেজে ওঠে গোটা গ্রাম। আদিবাসী সংস্কৃতির অন্যতম এই মিউরাল বা দেওয়ালচিত্র সত্যিই চোখ টানে।

 আম বাঙালির সাথে এই আর্টফর্মের পরিচয় নতুন হলেও সভ্যতা কিন্তু যুগ যুগ ধরে বয়ে চলেছে এর ইতিহাস। এই ধরনের আপাত সাধারণ ছবিগুলির মধ্যে লুকিয়ে রয়েছে মানুষের সাথে প্রকৃতির রসায়ন। প্রকৃতির সাথে একাত্মতা কমে গেলে এই শিল্পের শরীরেও পড়বে তরল আধুনিকতার প্রভাব।

এখন টেকনোলজির যুগ। জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে, শিল্প সংস্কৃতিতে প্রযুক্তির  অবশ্যম্ভাবী ছোঁয়া।ফলতঃ দেওয়ালচিত্রের সেই আটপৌরে সাবলীল প্রবাহমানতার ধারায়  ঢুকে পড়ছে উপকরণগত ও বিষয়গত পরিবর্তন। গ্রামীণ রীতিনীতি, বিষয় ও উপকরণগুলো হারিয়ে ক্রমশ গ্রামীণ মিউরালের ঐতিহ্য হয়ে পড়ছে শিকড়হীন। কিছু কিছু মিউরাল শিল্পীর হাত থেকে এখনও সোহরাই আর্টের আদিম ভাবটি হারিয়ে যায়নি। তবে বদলাতে বদলাতে হয়ত মূল শিল্পটাই একদিন হারিয়ে যাবে।  ভেষজ রঙের পরিবর্তে  ব্যবহৃত হচ্ছে রাসায়নিক রঙ। আঁকার নক্সা নেওয়া হচ্ছে ইন্টারনেট থেকে। যে ছবি দেখলেই গ্রামীণ সারল্য ভেসে উঠত, সেই ছবির চেহারায় কৃত্রিম আধুনিকতার ছোঁয়া। ছবির চারিদিকে বর্ডারও কিন্তু গ্রামীণ শিল্পের ঐতিহ্য নয়। কোথাও গিয়ে যেন এইসব বৈশিষ্ট্য  গ্রামীণ সারল্যকে সীমায়িত করে দেয়।

আজকাল অনেকে ইঁট সিমেন্টের তৈরি বাড়ির দেওয়ালেও মিউরাল শিল্পীদের দিয়ে সোহাই আর্টের কাজ করান। যদিও তা মূল শিল্পের থেকে অনেকটাই আলাদা।  হয়ত একদিন  দেওয়ালচিত্রের গায়ে লতাপাতা, আধফোটা পদ্ম, আংশিক উদিত সূর্যের পরিবর্তে আঁকা হবে বা  আঁকানো হবে অত্যাধুনিক জীবনযাত্রার ইমেজারি,তবে তার গা থেকে বোধহয়  আর  লাল মাটির সহজিয়া গন্ধ উঠবে না।

Content Protection by DMCA.com

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here