আদর্শ, চিন্তাচেতনা ও মূল্যবোধের আলোয় আলোকিত লেখক-মেরী খাতুনের ভাষার বিশ্লেষণ ধর্মী লিখা“সবার সেরা বাংলা ভাষা’’

154
মেরী খাতুনের ভাষার বিশ্লেষণ ধর্মী লিখা “সবার সেরা বাংলা ভাষা’’

সবার সেরা বাংলা ভাষা
কলমে মেরী খাতুন

১৯৪৭ সালে দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে ভারত ভাগ হয়ে পাকিস্তান অধিরাজ্য ও ভারত অধিরাজ্য নামক দুটি স্বাধীন রাষ্ট্রের উদ্ভব হয়।পাকিস্তানের ছিল দুটি অংশ পূর্ব বাংলা ও পশ্চিমপাকিস্তান।১৯৪৮ সালে পাকিস্তান অধিরাজ্য সরকার ঘোষণা করে যে,উর্দু-ই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা।এই ঘোষণার প্রেক্ষাপটে পূর্ব বাংলার বাংলাভাষী মানুষ আকস্মিক ও অন্যায্য এ সিদ্ধান্তকে মেনে নিতে পারেনি।এবং মানসিক ভাবে মোটেও প্রস্তুত ছিল না।ফল স্বরূপ বাংলা ভাষার সম-মর্যাদার দাবিতে পূর্ব বাংলার আন্দোলণ দ্রুত দানা বেঁধে ওঠে।আন্দোলণ দমনে পুলিশ ১৪৪ ধারা জারি করে ঢাকা শহরে মিছিল,সমাবেশ ইত্যাদি বেআইনি ও নিষিদ্ধ ঘোষণা করে।
১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি (৮-ই ফাগুন ১৩৫৮) এ আদেশ অমান্য করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বহু সংখ্যক ছাত্র ও প্রগতিশীল কিছু রাজনৈতিক কর্মী মিলে বিক্ষোভ মিছিল শুরু করেন।মিছিলটি ঢাকা মেডিকেল কলেজের কাছাকাছি এলে পুলিশ ১৪৪ ধারা অবমাননার অজুহাতে আন্দোলণকারীদের ওপর গুলিবর্ষণ করে ।গুলিতে নিহত হন দামাল ছেলে রফিক,সালাম,শফিক,আব্দুল, জব্বার সহ আরোও অনেকে।শহিদের রক্তে রাজপথ রঞ্জিত হয়ে ওঠে।শোকবহ এই ঘটনার অভিঘাতে সমগ্র পূর্ব বাংলায় তীব্র ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে।২১ ফেব্রুয়ারী ছাত্র হত্যা প্রতিবাদে সারা দেশে বিদ্রোহের আগুন দাউ দাউ করে জ্বলে ওঠে।
১৯৫২ সাল,সারা বাংলায় চলেছে একুশের রক্তের প্রতিবাদ,শ্লোগান,গানে,কবিতায়-“আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি
আমি কি ভুলিতে পারি?এই কবিতাতেই প্রথম বাংলাকে উল্লেখ করা হলো একটি দেশ হিসেবে।লেখা হলো অমর একটি নাম “বাংলাদেশে”।এই দিনটিকে পড়ে জাতিসংঘ “আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করেন।
তবে এখন কি বাংলা ভাষার ঐতিহ্য সম্বন্ধে বাঙালীর যে অতীত গৌরব ছিল তা আছে?বাংলা ভাষাটি আদৌও “মোদের গৌরব মোদের আশা আছে?
আমার মনে হয় যত দিন এগিয়ে আসছে ততই বাংলা ভাষার প্রতি আগ্রহ হারাচ্ছে।করপোরেট দুনিয়াতে ঢোকার আগ্রহ সবার মধ্যে বেড়েই চলেছে।বাংলা ভাষা সত্যিই আজ বিপন্ন নিজ দেশে।আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত ছেলে মেয়েরা বাংলা ভাষার চর্চা বেশীর ভাগই করতে আনন্দ পায় না।
ইংরেজি স্কুলগুলোতে পড়াশোনার দৌলতে বিপন্ন তো কিছুটা বটেই ।অনেকের হয়তো বা বাংলা রয়েছে কিন্তু তাতেও তারা বিষয়টিকে বিশেষ গুরুত্ব দেয় না।এক্ষেত্রে মা-বাবা অর্থাৎ অভিভাবকদেরই দোষারোপ করবো।এখন অনেক মা-ই সগর্বে ঘোষণা করেন আমার সন্তান বাংলা জানে না।সম্ভব হলেও অনেক সময় বাংলাটা শেখান না মা বাবারা।সেই ব্রিটিশরা যখন আমাদের দেশ শাসন করতো তখন যে ওদের গোলামী করাটা আমাদের অভ্যাসে পরিণত হয়ে ছিল, সেটা যেন এখনো পরিবর্তন হয় নি।অথচ তথ্য অনুযায়ী পৃথিবীর অনেক দেশেই ইংরেজিতে কথা বলা হয় না।শুধু বাংলায় নয় বরং এখন সব আঞ্চলিক ভাষায় কোন না কোন ভাবে বিপন্ন।এই প্রজন্মের ছেলে-মেয়েরা যখন একসঙ্গে কথা বলে তখন বাংলা থেকে ইংরেজী কিংবা হিন্দিতে কথা বলতেই বেশি পছন্দ করে।সহজে জীবনে প্রতিষ্ঠা লাভের জন্য ইংরেজি মাধ্যমে পড়াশোনা আজ বেড়েই চলছে।ইংরেজি শিক্ষা পদ্ধতি ছাড়া আমাদের আগামী প্রজন্মের অগ্রগতি সম্ভব নয়-এটা আজ খুব সহজ ভাবে উপলব্ধি।কিন্তু মাতৃভাষার প্রতি আমাদের উত্তরসূরিদের আবেগ ও ভালোবাসা তৈরি করা কি আমাদের কর্তব্যের মধ্যে পরে না?এক্ষেত্রে আমি বলবো মা-বাবার দায়িত্ব অনেক,মা-বাবা যদি সন্তানদের শিক্ষিত করে তোলেন এবং মাতৃভাষার প্রতি সন্তানকে শ্রদ্ধাশীল করে তুলতে পারেন তবে অবশ্যই আমাদের মাতৃভাষার অনেক উন্নতি হতে পারে ।
আমরা ছোট ছোট বাচ্চাদের আজ আর,
‘সকালে উঠিয়া আমি মনে মনে বলি,
সারাদিন আমি যেন ভালো হয়ে চলি’।
শেখাই না,আমরা শেখাই ইংরেজি কবিতা।
শিশুকাল থেকেই তাদের আমরা ইংরেজি বিলাসী তৈরি করি।রবি ঠাকুরের ‘মাতৃভাষা মাতৃদুগ্ধ সম’ কথাটা আজকাল আমরাই ভুলতে বসেছি।ছোটদের আর কি দোষ দেব?আমরা মাতৃভাষার অধিকার পেয়েছি রক্তের অক্ষরে।মাতৃভাষা চর্চার মধ্যেই লুকিয়ে আছে আমাদের প্রাণ ভোমরা।আমরা যদি ছোট থেকেই আমাদের বাচ্চাদের ইংরেজি শিক্ষার পাশাপাশি মায়ের ভাষাকে ভালোভাসতে শেখাই,অ-এ অজগর আসছে তেড়ে শেখাই,বাংলা বারো মাসের নাম,ছয় ঋতুর নাম,বাংলা তিথিগুলোর নাম শেখাই,সাতভাই চম্পা,রামায়ণ,মহাভারত,বিশ্ব নবীর কাহিনী,বিষাদ সিন্ধু,কিংবা বাঙলার মনীষীদের পাঠ দি,তবে আশাকরি বাঙালির ইংরেজি প্রীতিতে ভাটা পড়বে না।কারণ বাংলাকে অর্থাৎ মাতৃভাষাকে মনে প্রাণে ভালো না বাসলে যে আমরা নিজের মা-বাবাকে মন খুলে ভালোবাসতে পারবো না।আমার মতে কোন ভাষা শিক্ষা কোন ভাবেই নিন্দনীয় নয়।বরং প্রশংসনীয়।এই পৃথিবীর সঙ্গে তাল মেলাতে ইংরেজি প্রয়োজনীয় রয়েছে অনস্বীকার্য।কিন্তু কোন ভাবেই নিজের মাতৃভাষাকে উপেক্ষা করে নয়।ভাষা তো একটা জাতির পরিচয়।ভাষা হলো পরস্পরের ভাব প্রকাশের মাধ্যম।অন্য ভাষা শিক্ষার মধ্যে কোন অপরাধ নেই।অপরাধ হচ্ছে নিজের মাতৃভাষা কে সম্মান না করা।
আজও আমরা নববর্ষ-এর দিনে আটপৌরে স্টাইলে দামি ঢাকায় শাড়ি জামদানি পড়ি।কপালে বড় টিপ,একটু শাখা সিঁদুর।বাড়িতে বর্ষ পূর্তির দিনে জল খাবারে ফুলকো লুচি আর কালো জিরে,কাঁচা লঙ্কা ফোড়ন দিয়ে সাদা আলুর চচ্চড়ি আর বেগুন ভাজা সেই বাঙালিয়ানায় ফুটে ওঠে আমাদের মধ্যে ।বাংলা ভাষার ব্যবহার এখন পৃথিবীর এক বৃহত্তম জনগোষ্ঠীর দ্বারা ব্যবহৃত ভাষা।পৃথিবীর জন সংখ্যার নিরিখে প্রায় ২৩ কোটি মানুষের মাতৃভাষা
@copyright মেরী খাতুন।

Content Protection by DMCA.com

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here