যুদ্ধের রং
★★নাসরিন জাহান মাধুরী
রেণু বালা শ্রুতিদের পাশের বাসার বউটি। দুধে আলতায় গায়ের রং। শ্রুতির কেন জানি ভালো লাগতো রেণু বালাকে। ওদের দরজায় দাঁড়িয়ে দেখতো রেণুবালার সংসার। ঘরে ঢোকা নিষেধ ছিলো, মুসলিমেরা হিন্দু ঘরে ঢুকলে ওদের অশুচ হয়। রেণুবালার শ্বাশুড়ির কড়া নজরদার।
শ্বাশুড়ি না থাকলে রেণুবালার ঘরে অবাধ যাতায়াত ছিলো শ্রুতির । ও মুগ্ধ চোখে দেখতো রেণুবালাকে। পরিপাটি সেজে থাকতো রেণুবালা। চুল আটকরে বড় খোপায় বাঁধা থাকতো। কপালে সিঁদুরের টিপ, সিথি বরাবর টকটকে সিঁদুর রেখা।
ওর ঘরটাও তেমন পরিপাটি। একটা উঁচু পালঙ্ক পরিপাটি সাজানো, পালঙ্কে ওঠার জন্য একটা টুল।সব কিছুই শ্রুতির ভালো লাগতো।
রেণুবালা কাশার থালা বাসন গ্লাস সব হাতের তালুতে নিয়ে পুকুর ঘাটে ধুতে যেত, শ্রুতি পুকুর পারে বসেবসে দেখতো ওর কাজ। একমনে থালাবাসন ধুয়ে পুকুর ঘাট থেকে ফিরে আসতো।
রেনু বালার মুখে শ্রুতি হাসি দেখেনি। অপরূপ মুখটা তার বিষাদে ছেয়ে থাকতো। আর শ্বাশুড়ির গঞ্জনাতো ছিলোই। রেনু বালার বিয়ের বারো বছর হয়ে গেছে, ঘরে কোন সন্তান আসেনি। তাই রেনুবালার মনে শান্তি নেই। বিষন্ন সুন্দর রেনুবালাকে দেখতো শ্রুতি।
শ্রুতি প্রায়ই যেতো হিন্দু পাড়াটায়, বিশেষ করে রেনুবালাকে দেখতে।
এর মাঝে ১৯৭১ এর যুদ্ধ শুরু হলো। সবাই ছোট্ট মফস্বল শহরটা ছাড়তে শুরু করলো। শ্রুতিরাও বাড়ি ছেড়ে চলে গেলো। যুদ্ধ শেষ হলো, দেশ স্বাধীন হলো। একে একে সবাই শহরে ফিরে এলো। শ্রুতিরাও ফিরে এলো। নিজেদের বাড়িটাই অচেনা। ওঠোন জুড়ে শ্যাওলার স্তর। আগাছা গজিয়েছে।
শ্রুতির বাবা মা সব সাফসুতরো করে আবার বাস যোগ্য করে তুললেন।
শ্রুতি ঘুরতে গেলো হিন্দু বাড়ি গুলোতে। রেনুবালার বাড়িতে গিয়ে সে অবাক। রেণুবালার পালংকে পা ঝুলিয়ে বসে আছে যে তাকে দেখে চমকে ওঠলো শ্রুতি। আরে এতো রহিমার মা,শ্রুতিদের বাসায় ওর মাকে কাজে সাহায্য করতো। ওরা বিহারী। যুদ্ধের সময় বিহারিদের দাপট ছিলো। হিন্দু বাড়িগুলো দখল করে নিয়েছিলো।
শ্রুতির মন খারাপ হয়ে গেলো।এটা সে মেনে নিতে পারেনি। রেনুবালার জন্য মন খারাপ হয়ে গেলো।
তবে রেনুবালারা যখন ফিরে এলো তখন রহিমার মা সবার চাপে ওদের বাড়ি ফিরিয়ে দিতে বাধ্য হয়।