সাঁঝ হেলে পড়েছে
সুফিয়া শিউলি
তিস্তায় চর জেগেছে, গতকাল রাতেও খুব তুমুল মারামারি কাটাকাটি হয়েছে এখানে জায়গা দখল নিয়ে। চর জাগলেই এমন হয়। পরে প্রশাসনের হস্তক্ষেপে এখন একটু ঠান্ডা বাতাস বইছে।
ফড়িঙ আর অপরাজিতা তিস্তাপাঁড়ে বসে আছে, তাদের বাড়ির কাছেই। খালি পায়ে হাঁটতে হাঁটতে শেষ বিকেলের দিকে প্রায় এখানে চলে আসে অপরাজিতা। ফড়িঙ তাকে কখোনোও একা ছাড়ে না, সেও সঙ্গী হয়……।।
পশ্চিমে হেলে পড়া সূর্যটার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে অপরাজিতা বলল, ‘ফড়িঙ দাদু তোর তো বেশ কিছু জায়গা-জমি গিলে খেয়েছে এই তিস্তা, তাই না? তোর কাছে প্রায় সে গল্প শুনি আমি, আগে তোদের অবস্থা কত্ত ভালো ছিলো…; আচ্ছা, এখানে এলে এই তিস্তার উপরে রাগ হয় না তোর?’
‘রাগ করি আর কি হইবে বুবু? কত্ত কি চলি যায় জীবন থাকি…। খালি কি ভিটেমাটি বুবু; মোর আপনজনও গিলে খাইছে এই নদী!’
‘হুম শুনেছি সে কথা। সেই থেকেই তো তুই আমাদের বাড়িতে। কোথাও আর কোনদিন যাওয়ার কথা ভাবিসও না কিন্তু ফড়িঙ দাদু।
ওহহ দাদু, দেখ দেখ হেলেপড়া সুর্যটাকে ডিমের কুসুমের মতো দেখাচ্ছে, আর তাঁর চারপাশটায় কে যেন সিদুর ও কাঁচা হলুদ একসাথে মিশিয়ে লেপে দিয়েছে………কি দাদু ঠিক না বল? কি ফড়িঙ দাদু, কি দেখিস অমন করে?’
‘কি আর দেখোং বুবু…। তুই যে কি কি কইস, মুই ঠিক মতন বোঝোঙ্গে না।’ কথা বলতে বলতে ফড়িঙ বিড়িতে একটা লম্বা সুখটান দেয়……।
‘কিছু তো দেখিসই, মাঝে মাঝে তোর উদাস চোখ দেখে আমার মনে হয়, তুই যেন ভিতরে ভিতরে কত কি ভেবে যাচ্ছিস, তুই কি পালাবার মতলব করছিস?’
‘না বুবু, এ জীবনে আর পালা হইল কোনটে, তয় খুব ইচ্ছা আছিল মোর, মুই সউক কিছু ছাড়ি একবার না একবার পালাইম, কন্টে যাইম জানোং না! কিন্তু পালাইম। তা তুই আর হবার দিলু না, অতগুলা নেকাপড়া করি এই গণ্ডগ্রামতই আসি স্কুলের মাষ্টার হয়া থাকলু! দেওয়ানি ভাইয়া মরি যায়া মোক বিপদোত ফেলে থুইয়া গেইছে…।’
‘ওহহ আমি এখন তোর বিপদ হয়ে গেছি; যা তোর মনঃ যেখানে চায় তুই যা, আমি আমার মাকে নিয়ে একাই থাকবো।’
‘ঐ গোসসা হইল তো; সেই ন্যাংটা কাল থাকি মুই তোমার বাড়িত আছুং। নিজের বলতে তোমরা ছাড়া কায় আর মোর আছে? না বুবু, এ জীবনে আর যাওয়ার জায়গা মোর কোনটে? দেওয়ানি ভাইয়াও চলি গেলো মোক ফেলে থুইয়া…!’
অপরাজিতা একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। ‘দাদু অকালেই আমাদের ছেড়ে চলে গেলো। নারে ফড়িঙ দাদু? তুই না থাকলে যে আমার কি হতো;’
‘অত ভাবিস না বুবু, যার কেউ নাই, তার উপরওয়ালা আছে; আর মোর মরণ ছাড়া তোক ছাড়ি মুই কনটেও না যাইম।’
‘সে আমি জানি ফড়িঙ দাদু।’
‘ঠিক আছে বাদ দে ঝগড়া, এখন চুপ করে চারপাশটা দেখ, প্রকৃতির বদল হচ্ছে, সন্ধ্যা দোর দিবে দিবে ভাবছে, রাত অপেক্ষা করছে দরোজার ওপাশে। নদীটার দিকে তাকিয়ে কত কি মনে আসছে। এক সময় ভরা যৌবন ছিলো তাঁর……
ভরা নদীর রূপ-সুধা অন্যরকম, যৌবনা শরীরে কল কল ছল ছল করে ক্ষমতা বিলাসীর মতো বয়ে চলতে থাকে। তার উছলানো হাসি আশপাশের কত পাঁড় ভেঙে যে নতুন পথের ঠিকানায় চলে যায় সেদিকে তার কোন খেয়ালই থাকে না… যখন রসোজল শুকিয়ে কঙ্কালসার বার্ধক্য বিড়ি ফুঁকে কাশতে থাকে, তখন দেখে খুব মায়া হয়। আহাঃ যৌবনা শরীরখানাকে ওভাবে কল কল করে বহুগামি না করে এক পথেই চললে পারতি! কেনই যে শুধু না বুঝে ক্ষণিকের ক্ষমতা বিলাসে নিজেকে টুকরো টুকরো করে নিজেই নিঃশেষ হয়ে গেলি…! ঐ তো শাখা-প্রশাখা সবেই গিলে খায় এক সমুদ্র, তুই সেথায় টুকরো টুকরো হয়ে ধরা না দিয়ে এক শক্তিতেই না…হয় মিশেযেতি…।’
ফড়িঙ অপরাজিতার কথা কিছু বোঝে, কিছু বোঝে না…… । লম্বা একটা শ্বাস ফেলে বলল, ‘সাঁইজ হয়া আইল, বুবু এলা বাড়ি হাঁট…।’
অপরাজিতা ফড়িঙের কথায় সাড়া না দিয়ে নদীটার দিকেই তাকিয়ে থাকলো।
খুব মায়া হলো ফড়িঙের; ‘আহা এত মায়াবী চাঁদ মুখখানা বুবুটার… এই বয়েসে কত কষ্ট……! বিয়াওটা ভাঙ্গি গেলো, বাপ থাকিয়ো নাই; দাদুও ছাড়ি চলি গেলো ওপাড়ে। শুধু মাওটাক নিয়া একলায় একলায় বাঁচি আছে বুবুটা মোর………।’