বন্ধু নিয়ে লেখা “বন্ধু মরে না ”লিখেছেন ওপার বাংলার কবি ও লেখক অ ল ক জা না।

783

বন্ধু মরে না

———————————–
                  অ ল ক জা না

“বন্ধু” শব্দটির ভেতর ভূগোল-বিস্তৃতি আকাশের মতোই সীমাহীন। বহু ভাবনার ব্যাখ্যায় যে সাধারণ ব্যাপারটা উঠে এসেছে তা হলো বন্ধু মানে এক কথায় টক-ঝাল-মিষ্টি। সেই একের মধ্যে বিবিধ স্বাদের ভাণ্ডার হল বন্ধু নামক সম্পর্কের মানুষ। জড়িয়ে থাকা বন্ধনের বিনিসুতোয় আমাদের পরমায়ু কিভাবে যে ফুরিয়ে যায় তা বোঝার উপায় থাকে না। অনেক মন এক আকাশ। আর এক জীবন, বন্ধু অনেক। এভাবেই আমি তুমি আমরা বেঁচে থাকি, বেঁচে যাই পৃথিবী নিশ্চিহ্ন না হওয়া পর্যন্ত বেঁচে যাবো। একটা ভূমিরূপের কাছে এসে দাঁড়ালাম। পাথুরে মাটি জড়িয়ে ধরেছে ছোটো বড় গাছ গাছালির আদর। অদূরে একটা জলাশয়। স্থির স্বচ্ছ জল। তৃষ্ণা নেভালাম। গাছে গাছে পাখির ছড়ানো চঞ্চলতার ভেতর ফুল ও ফল প্রস্তাবের প্রলোভন আমার চোখের দৃষ্টি দখল করল। বুনো ঝোপের আড়ালে নিমেষে হারিয়ে গেল একটা বিষধর সাপ। আমি সামান্য ভয়ের শিকার। তখন দিনের আলো প্রায় বিশ্রামের পথে। এবার ফেরার পালা। হয়তো আবার কখনো স্থির স্বচ্ছ জলের জন্য আসাটাই এবারকার মতো অটুট থাকল। আবার কবে, কখন নির্দিষ্ট করে এ মুহূর্তে বলা যাবে না। তবুও বঙ্কিমচন্দের কপালকুণ্ডলা কাহিনির সেই কথা একবার বলতে ইচ্ছে করছে “যা দেখিলাম জন্ম জন্মান্তরেও ভুলিব না ! “

বহুমাত্রিক বিবিধ রকম বন্ধুত্বের মধ্যে আমার হিসেবে বন্ধু দু ধরণের। আমার উদারতার সুযোগ নিয়ে যে আমাকে ব্যবহার করে। অন্যজন যে আমার উদারতাকে সম্মান করে। দুজনের প্রতি আমার আত্মীয়তা, অস্বীকার করতে পারিনা বলেই হয়ত সযত্নে গচ্ছিত রাখি, ভবিষ্যৎ সঞ্চয়। স্কুল জীবনে পড়াশুনোর জগৎ আমার জন্য অনেকখানি অনিশ্চিত ধোঁয়াশা ছিলো। কিন্তু বইপত্রের প্রতি নিরন্তর ভালোলাগা এবং তার জন্য ভূতের খাটুনি হয়ত, আজ আমাকে উচ্চশিক্ষা-অমরাবতীর বাসিন্দা করেছে। একটু ভালো লেখাপড়ার জন্য একটা বাড়তি পরিচিতি মানে কিছু বন্ধু উপহার দিয়েছিল। আমার সাইকেল ছিল না, তাদের মধ্যে একজনের সাইকেলে যেতাম আর তার বিনিময়ে পরীক্ষার বৈতরণী পারের যথাসাধ্য ব্যবস্থা আমাকে করতেই হতো। এই বোঝাপড়ার মধ্যেও ব্যবস্থাপত্রে একটু রদবদল হলো। স্কুল যাওয়ার সময় সাইকেল সে চালিয়ে নিয়ে যাবে। আর ছুটির পর ক্ষুধাতৃষ্ণার অভিঘাতে বিমর্ষ অবস্থায় সাইকেল চালিয়ে বয়ে নিয়ে আসতে হবে আমাকে। আমি তাও মেনে নিলাম। তখন অনন্যোপায় আমার ছিল না। তাছাড়া মনকষাকষি ব্যাপারটা আমার পোষায় না। তাই পরিস্থিতি সামলে নেওয়ার জন্য নিজেকে প্রস্তুত রাখার বিশেষ গুণ আজকের মতো সেদিনও ছিল। ফলে একটু অসুবিধে হলেও বন্ধুর প্রস্তাবই মঞ্জুর। আমার দুঃসময়ে এটুকু বা কম কী ?

এখন যে যার মতো ব্যস্ত। দাবি চাহিদা চড়াই উৎরাই জীবনকে ক্রমশ জটিল করে তুলেছে। শৈশব কৈশোর যৌবন এবং পরিণত বয়সে এসে বন্ধুত্বের সংজ্ঞা পালটে গেছে। তবুও সেই বন্ধু নামক নস্টালজিয়া সুরে কার না মন উদাস হয়ে যায় ? জীবনের নিদারুণ দৈন্য দশায় কত বেলা এক বন্ধুবাড়ির ভাত আমাকে কবিতা ভাবতে সাহায্য করেছে, সে সব কী ভোলা যায় ? “স্বামী মরে, স্ত্রী মরে, বন্ধু মরে না। ” আমার এক প্রিয় মানুষ প্রিয় কবির একটি কবিতার কয়েকটি শব্দ। যা বন্ধু নামক অন্য কোন পৃথিবীর দিশা দেখায়। কবি সুনীল মাজি। বন্ধু নামক বেহালার সুর জীবনে সর্বাধিক আত্মস্থ করেছেন বলেই হয়ত এমন কথা লিখতে পারেন। যাই হোক এ প্রসঙ্গ বিশ্লেষণ করার জন্য আমার এই নিবন্ধ লেখার উদ্দেশ্য নয়। বন্ধু নামক অন্য পৃথিবীর সুরে অবগাহনের জন্য এই কলম যাপন। বন্ধু ও বন্ধুত্বের জন্য ক্ষয় ক্ষতি এ তো থাকবেই। কিন্তু এর পরেও সেই মানুষের কাছে মানবতার কাছে না ফিরে উপায় কী। তো সব সম্পর্কই মরে ভূত হয়ে যায় কিন্তু বন্ধু সত্যি মরে না। বন্ধুর বয়স বাড়ে না ছায়ারৌদ্র বিদ্যুৎবৃষ্টি আকাশের মতোই চির নতুন প্রাণময়।

প্রতিটি সম্পর্কের ভেতর বন্ধু নামক একটি আলাভোলা শিশুসুলভ স্তর থাকে। বাবা-মা স্বামী- স্ত্রী ছেলে-মেয়ে এমন কী চলমান জীবনযাত্রার মধ্যে কিছু লিখিত অলিখিত ভূমিকাও বন্ধুত্বের আচরণে হাত বাড়িয়ে দিলে আমি ফেরাতে পারি না। আমিও হাত বাড়িয়ে স্বীকার করে নিই তোমার কাছে আমার গুরুত্বের চেয়ে, আমার কাছে তুমি অনেক বেশি দামি। কিংবা আমার জন্য তোমার উপস্থিতি পূর্বনির্ধারিত। সেই নবাগত প্রতীক্ষালয়ে
কাটিয়ে দিতে চাই জীবনের চূড়ান্ত কিছু সুখকর প্রহর। বাজীটা ধরেই নিই। বাঁচবো, বাঁচাবোই তো সেই স্বর্গীয় বন্ধুতীর্থের ত্যাগ তিতিক্ষার আলো। লজ্জা ভয় সংকোচ কেন করবো। সময় অসময় বলে কিচ্ছু হয় না, আমি ডাক দিই সে আসে একাকার হই জলে স্থলে অন্তরীক্ষে। কারণ প্রতিটি দিনই আমার কাছে বন্ধু দিবস। তারপর কবিতার শ্রাবণধারা। তার মুখ তার স্পর্শ আমাকে জাগায় আমাকে সম্পৃক্ত করে, ভাবায় এবং লিখিয়ে নেয় মহাজীবনের গান। কোন দাবি ছিলনা তো তবুও তার জন্য স্বপ্ন সাজিয়ে রাখি। সুখদুঃখ ভাগ করে নিই। হঠাৎ মধ্যরাতে খুম ভেঙে দেখি তার অতল নীরবতা । আমাদের কথা হয় তখনো মানে সেই মুহূর্তে নিঃশব্দে। মননে মজ্জায় । পরের দিনের সংবাদপত্রে জানতে পারি বন্ধুরাষ্ট্রের বুলেটে প্রাণ হারিয়েছেন কয়েকজন সীমান্তরক্ষী। দেশে ঢুকে পড়েছে বিভাজন রেখার ভয়। আমার চোখের ঘুমছুট। মনে হয় ঠিকঠাক কতদিন ভালোকরে কিছু খাওয়া হয়নি। সুজাতার মতো পরমান্ন হাতে সে বন্ধু আসে। তার আসাই নিয়তি ও পূর্বনির্ধারিত।

Content Protection by DMCA.com

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here