কলামিষ্ট ও প্রবন্ধকার হাসান আহমেদ চিশতী এর সৃষ্টিশীল লেখনির আলোয় আলোকিত করেছেন এবারের লিখা রম্যকথা“বিবেকের বাতিঘরে লোডশেডিং ”

808

রম্যকথা

 বিবেকের বাতিঘরে লোডশেডিং

                                –হাসান আহমেদ চিশতী–

শহরে অসংখ্য মৃত মানুষের ভিড়। অথচ তারা জানে না তাদের মৃত্যুর খবর। আত্মার অসম্ভব বিগাড়ে আহাজারী করছে। জুয়া খেলার আসর জমেছে গোশালায়, মাদকের বাজার বসেছে প্রান্ত খোলায়। এ সকল মৃতদের আত্মা চরম অশান্ত। নগর বন্দরে প্রচন্ড ঘুষ খোর বেঘোর বেলাজে বেহুষ কর্তা কাপালিক। এরা স্বর্গ কিংবা নরক এর পথ জানে না। শুধু ভাগাড়ের পথ তাদের পরিচিত। একসময় এদের জীবন ছিল। জন্মকালে অন্ধকার ঘরে ছিল, রোদ দেখেনি গল্প শুনেছে মাত্র। একদিন রোদের আশায় কেউ কেউ শিক্ষক, সংবাদপত্রের কর্মী, প্রশাসনের কর্মকর্তা, প্রকৌশলী, চিকিৎসক, আইনজীবি, ব্যবসায়ী এবং রাজনীতিক ও মুক্তিযোদ্ধা হয়েছিল। কিন্তু পোড়া কপালের জন্ম পাপ তাদের আশাহত করেছে। ঘর সংসারের বেলাজ পোয়াতী বৌ এর আঁচলের আড়ালে এদের মৃত্যু ঘটেছে। বিবেকের বাতিঘরে লোডশেডিং হয়েছে। গোপন মদের গ্লাসে ঢোক গিলেছে, পতিতার দুয়ারে হাত পেতেছে, মাদক মহাজনের আমন্ত্রণ নিয়েছে। প্রচন্ড অভিশাপে আলোড়িত হচ্ছে সমাজকর্তাদের ভাগ্য বলয়ে। রাষ্ট্রযন্ত্রের ধমনীতে টার্মিনাল ক্যান্সার- বিশেষজ্ঞ কেমোথ্যারাপিষ্ট বলছে, ভাল হয়ে যাবে তবে বোর্ড বসাতে হবে, পদ্ধতিগত মতামত ঠিক করার বিষয়ে আলোচনা সাপেক্ষে সঠিক সিদ্ধান্তে আসতে হবে। এটা সংসদে হবে নাকি রাজপথে। তার দায় মেটাতে দেবীর উদ্দেশ্যে বলি চড়াতে হবে আন্দোলনের হুঙ্কারে। শিক্ষা সংক্রান্ত তন্ত্র-মন্ত্র, লুট প্রশাসন যন্ত্র, বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ ও স্কুলে এই তালিম তেজারতির তেজস্ক্রীয়তা ঢেলে ঢাক-ঢোল পেটানোর প্রক্রিয়া কতটা গতিশীল। পুষ্টিগুণের দুগ্ধ নহর বাঘাবাড়ীতে। বহু ডেইরী ফার্ম উপচে ওঠা আবিষ্কারে ভুতের বাড়ীর মাতমে নাচছে-মাতছে অট্টহাসিতে। বিষক্রিয়ায় মরবে মানুষ কষ্ট পেয়ে অনেক বেশী অযাচিতে। পদ্মা সেতু এখন ঝুলছে নাকি দুলছে নির্মাণাধীন আশঙ্কাতে।

মাথা ভরা রাজনীতিতে গোয়াল ভরা বুদ্ধিজীবি, শ্মশ্বান যাত্রা করবে বলে স্নান করছে সাত সকালে। গুরুত্ব বেশী ব্যস্ততায় কাপালিক মহারাজ, শ্মশ্বানেই তার বড় বেশী কাজ। মুর্খের জন্ম অভিশাপে, তাই প্রকৃতি পড়েছে গ্যাঁড়াকলে। বালু উত্তোলন আর পাহাড় কাটায় ভরছেনা পেট দালাল মহলে। ঝুলে পড়া মাতৃস্তন চুষে নিবৃত হয়নি যে ক্ষুধা, সে ক্ষুধা এখনও অবারিত। মূল্যবোধহীন নির্লীপ্ত ললাটে নষ্ট জন্মের কালিমা। রাজপথ নিয়ন্ত্রণে রেখেছে চোর আর মাদকের দালাল। নিয়ন আলোতে আমলা আড়ি পাতে, সকাল সন্ধ্যা ও রাতে। টোকা যেন কেউ না দেয় তার হাঁড়িতে। এদের রক্তবীজ বিষবৃক্ষের মাটিতে। এরা সন্দেহের সন্তান, শিক্ষার শপথ মানে নাই। এখন শহরে অবৈধ নারী, মাদক তুরুপে জুয়া খেলার প্রচন্ড প্লাবন, অভিশপ্ত মৃত আত্মাদের পাহারা। নিশি কাঁপা ভোর। দিনের সূর্য উঠছে দেরীতে। জীবিত মানুষের সন্তানেরা উন্নত ভবিষতের পরীক্ষায় অংশ নিচ্ছে চরম আশঙ্কায়। অনবরত ঐ সকল মৃতদের প্রতি অভিসম্পাত করছে প্রার্থনায় স্বজন সন্তানের পরিজন। চন্ডালের হাড় নাচনের মত মৃতদের অদ্ভুত হাঁসি পথে-প্রান্তরে। কুকুরের সংখ্যা কমে গেছে, শকুনেরা নিয়েছে বিদায়। মৃত আত্মার মানুষেরা গোংড়াচ্ছে আর জীবিত মানুষের রক্ত প্রতারণায় চুষে নিচ্ছে।

মশার রাজ্যে বিপুল উত্তেজনা তাদের রাজা মানুষের ঘর থেকে কাপালিকের কাছে ছুটে এসেছে রক্ত শোষনের জোয়ারে অভিভুত হয়েছে মশক রাজা। নির্বিঘেœ তারাও কিছুটা রক্ত খেয়ে নিচ্ছে। বিষযুক্ত কয়েলের ধোঁয়ামুক্ত পরিবেশ এখানে। কিন্তু পাষন্ড মৃত অত্মার তৈলযুক্ত শরীর তো আর বিষমুক্ত নয়। মশার মাতম তাই গুনটানা গানের সূরে। মৃত আত্মার মানুষেরাও বাড়ী ফেরে গভীর রাতে শোষণের রক্ত হাতে। ভাগের অংকের টাকা মেলাতে বিনিদ্র রাত কাটে তার ভাগাড়ের স্বপ্ন বিলাসে। তাদের জীবিত সন্তানেরা এক সময় অন্ন আহারে প্রতারিত মানুষের রক্তের গন্ধ-স্বাদ পেয়ে না জেনে অসুস্থ্য হয়েছে। এখন তাদেরও সয়ে গেছে সব। তারাও এক সময় মৃত আত্মার মানুষ হবে। সমাজ সংসারে মৃতদের ভীড় আরও বেড়ে যাবে। তাদের স্ত্রীদের কপালে গাস্সির অমাবশ্যার বলির পাঠার রক্ত তিলক। যেদিন জেনে যাবে পুজনীয় দেবী মাতৃকুল তার সন্তানেরা মৃত আত্মার কলংকিত কংকাল। সেদিন শক্তি রূপেন সংস্থিতায় দুর্গতি নাশিনি নিধন যজ্ঞে নেমে পড়বে নিশ্চিৎ এবং মাতৃগর্ভে জন্মে যাবেই কীর্তিমান মহামতি বলবান। যে কোন অনৈতিকতাই ক্ষণস্থায়ী এবং আনত অন্যায় অনিশ্চয়তা ও অমঙ্গলের প্রতিক। যে বা যারা এসকল কর্মতৎপরতার ধারক বাহক, কালের ইতিহাস তাদেরকে ছুঁড়ে ফেলেছে ডাস্টবিনের নিমজ্জিত আঁধারে। সুতরাং জীবনকে জীবিত রাখতে আত্মার প্রতি শ্রদ্ধাশীল ও যতনবান হওয়া বাঞ্ছনীয়। প্রকৃত মনুষত্ব সতিত্বের চেয়ে বড়। তাই মৃত আত্মার মানুষেরা পতিতার চেয়ে নিচ। রবিন্দ্রনাথ বলছেন-
নাগিনীরা চারিদিকে ফেলিতেছে, বিষাক্ত নিঃশ্বাস শান্তির ললিত বাণী শোনাইবে ব্যর্থ পরিহাস।
এ সকল মৃত আত্মাদের পূর্বপুরুষের জীবদ্দশায় ঝঁঝালো মাজন ছিল নীতিতে। কালের ধারায় সে মাজন চটে চটে উঠে গেছে। ফলে জমিদারের ঘরে কাঙালের জন্ম, রাজার ঘরে ফকিরের, উজিরের ঘরে টাউটের আর পতিতার সাথে পত্রকারের। তাই হয়তো লালন ফকির বলছে- ঝি এর পেটে মা এর জন্ম/আমরা ভেবে করবো কি?
তবু মা এর মন্ত্র মর্তের মাটিতে বৃথা যায় না। ঈশ্বরচন্দ্রের দিক্ষা তো তাই ছিল। চন্দ্রভানের উপাক্ষানে নাই বা গেলাম কিন্তু সে সময়কাল উত্তির্ণ করে তারা স্বর্গে চলে গেছেন। অথচ আজকের এরা তো স্বর্গ বা নরক কোথাও ঢুকতে না পেরে পৃথিবীটাতেই নিজের জঞ্জালের উত্তাপে তর্পাচ্ছে। সেজে গুজে বারবনিতা সেজে পতিতার ন্যায় অকাজের ব্যাকরণে বুলি দিচ্ছে সুস্থ চিন্তার বিনোদনে উৎসাহী তারা। মৃত আত্মার বেলেল্লাপনার তৎপরতা দেখে ধিক্কারের থুতু ফেলছে জীবিত মানুষের দল। ছিটকে যেন নিজের গাত্রে না লাগে তাই এতো নিঃশব্দতা। তাই তো চন্ডিদাস বলেছে- সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই। সত্যের মরণ নাই আর মিথ্যার ধরণ নাই। রাষ্ট্র খাঁচার সকল দুযারে মিথ্যার বেশাতি চরমহারে। শিক্ষকতা মহান পেশা, পত্রাকারও মহান পেশা সেই সাথে প্রতারণার নামে মহান ক্রিয়াকলাপ এর কার্যকরণ দিয়ে আমাদের শহরে মৃত আত্মাদের ভীষণ উৎসব। তাদের পরিবার আত্মহারা। সুশীল সমাজ আর শিক্ষা সমিতির সভ্যজন অভাজন আর ধর্মশালার মুসল্লিগণ সবার কন্ঠনালীতে সাইলেন্সার লেগেছে পোঁদ বাঁচাতে। সে কারণেই বাংলা গানের গীতিকার লিখেছে- ছয় চোরাতে চুরি করলো গুরু ধরলো আমারে। এটা হলো ক্ষণিকের আলাপন। আসলে পৃথিবীর প্রতিটি ধ্বংসযজ্ঞই নিজস্ব কৃতকর্মের দ্বারা সংঘটিত।
পরিশেষে এ সকল মৃত আত্মাদের নিধন বা শব যাত্রার শেষকৃত্ত অনুষ্ঠানের ক্রিয়াকরম সম্পন্ন নিশ্চিত জেনেই কবিগুরু বলছেন- তোমারে বধিবে যে গোকুলে বাড়িছে সে।।

(লেখক: প্রবন্ধকার, কলামিষ্ট, গল্পকার, কবি, সাহিত্যিক)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here