ভারত থেকে কলমযোদ্ধা-অগ্নিমিতা দাসের ভিন্নধর্মী গল্প“দেবী”

305
অগ্নিমিতা দাসের ভিন্নধর্মী গল্প“দেবী”

দেবী___
অগ্নিমিতা দাস

আকাশ জুড়ে আজ কালো মেঘের ঘনঘটা। কালো ঘন ভেলভেটে মোড়া মেঘের ভেতর থেকে মাঝে মাঝে জরির চাবুক চকিতে দেখা দিয়ে মিলিয়ে যাচ্ছে। লক্ষ্মীকে ঘিরে উঠোনে সব মেয়ে বৌরা দাঁড়িয়ে রয়েছে। ভিজে হাওয়ায় নিম ফুলের গন্ধ ভাসছে।আজ সকাল থেকেই পাড়ার ছেলেরা মাথার ওপরে ত্রিপল টাঙ্গিয়ে দিয়েছে। আজ দশহারা , তাই বৃষ্টি হবেই বলেই সবাই ধরে নিয়েছিল। গ্রামের সবাই বিশ্বাস করে বৃষ্টি না হলে সাপের বিষ বাড়বে। তাই বৃষ্টির দেখা মিলতেই সবার মনে শান্তি। লক্ষ্মী এলোচুলে, আদুল গায়ে লাল পাড় সাদা শাড়ি পরে আসনে বসেছে। মেয়েবৌরা থাপড়া থাপড়া করে ওর কপালে আর সিঁথিতে সিঁদুর লাগিয়েছে। আর নিজেরা ও ওখান থেকে নিয়ে কপালে লাগিয়েছে। মা মনসার ভর বলে কথা। দলে দলে লোক আসছে হরিহর দলুইয়ের বাড়ির উঠোনে। হরিহর দাওয়ায় বসে তামাক টানছে। পাশে বসে গ্রামের মুরুব্বিরা।

_ হরিহর তোমার ছেলেকে খবর দিয়েছো তো? তোমার ঘরে স্বয়ং মা মনসা এসেছেন এ তো কম কথা নয়। গ্রামের মোড়ল বলে ওঠে। হরিহর যেন কেমন জবুথবু হয়ে আছে। মাথা নেড়ে না বললো।ওপাড়ার গোপাল মুখুজ্যে রাশভারী গলায় বলল আমার ছেলের কাছে সুখুর নাম্বার আছে, ওকে বলবো ফোন করে দিতে। সবাই কিঞ্চিত সমীহের দৃষ্টিতে গোপাল মুখুজ্যের দিকে তাকালো। এই অজ পাড়াগাঁয়ে হাতে গোনা গুটিকতক মানুষের কাছে ওই ছোট যন্ত্রটা আছে। গ্রামের অর্ধেক মানুষের পেটে ভাত নেই তো মোবাইল। তার জন্য তো সুখেন্দু দলুই, রবি নস্কর, ফিরোজ কাজী,রাম মাঝি,তুহিন মুখার্জীদের মতো ছেলেরা কাজের আশায় ঘর ছেড়েছে। কেও অন্য রাজ্যে শ্রমিকের কাজ করে, কেও জরির কাজ,কেও গয়নার কাজ। মাসে মাসে টাকা পাঠিয়ে দেয়। বাড়ি ফেরে দুতিন বছর পর। হরিহরের ছেলে মোল্লাপাড়ার কামালের সাথে দিন সাতেক হলো মুম্বাই গেছে গয়নার কাজ করতে গেছে । ওই কয়েক বিঘা জমি তাতে চাষ করে আর কি আয় হয়। সুখেন্দুর মুদির দোকান ও ভালো না চলার জন্য সংসারে টান পড়ে। একবছর হলো নতুন বৌ ঘরে এসেছে, তাতে সংসারের অভাব আরো প্রকট হচ্ছে। লক্ষ্মী ভারি ভালো মেয়ে, চটপটে আর ভরাট চেহারার উনিশ বছরের মেয়েটা ছোট থেকেই মা বাপ হারা, মামাবাড়িতে মানুষ হয়েছে। তাই ছোট থেকেই অভাবের সাথে লড়াই করা আশ্রিতা মেয়েটার কোন অভাব অভিযোগ ছিলো না। শুধু সুখেন্দুর মনটা খুঁতখুঁত করতো।মুখ বুজে সব কাজ করে , বৌটাকে ভালো কাপড় কোনদিনই হাতে ধরে দিতে পারে নি। তাই ছুটিতে কামাল এসে যখন পাড়ার মোড়ে আড্ডা মারছিলো তখন কথায় কথায় কাজের কথা বলতেই সুখু এককথায় রাজী হয়ে যায়।

একটা মস্ত সাপ হেলেদুলে পেরিয়ে ধীরে ধীরে ঢুকে গেল উইঢিপির পাশের গর্তে। সবাই শশব্যস্ত হয়ে গেল। এতো মা মনসার আগমনের লক্ষণ। বেশ কয়েকটা হ্যারিকেন জ্বলছে তাতে আরো আলো আঁধারির সৃষ্টি হয়েছে। ঢোঁড়া সাপ হলে ও সবাই জাত সাপ মনে করলো।ঝিরঝির করে বৃষ্টি পড়ছে, বাতাসে ভেসে আসছে পটুশের কটু গন্ধ।
হঠাৎ লক্ষ্মী মাথাটা ঘোরাতে লাগলো। চোখ রক্তবর্ণ। সবাই ভয়ে তাকাতাকি করছে।
মা এসেছেন! মা এসেছেন! পুরুষরা ও দূরে দাওয়া থেকে উঠে দাঁড়ালো। একে একে সবাই লক্ষ্মীকে গড় করে নিজেদের প্রার্থনা আর সমস্যার কথা বলছে। লক্ষ্মী কোন কোনটার উত্তর দিচ্ছে না। কোনোটার উত্তর দিচ্ছে, ফুলবেল পাতা হাতে তুলে দিচ্ছে।কাউকে বা কোন বিশেষ দিনে স্নান করে আসতে বলছে, তাবিজ কবজ দেবে বলছে। গলাটা একদম ফ্যাসফ্যাসে, ওটা যে লক্ষ্মী তা চেনাই যায় না। ঘটনাটা ঘটছে সুখু যাওয়ার দু’দিন পর থেকেই। সন্ধ্যারাতে লক্ষ্মীকে ওইরকম করতে দেখে হরিহর ভয়ে পাশের বাড়ির পরাশরকে ডাকে। পরাশরের গিন্নি দেখেশুনে ডাক্তার ডাকতে বলে, সবার সন্দেহ হয় মৃগী হয়েছে বলে। এখান থেকে হেলথ সেন্টার আছে প্রায় দশ কিলোমিটার দূরে রাঙামুলায়। কে নিয়ে যাবে? তাই এখানের গরীবের সাথী হাতুড়ে ডাক্তারই ভরসা। ডাক্তার যখন কিছু ধরতে পারলো না আর সন্ধ্যা হলেই লক্ষ্মীর পরিবর্তনে সবাই ধরে নিলো স্বয়ং মা মনসার কৃপা রয়েছে লক্ষ্মীর ওপর। সুখু চলে যাবার পর ওই মেয়েটাকে মা মনসাই আগলে রাখছে। তারপর থেকে সন্ধ্যা হতেই লক্ষ্মীর এই ভর আসা। ধূপধুনোর গন্ধে চারদিক কেমন যেনো পবিত্র লাগছে। রাত আটটা অব্দি চললো লক্ষ্মীর কখনো রক্তচক্ষু হয়ে কাউকে বকাঝকা তো কখনো কাউকে কোন উপায় বাতলে দেওয়া। হঠাৎ করে সে মাথা ঘোরাতে ঘোরাতে নেতিয়ে পড়লো। রোজই এমন হয়। এখন কেও আর ভয় পায় না। এই পোড়া গ্রামে অর্ধেকের বাড়িতে কারেন্ট নেই। এই বর্ষাকালে কোনো মেলা, যাত্রার কোন প্রশ্নই নেই, তাই সন্ধ্যা হতেই বাড়ির মেয়ে বৌরা গা ধুয়ে সন্ধ্যা দিয়ে , বুড়োরা হুঁকো হাতে আর ছেলে ছোকরার দল পাকিয়ে এই মজলিসে আসে। কামালের বৌ আর পরাশরের মেয়ে দুজনের কাঁধে ভর করে লক্ষ্মী নিজের ঘরে এলো। মা মনসাকে উৎস্বর্গ করা দুধটুকু খাইয়ে ওরা চলে গেল। কামালের বৌ দুদন্ড আরো বসে চোখের ইশারায় দরজা বন্ধ করতে বলে চলে গেল। লক্ষ্মী সকাল থেকে উঠে রান্নাবান্না, উঠোন নিকোনো, ঘুঁটে দেওয়া , শ্বশুরকে খেতে দেওয়া যাবতীয় কাজকর্ম করে। তখন কে বলবে সন্ধ্যায় এই মেয়ের এই রূপ। বিছানায় গা এলিয়ে সে জানলা দিয়ে বাইরে তাকালো। মেঘ কেটে আকাশে একফালি চাঁদ উঠেছে। ব্যাঙেদের কনসার্ট শুরু হয়ে গেছে।উঠোনের নিমগাছের তলায় জোনাকির ঝাঁক জ্বলছে আর নিভছে। আজ বড় ধকল গেছে ওর ওপর দিয়ে। পাশের গাঁ থেকে ও লোক এসেছিলো, শুধু কি আসা তাকে হাজারো প্রশ্নের বন্যা। কার ছেলের অসুখ, কার মেয়ের বিয়ে হচ্ছে না, কার স্বামী নিরুদ্দেশ, কে ও বা অন্য মেয়ের খপ্পরে পড়েছে, কার বৌ বেয়াড়া, কার ছেলের চাকরি হচ্ছে না এইরকম হাজারো কথা। লক্ষ্মীর মনে পড়লো তার মামাবাড়িতে সিংহদের বিরাট জমিদারি ছিলো। ওই বাড়িতে একটা অল্পবয়সী বিধবা পিসি ছিলো, ওই পিসির ও ভর আসতো। সারাদিন সংসারে গাধা খাটুনি খাটতো। মঙ্গল আর শনিবার করে ভর আসতো। পিসি কি দারুন দেখতে ছিলো, কিন্তু ভর আসলে কি ভয়ঙ্কর লাগতো। দুলে দুলে কি সব বলতো। বাড়িতে ওই অভাগীর রাতারাতি মান বেড়ে গিয়েছিল। এঁটো বাসন কেও ধুতে দিতো না। সবাই বলতো পাপ হবে। লক্ষ্মী ওই পিসির খুব ন্যাওটা ছিলো, কথায় কথায় একদিন শুধায় পিসি তুমি সত্যি ঠাকুর! পিসি পানের পিক ফেলে ফিক করে হেসে বলতো মেয়ে মানেই কখনো দূর্গা কখনো কালী। এই পোড়া গতরটাকে বাঁচাতে , আশেপাশের দুপেয়ে জন্তুগুলোর হাত থেকে বাঁচতে ঠাকুর সাজতে হয়। এখন তুই দুধের বাছা, কিছু বুঝবি না। সেই দুধের বাছা এখন হাড়ে হাড়ে বুঝছে। এই বাড়িতে রাতে স্বামীকে জড়িয়ে যখন শুতো তখন মনে হতো স্বর্গ বুঝি একেই বলে। যেদিন তার সোয়ামী বললো কাজের জন্য তাকে দূরে যেতে হবে। ছমাস পরে আসবে, তখন লক্ষ্মী সুখুকে জড়িয়ে ধরে আকুল হয়ে কেঁদে বলেছিলো ওগো আমায় ছেড়ে যেও না, মোটা ভাত কাপড় তো জুটছে। দরকার নেই অত টাকার!
আরে পাগলী! তোকে যে এখনো পর্যন্ত একটা ভালো কাপড় সোনার দুল দিতে লারলাম । কিস্যু লাগবেক লাই। খালি তুমি ঘর ছেড়ে বলে ডুকরে কেঁদে উঠেছিলো। সুখেন্দু সস্নেহে লক্ষ্মীকে আদর করে বললো খালি তোর কথা ভাবলে হবে। তোর কোল আলো করে যে আসবে সে একটু সুখের মুখ দেখবে না। আমি ওখানে গিয়ে এখন কামাল আর রমেনের খোলিতে থাকবো। তারপর নিজে একটা খোলি ভাড়া করবো তখন তোকে নিয়ে চলে যাবো। ওখানে দুজনের সংসার হবে। সুখু যেখানে যাবে সেখানে ঘরকে খোলি বলে। বাপটার কি হবে?

এখানে থাকবে। জমি, ভিটেমাটি ছেড়ে কে ও যায়। আমরা আসা যাওয়া করবো খন। লক্ষ্মী সোয়ামী চলে যাওয়ার পর রাতে শ্বশুরকে জল আর হোমিওপ্যাথি ওষুধ দিয়ে এসে দেখে শুয়ে শুয়ে হরিহর কাতরাচ্ছে। কি হলো বাবা! হ্যারিকেনের আলোটা একটু বাড়িয়ে দিতে দিতে লক্ষ্মী বললো।

আজ মাঠে গিয়েছিলাম তো। কোমরটা কনকন করছে। একটু তেল মালিশ করে দিবি মা। লক্ষ্মী তাড়াতাড়ি রান্নাঘরে রসুন তেল গরম করে আনলো। ছোট থেকেই বাপহারা তাই শ্বশুরকে খুব ভালোবাসে। হরিহর কোঁকাতে কোঁকাতে উঠলো। লক্ষ্মী কোমরে হাতে পায়ে তেল দিয়ে মালিশ করে দিলে হরিহর ঘুমিয়ে গেলো।শাশুড়ি মা আজ থেকে দশ বছর আগে সাপে কাটায় মারা গেছেন, লক্ষ্মী আসার পর থেকে ওর যেটুকু যত্ন আত্তি হয়। পরের রাতে হরিহর তাড়াতাড়ি শুতে চলে গেলো। বৌমা, একটু তেল মালিশ করে দিবি, পিঠটায় আজ বড় বেদনা হচ্ছে।

লক্ষ্মী নিবু নিবু বাতির আলোয় শ্বশুরকে পিঠে তেল মাখাতে লাগলো। হঠাৎ হরিহর ওকে জাপটে ধরে বুকে টেনে নিয়ে বলতে লাগলো ওহো কতদিন মেয়ে মানুষের সঙ্গ পাই নি। শরীরটা জ্বলছে, বুকে আয় কি শান্তি। তোর সোয়ামী ও নেই আর আমি ও একা। আমি এই বুড়ো হাড়ে সুখুর থেকেও কম ভেল্কি দেখাতে পারবো। কেও জানতে পারবে না, তুই ও সুখে থাকবি আর আমিও। রোজ রাতে এই বলে লক্ষ্মীর বুকটা চেপে ধরে তাকে বিছানায় শোয়াতে গেল। সত্যি এই বুড়ো বয়সে বুড়োর কি জোর। কোথায় গেলো কোমরে ব্যাথা। যদি ও হরিহরের বয়স এখন ও ষাট পেরোয় নি। দেশগ্রামে এমনই হয়। লক্ষ্মীর দমবন্ধ হয়ে আসছিলো, ঘটনার আকস্মিকতায় ও প্রথমে কি করবে বুঝতে পারছিলো না। হরিহর যখন ওর শাড়ি খোলার চেষ্টা করছিলো তখন ও সময় নিলো, তারপর বুদ্ধি করে তক্তার পাশে রাখা হ্যারিকেনটা নিয়ে শ্বশুরের গায়ে আঘাত করলো । সব অন্ধকার। _ আমায় মেরে ফেললে শয়তানী বলতে বলতে হরিহর চেঁচিয়ে উঠলো।

লক্ষ্মী দৌড়ে ঘরের দরজা বন্ধ করে হাঁফাতে লাগলো। সারা শরীর থরথর করে কাঁপছিলো, ঘামে শরীর জবজব করছে। ও প্রায় বিবস্ত্র হয়ে সারা রাত দরজার কাছে বসে রইলো।ভোরের আলো ফোটার সাথে সাথে ঘরের বাইরে এসে দেখলো শ্বশুর বাড়িতে নেই। লক্ষ্মী কাকে কি বলবে বুঝতে পারলো না। একবার কি মনে করে কামালের বাড়ি ঘুরে ওর বৌ সাবিনার সাথে সব কথা খুলে বলে এলো। সাবিনা ওর থেকে বয়সে অনেকটা বড়। ও লক্ষ্মীকে বোঝালো যে এইসব কথা পাড়ায় বললে লোকে ওকেই চরিত্রহীন বলবে, ওর শ্বশুরকে নয়। ও দেখছে কি করা যায়। ঘরে এসে দোর দিয়ে থাকলো। বিকেলে দেখলো হরিহর খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে এলো, কপালের একপাশটা কাটা। লক্ষ্মী বুঝলো কালকের হ্যারিকনের ধাক্কা। বিকেল থেকেই লক্ষ্মীর মা মনসার ভর এলো। সারা গ্রাম তো রাত অব্দি লক্ষ্মীকে পাহারা দিয়ে থাকে। হরিহরের সাথে এখন পাশের বাড়ির পরাশর কাকা শোয়। আজ চুপিচুপি সাবিনা বলেছে সুখেন্দু সামনের সপ্তাহে আসছে। লক্ষ্মী একটা লম্বা শ্বাস নিয়ে জানলার কাছে দাঁড়ালো। সুখেন্দু কি ওকে বিশ্বাস করবে? মুখে একটা অদ্ভুত হাসি খেলে গেলো। রোজ রাতে সুরক্ষার জন্য ঘরে রাখা মাছ কাটার ধারালো আঁশবটিটা হাতে নিয়ে দাঁড়ালো। আকাশের একফালি চাঁদের আলো ওই বটিতে পড়ে চকচক করছে। পাশের পুকুরের ধারের বনকলমীর ঝোপ থেকে দাঁড়াশ সাপটা হেলেদুলে যেন মা মনসার দোরের সামনে থমকে দাঁড়ালো।

© মিতার কলমে অগ্নি
চিত্র ঋণ_ ইন্টারনেট

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here