দৈনিক আলাপ ওয়েবডেস্ক: দুই মামলায় ১৭ বছরের কারাদণ্ডের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে আপিল বিচারাধীন রেখে আগামী নির্বাচনে প্রার্থী হতে চান বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। এ লক্ষ্যে ইতিমধ্যেই সুপ্রিমকোর্টের উভয় বিভাগে সাজা স্থগিত এবং বাতিল চেয়ে তার পক্ষে দুটি পৃথক আপিল করা হয়েছে।
এ বিষয়ে আইনজ্ঞরা বলছেন, বর্তমান অবস্থায় খালেদা জিয়ার আগামী নির্বাচনে প্রার্থী হতে আইনি বাধা রয়েছে। তাছাড়া এখনও একটি মামলায় শুনানির জন্য আদালত আপিল গ্রহণ করেননি। আপিল গ্রহণের আগ পর্যন্ত বলা যাবে না মামলাটি বিচারাধীন।
তবে খালেদা জিয়ার আইনজীবীরা বলেছেন, আপিল বিচারাধীন থাকলেই খালেদা জিয়া নির্বাচন করতে পারবেন, এমন অনেক নজিরও রয়েছে। আপিলটি গ্রহণের জন্য তারা আদালতে উপস্থাপনের চিন্তাভাবনা করছেন। আগামী ২ কার্য দিবসের মধ্যেই শুনানির জন্য আপিলটি হাইকোর্ট গ্রহণ করবেন বলে তারা আশাবাদী।
তাদের মতে, নিু আদালতের দেয়া সাজার বিরুদ্ধ উচ্চ আদালতে আপিল নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত চূড়ান্ত বিচার বলা যাবে না। সেই ক্ষেত্রে খালেদা জিয়ার আপিল এখনও চলমান। সর্বশেষ সোমবার বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরও বলেছেন, খালেদা জিয়া নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারবেন। এ নিয়ে এখন পর্যন্ত কোনো শঙ্কা নেই।
এদিকে দলীয় একটি সূত্রে জানা গেছে, তিনটি আসনে খালেদা জিয়ার মনোনয়নপত্র চূড়ান্ত করা হয়েছে। আবার বিকল্প হিসেবে প্রার্থীও রাখা হয়েছে। ঘোষিত তফসিল অনুযায়ী মনোনয়নপত্র দাখিলের শেষ তারিখ ২৮ নভেম্বর।
সংবিধান অনুযায়ী কোনো ব্যক্তি সর্বনিম্ন ২ বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত হলে তিনি নির্বাচনে অযোগ্য বিবেচিত হবেন। আর নির্বাচন কমিশন থেকেও বলা হয়েছে নিু আদালতে দণ্ডিত কোনো ব্যক্তির সাজার ওপর উচ্চ আদালতের স্থগিতাদেশ না থাকলে সংসদ নির্বাচনে তার মনোনয়নপত্র বাতিল বলে গণ্য হবে।
জানতে চাইলে খালেদা জিয়ার অন্যতম আইনজীবী সানাউল্লাহ মিয়া শুক্রবার যুগান্তরকে বলেন, আমরা ম্যাডামের (খালেদা জিয়া) সাজা স্থগিত এবং বাতিল চেয়ে আপিল করেছি। সঙ্গে জামিনও চেয়েছি। তবে আমরা এ মুহূর্তে আপিল শুনানিতে যাচ্ছি না। কারণ আপিল বিচারাধীন থাকাবস্থায় খালেদা জিয়া নির্বাচন করতে পারবেন এমন অনেক নজির আছে।’
তিনি বলেন, ‘একটি মামলায় ১০ বছরের কারাদণ্ডের বিরুদ্ধে সিএমপি ফাইল করেছি। কারণ এ মামলায় এখনও পূর্ণাঙ্গ রায় বের হয়নি। আর অন্য মামলায় ৭ বছরের কারাদণ্ডের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে আপিল করেছি। আগামী দু-এক দিনের মধ্যে হাইকোর্টের কোনো একটি বেঞ্চে শুনানির জন্য আপিলটি উপস্থাপন করব। আশা করছি আমাদের আপিল এডমিট হবে।’
খালেদা জিয়ার আরেক আইনজীবী অ্যাডভোকেট জয়নুল আবেদীন বলেছেন, জিয়া চ্যারিটেবল মামলায় নিু আদালতের দেয়া ৭ বছরের সাজার বিরুদ্ধে আপিল করা হয়েছে। এখন শুনানির জন্য আপিলটি হাইকোর্টের একটি বেঞ্চে উপস্থাপনের জন্য আমরা চিন্তাভাবনা করছি।
জানা গেছে, ৩০ অক্টোবর জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় হাইকোর্ট খালেদা জিয়ার নিু আদালতের দেয়া ৫ বছরের সাজা বাড়িয়ে ১০ বছর করেন। এ মামলার এখনও পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয়নি। পরে সাজা স্থগিত ও জামিন চেয়ে ১৯ নভেম্বর আপিল বিভাগে সিএমপি (ক্রিমিনাল মিসসেলেনিয়াস পিটিশন) ফাইল করেছেন খালেদা জিয়ার আইনজীবীরা। আর ২৯ অক্টোবর জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলায় খালেদা জিয়াকে ৭ বছরের কারাদণ্ড দেন বিচারিক আদালত। এ মামলায় খালেদা জিয়ার খালাস চেয়ে ১৮ নভেম্বর হাইকোর্টে আপিল আবেদন করেন আইনজীবীরা।
খালেদা জিয়ার নির্বাচন প্রসঙ্গে সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ যুগান্তরকে বলেন, ৭ বছরের কারাদণ্ডের বিরুদ্ধে খালেদা জিয়া হাইকোর্টে আপিল করলেও তা এখনও শুনানির জন্য গ্রহণ হয়নি। এ অবস্থায় আপিল বলা যায় না। এখনও তার সাজা স্থগিত হয়নি। তিনি বলেন, সংবিধান অনুযায়ী খালেদা জিয়া আগামী নির্বাচনে অযোগ্য।
খালেদা জিয়ার অন্যতম আইনজীবী এম মাহবুব উদ্দিন খোকন বলেন, নিু আদালতের বিচারকে চূড়ান্ত বিচার বলা যাবে না। কারণ আপিলে খালাসও পেতে পারেন। তাই আপিল বিচারাধীন থাকাবস্থায় নির্বাচনে অংশগ্রহণের সুযোগ রয়েছে।
তিনি বলেন, বর্তমান ত্রাণমন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীর এ অবস্থায় নির্বাচন করেছেন।
তিনি আরও বলেন, অবৈধভাবে সম্পদ অর্জনের অভিযোগে দুদকের মামলায় বর্তমান ত্রাণমন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়াকে ২০০৮ সালে ঢাকার বিশেষ জজ আদালত ১৩ বছরের কারাদণ্ড দিয়েছিলেন। এ সাজার বিরুদ্ধে তিনি হাইকোর্টে আপিল করেন। তার আপিল বিচারাধীন থাকাবস্থায় তিনি নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হন এবং সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।
একই ভাবে সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীরকেও অবৈধভাবে সম্পদ অর্জনের অভিযোগে ২০০৭ সালে ঢাকার বিশেষ জজ আদালত ১৩ বছরের কারাদণ্ড দেন। এরপর তিনি হাইকোর্টে আপিল করেন। হাইকোর্টে আপিল বিচারাধীন থাকাবস্থায় নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নেন ও এমপি নির্বাচিত হন।
জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট এবং জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলার বাদী দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। মামলার আইনজীবী অ্যাডভোকেট খুরশীদ আলম খান যুগান্তরকে বলেন, খালেদা জিয়া দুটি দুর্নীতির মামলায় এখন সাজাপ্রাপ্ত। তার সাজা উচ্চ আদালতে স্থগিত অথবা বাতিল হয়নি। বরং তার দণ্ড আরও বেড়েছে। তাই সংবিধান অনুযায়ী আগামী একাদশ সংসদ নির্বাচনে তিনি বর্তমানে অযোগ্য।
সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. শাহদীন মালিক এর আগে যুগান্তরকে বলেছিলেন, সংবিধানের ৬৬(২)(ঘ) অনুচ্ছেদে যে দণ্ডের কথা বলা হয়েছে সেটা কোন আদালতের দণ্ড তা স্পষ্ট নয়। এটা কি নিু আদালতের, নাকি হাইকোর্টের আপিল বিভাগের তা স্পষ্ট হয়নি আজও।
তিনি বলেন, আমার মতে, দেশের সর্বোচ্চ আদালত আপিল বিভাগে যদি সাজা বহাল থাকে তবেই শুধু একজন ব্যক্তি নির্বাচনে অযোগ্য হবেন। কিন্তু খালেদা জিয়ার মামলা এখনও সে পর্যন্ত যায়নি। হাইকোর্ট রায় দিয়েছেন। এর বিরুদ্ধে আপিল করা ও রিভিউ আবেদন করার সুযোগ রয়েছে। তাই তিনি নির্বাচন করতে পারবেন কিনা, সেটা নির্ভর করছে আদালতের সিদ্ধান্তের ওপর।
নথিপত্র পর্যালোচনায় দেখা যায়, খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে ৩৬টি মামলার মধ্যে দুর্নীতির আছে ৫টি। সেগুলো হল- জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট, জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট, নাইকো, গ্যাটকো ও বড়পুকুরিয়া কয়লা খনি মামলা। পাঁচটি মামলাই এক-এগারোর সময়ে করা। বাকি ৩১টি ২০১৪ সালের পর করা।