ভারত থেকে বাংলা সাহিত্যের অন্যতম সারথি সুনির্মল বসুর অনবদ্য অনুভূতির প্রেমের গল্প “পাল্টা হাওয়া ’’

54

“পাল্টা হাওয়া ’’
সুনির্মল বসু

আমি হেরে গেলাম শোভন, আমি কিছুতেই ভাগ্যের চাকাটা ঘুরিয়ে দিতে পারলাম না । দুর্ভাগ্য নিয়ে জীবন শুরু করেছিলাম, ব্যর্থতার মেঘগুলো সারা জীবন আমাকে ঢেকে রাখলো। সেদিনও আমার পায়ের তলায় কোনো জমি ছিল না, আজও আমার পায়ের তলায় কোনো শক্ত জমি নেই।

কথাগুলো শোভনের কাছে কান্নার মতো শোনালো।

পঞ্চাশ বছর আগে কলেজ ক্যান্টিনে পৃথার সঙ্গে দেখা হয়েছিল। তখন দুজনেরই অল্প বয়স। উড়ে বেড়াবার সময়। কলেজ ক্যান্টিনে পাউরুটি ঘুগনি আর চা পর্ব চলছিল।

পৃথা দু প্যাকেট লজেন্স নিয়ে এসেছিল, বিক্রি করতে। বন্ধুরা তখন হই হই করে অফ পিরিয়াডে
পাশের রুমে ক্যারাম খেলায় ব্যস্ত।

পৃথা একপাশে জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়িয়েছিল।
ওর করুন মুখটা শোভনের চোখে পড়ে। এগিয়ে গিয়ে শোভন বলে, তোরা সবাই এখান থেকে লজেন্স কিনে নে। তারপর নিজেই এগিয়ে গিয়ে
দু প্যাকেট লজেন্স বিক্রি করে দেয়।

সেদিন পৃথা বলেছিল, ওর মায়ের ক্যান্সার। বাবা প্রাইভেট কোম্পানিতে চাকরি করতেন। কোম্পানী বন্ধ হয়ে গিয়েছে। তাই সংসারটা বাঁচাবার জন্য এই পথে নামতে হয়েছে পৃথাকে।

পরে আর একদিন পৃথা এলো। ওই বয়সে মেয়েদের সাহায্য করতে পারলে, মনের ভেতরে একটা শিভারলি অনুভব হয়, তাই বরাবর শোভন ওকে
লজেন্স বিক্রি করতে সাহায্য করেছিল।

পৃথা এরপরেও সপ্তাহে এক দুদিন কলেজে লজেন্স বিক্রি করতে আসতো।
শেষবারের মতো যেদিন এসেছিল, সেদিন একমুঠো লজেন্স শোভনের হাতে তুলে দেয়। বলে, এগুলো তুমি নাও,
আহা, তা কেন! তোমার লস হবে।
আর তুমি যে আমার জন্য এত কিছু করলে!
সেই শেষ দেখা।

তারপর আজ পার্ক স্ট্রিটের মোড়ে ওর সঙ্গে দেখা।
বলল, আমি পারলাম না। আমি হেরে গেলাম শোভন।
কি হয়েছে, বলো?
তোমাদের কলেজে যাওয়া বন্ধ করলাম, কারণ, মা একদিন ক্যান্সারে মারা গেল। চাকরি হারিয়ে বাবা ঘরে বসে আছেন। খিটখিটে হয়ে গেছেন। স্কুলে মাইনে দিতে না পারায়, ভাইয়ের পড়াশোনা বন্ধ।
তারপর?
আমি একটা বুটিকে হেল্পার হিসেবে চাকরি নিলাম।

ভাইকে পড়ালাম। ও পাশ করে, সল্টলেকে একটা সফটওয়্যার কোম্পানিতে চাকরি পেল। ভালোবেসে একটি মেয়েকে বিয়ে করলো।

শোভন বলল, চলো একটা রেস্টুরেন্টে বসি। চা খেতে খেতে তোমার কথা শুনবো।
ওরা রেস্টুরেন্টে পৌঁছল। শোভন চায়ের অর্ডার দিল।
বলল, বলো।
পৃথা বললো, ভাই আর ভাইয়ের বউ মিলে আমাকে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছে। জীবনে কিছুই তো পেলাম না। অথচ কি লড়াই কি লড়াই।
শোভন বলল, এখন আছো কোথায়?
এক বান্ধবীর বাড়িতে। ঘর খুঁজছি। তোমার কথা বলো? আমার মাথার সামনে চুল গুলো শুধু পাকেনি, তোমারও চুল ঝুলফি সাদা হয়ে গেছে।

শোভন হাসলো। বড় চাকরি করতাম। অবসর নিয়েছি। বাবা মার ইচ্ছা অনুসারে অনুশীলাকে বিয়ে করেছিলাম। বড় লোকের বাড়ির মেয়ে। আমার সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারেনি। তারপর জীবনে বহু মেয়ে এসেছে। তারা কেউ আমাকে ভালোবাসেনি।
আমিও কাউকে মন থেকে ভালবাসতে পারিনি।

পৃথা বলল, জীবন আমাদের কতদূর পর্যন্ত নিয়ে এলো। আচ্ছা, আমার কথা কি তোমার কখনো মনে পড়তো?
হ্যাঁ, অস্বীকার করবোনা, মাঝে মাঝে ভাবতাম, কোথায় হারিয়ে গেল, সেই দুঃখী মেয়েটা!
পৃথা বলল, পৃথিবীটা গোল, তাই আবার আমাদের দেখা হোল।
কতদিন পর, আহা, কতদিন!
তুমি কি একলাই আছো?
হ্যাঁ তো,
আসলে, পৃথিবীতে সব মানুষই মনে হয়, একলা।
স্বার্থপর সংসারে মানুষের একাকীত্ব সীমাহীন।
এখন কোথায় যাবে?
বান্ধবীর ওখানে। লেক টাউনে।
চলো, আমার গাড়িতে তোমাকে পৌঁছে দিই।
পৃথা শোভনের স্যান্ট্রো গাড়িতে ওর পাশে এসে বসলো।
শোভন গাড়ি স্টার্ট দিয়ে এগিয়ে চলল।

পৃথাকে গন্তব্যে নামিয়ে দিয়ে বলল, যদি কখনো আমাকে মনে পড়ে, এসো সেদিন। আমি বেহালায় শীলপাড়ায় থাকি। পৃথাকে ফোন নাম্বার দিয়ে বলল,
ফোন করে এসো। একলা থাকি, কখন কোথায় যাই,
ঠিক থাকে না।

আজ রোববার সকাল। বুলটির মা সকালে চা জল খাবার দিয়ে গেল। অনেক দিনের কাজের লোক। এখন দুপুরের রান্নায় বসেছে।

শোভন খবরের কাগজে চোখ রেখেছিল। ল্যান্ড ফোনটা বেজে উঠলো। ও প্রান্ত থেকে কথা ভেসে এলো, তোমার কাছে আজ সকালে আসছি শোভন!
এসো, চিনতে অসুবিধে হলে, আমাকে ফোন কোরো।
আচ্ছা।
সকাল এগারোটার কিছু পরে পৃথা এলো।
বোসো।
শোভন, জীবনটাকে ঠিক বুঝতে পারলাম না।
কেউ কেউ পাবার ভাগ্য নিয়ে আসে, কেউ কেউ শুধু দিয়ে যায়, জীবনের খাতাটা বরাবর শূন্য থেকে যায়।
হবে হয়তো!
আজ আর আমাদের প্রেম ভালোবাসা করবার বয়স নেই।
ঠিকই তো,
কিন্তু আমরা তো ভালো বন্ধু হতে পারি!
এভাবে কখনো ভেবে দেখিনি। তবে সত্যিই এ বয়সে ভালোবাসাটা ঠিক আসে না।
জীবনের বিভিন্ন ঘাটে ঘাটে ক্রমাগত ঘা খেতে খেতে
ভালোবাসা শব্দটা ভুলতে বসেছি।
ভেবে দেখার বয়স যখন ছিল, তখন জীবনে সেই সুযোগ আসেনি।
তোমার কি সেজন্য অনুশোচনা হয়?
হয়তো অবশ্যই।
কৃষ্ণচূড়া রাধাচূড়ার রঙিন দিনগুলো কবে যে কখন পিছনে চলে গেল, বুঝতেই পারলাম না।
ঈশ্বর হয়তো আমাদের ওইভাবে দেখতে চাননি।
ভাগ্যের দোষ বলছো?
জানিনা ঠিক।
তাই বলছিলাম, সেদিনও আমরা বন্ধু ছিলাম, আজ এই বয়সে পৌঁছে এখনো আমরা বন্ধু থেকে যেতে চাই।
ঠিক বলেছো। সত্যিকারের বন্ধু মানে, একে অন্যের প্রতি সহমর্মিতা। সুখে দুঃখে পাশে থাকা। সব সময় একটা মরাল সাপোর্ট।
ঠিক বলেছো, অপুর সংসার সিনেমার শেষ ডায়লগটা মনে আছে?
কি?
বাবা নয়, বন্ধু!
বন্ধুত্ব সব হারানো মানুষদের বেঁচে থাকার ঠিকানা হতে পারে।
কই এমনভাবে তো ভাবিনি কখনো!
তুমি কি রাজী?
হ্যাঁ তো,
শোভন বলল, পঞ্চাশ বছর আগে বঙ্গবাসী কলেজে ছাত্র থাকাকালে তোমার আমার বন্ধুত্ব হয়েছিল, পঞ্চাশ বছর বাদে আমরা না হয় বন্ধুই থেকে গেলাম!

বুল্টির মা চা দিয়ে গেল। পৃথা চায়ের কাপে মুখ দিল।

ওদের দুজনের কারোরই আর একা মনে হলো না।
কলকাতার আকাশটা আজ যেন অনেক বেশি গাঢ় নীল, শোভনের ব্যালকনিতে মাধবীলতা দুলছিল। পৃথা বোগেন ভেলিয়া গাছের পাতায় হাত রাখলো।

জীবনে কখনো কখনো পাল্টা হাওয়া এসে সবকিছু ওলট-পালট করে দেয়, ওদের দুজনের কারো এই শুভ সংবাদটা জানা ছিল না।

ঠিকানা, সুনির্মল বসু। নবপল্লী, বাটানগর, দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা, কলকাতা,৭০০১৪০. পশ্চিমবঙ্গ,
ভারত।
মোবাইল নম্বর, ৬২৯০২০৭০৬৬.

Content Protection by DMCA.com

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here