বিশেষ প্রতিনিধি: তৎকালীন বিডিআর সদর দফতরে সেনা কর্মকর্তাদের নৃশংসভাবে হত্যাযজ্ঞের ১০ বছর পূর্তি আজ, শোকাবহ পিলখানা ট্র্যাজেডি দিবস। ২০০৯ সালের ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারি তৎকালীন বিডিআর (বর্তমানে বিজিবি) সদর দফতরে বিপথগামী সদস্যরা কিছু দাবি-দাওয়া আদায়ের নামে অগ্নিসংযোগ, লুটপাট ও নির্মম হত্যাযজ্ঞের মাধ্যমে তাণ্ডব চালায়।
ওই দু’দিনে তৎকালীন বিডিআরের মহাপরিচালকসহ (ডিজি) ৫৭ জন সেনা কর্মকর্তা এবং নারী ও শিশু ছাড়াও আরও ১৭ জনকে হত্যা করে বিদ্রোহীরা। দীর্ঘ ১০ বছরেও ওই নির্মম হত্যাকাণ্ডের শোক কাটিয়ে উঠতে পারেননি নিহতদের স্বজনরা।

হত্যাকাণ্ডের ১১তম বার্ষিকীতে আজ মঙ্গলবার (২৫ ফেব্রুয়ারি) সকাল থেকেই বনানী সামরিক কবরস্থানে জড়ো হয়েছেন নিহত সেনা সদস্যের পরিবার। শোক, শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় তারা স্মরণ করেন না-ফেরার দেশে চলে যাওয়া স্বজনদের।
মঙ্গলবার সকালে বনানী সামরিক কবরস্থানে নিহত সামরিক সদস্যদের স্মরণ করে তাদের কবরে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল। এর আগে, রাষ্ট্রপতির পক্ষে তাঁর সামরিক সচিব মেজর জেনারেল এস এম শামিম উজ্জামান এবং প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে প্রধানমন্ত্রীর সামরিক সচিব মেজর জেনারেল নকিব আহমেদ চৌধুরী নিহতদের কবরে পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন।

এছাড়াও সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদ, নৌবাহিনী ভারপ্রাপ্ত প্রধান রিয়ার অ্যাডমিরাল মোহাম্মদ শাহিন ইকবাল, বিমান বাহিনীর প্রধান এয়ার চিফ মার্শাল মাসিহুজ্জামান সেরনিয়াবাত এবং বিজিবির মহাপরিচালক মোহাম্মদ সাফিনুল ইসলাম পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন। এরপর শহীদদের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের জন্য এক মিনিট নীরবতা পালন শেষে তাদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করে দোয়া করা হয়।
পিলখানা হত্যা দিবস স্মরণে দুই দিনব্যাপী বিশেষ কর্মসূচি পালন করবে বিজিবি।
ঘটনাক্রম: হাইকোর্টে জমা হওয়া মামলার নথি থেকে জানা যায়, ২০০৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি ছিল তৎকালীন বিডিআরের বার্ষিক দরবারের দিন। অনুষ্ঠান শুরু হয় সকাল ৯টায় সদর দফতরের দরবার হলে।
সে সময় সেখানে উপস্থিত ছিলেন মহাপরিচালক (ডিজি) মেজর জেনারেল শাকিল আহমেদ, উপমহাপরিচালক (ডিডিজি) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এমএ বারী, বিভিন্ন ইউনিটের কর্মকর্তাসহ বিডিআরের নানা পদের সদস্যরা। সরকারি তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন অনুসারে, ওই দিন দরবারে উপস্থিত ছিলেন ২ হাজার ৫৬০ জন।
দরবার শুরুর পর মহাপরিচালকের বক্তব্য চলাকালে সকাল ৯টা ২৬ মিনিটে মঞ্চের বাঁ দিকের পেছন থেকে দু’জন বিদ্রোহী জওয়ান অতর্কিতে মঞ্চে প্রবেশ করেন, একজন ছিলেন সশস্ত্র। শুরু হয় বিদ্রোহ। দরবার হলের বাইরে থেকে গুলির আওয়াজ ভেসে আসে।
কিছুক্ষণের মধ্যে লাল-সবুজ রঙের কাপড় দিয়ে নাক-মুখ বাঁধা বিদ্রোহী জওয়ানরা দরবার হল ঘিরে গুলি শুরু করেন। সকাল সাড়ে ১০টার দিকে বিদ্রোহীরা কর্মকর্তাদের দরবার হল থেকে সারিবদ্ধভাবে বের করে আনেন। ডিজির নেতৃত্বে কর্মকর্তারা দরবার হলের বাইরে পা রাখা মাত্র মুখে কাপড় ও মাথায় হলুদ রঙের হেলমেট পরা চারজন ডিজিকে লক্ষ্য করে ব্রাশফায়ার করেন। ডিজির পর হত্যা করা হয় আরও কয়েকজন কর্মকর্তাকে।
এরপর পিলখানার ভেতরে ধ্বংসযজ্ঞ চলতে থাকে। দুপুর সোয়া ১২টার দিকে বিমানবাহিনীর একটি হেলিকপ্টারে করে বিদ্রোহীদের অস্ত্র সমর্পণের আহ্বান জানিয়ে লিফলেট ছাড়া হলে ওই হেলিকপ্টার লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ে বিদ্রোহীরা।
এ সময় প্রায় আধা ঘণ্টা ধরে বিদ্রোহীরা এলোপাতাড়ি গুলি ছোড়ে। সন্ধ্যায় পিলখানার বিদ্যুৎ-সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে নিহত সেনা কর্মকর্তাদের লাশ মাটিতে পুঁতে ও সরিয়ে ফেলা হয়।
২৬ ফেব্রুয়ারি বেলা আড়াইটায় টেলিভিশন ও বেতারে প্রচারিত জাতির উদ্দেশে ভাষণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, বিদ্রোহীদের অস্ত্র সমর্পণ করে ব্যারাকে ফিরে যেতে হবে। এরপর বিদ্রোহীরা অস্ত্র সমর্পণের সিদ্ধান্ত নেন। সন্ধ্যা ৬টা থেকে বিদ্রোহীরা অস্ত্র সমর্পণ শুরু করেন।
নারকীয় এ হত্যার ঘটনায় দায়ের করা হয় দুটি মামলা। এর মধ্যে সেনা কর্মকর্তাদের নিহতের ঘটনায় দণ্ডবিধি আইনে করা হয় হত্যা মামলা। অপরটি হয় বিস্ফোরক আইনে। দুটি মামলার মধ্যে হত্যা মামলায় নিম্ন আদালত ১৫২ জনের মৃত্যুদণ্ড দেয়। পরে ২০১৭ সালের ২৭ নভেম্বর হাইকোর্টে আপিলের রায়ে ১৩৯ জনের মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখা হয়। ৮ জনের মৃত্যুদণ্ডের সাজা কমিয়ে যাবজ্জীবন ও চার জনকে খালাস দেওয়া হয়। নিম্ন আদালতে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের আদেশ পাওয়া ১৬০ জনের মধ্যে ১৪৬ জনের সাজা বহাল রাখা হয়। হাইকোর্টে আপিল চলার সময়ে কারাগারে থাকা অবস্থায় দুজনের মৃত্যু হয়। খালাস পান ১২ আসামি।
বিস্ফোরক আইনের মামলা: ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতে বিচারাধীন রয়েছে বিস্ফোরক আইনের মামলাটি। এই মামলায় আসামি রয়েছেন ৮৩৪ জন। এর মধ্যে এক জন সিভিলিয়ান, বাকি আসামিরা বিডিআরের জওয়ান। এই মামলায় আসামিদের মধ্যে ২৪ জন মারা গেছেন। জীবিত আসামি ৭৯০ জন। পলাতক রয়েছেন ২০ জন। এ মামলায় ১৪৬ জন সাক্ষী দিয়েছেন। এ মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের প্রায় ১২০০ সাক্ষী রয়েছে। আগামী ৮ মার্চ পরবর্তী সাক্ষীর সাক্ষ্যগ্রহণের জন্য দিন ধার্য রয়েছে।