লেখক-সুলতানা শিরীন’র নির্বাক অন্তরের গল্প “তৃপ্তি ”

232
সুলতানা শিরীন’র নির্বাক অন্তরের গল্প“তৃপ্তি ”

তৃপ্তি
সুলতানা শিরীন

জব্বার কিছুক্ষণ পরপরই হাঁসের গলায় একটা করে চাপ দেয় আর সুর করে বলে, হাঁস নিবেন হাঁস, হাঁস নিবেন হাঁস। সূর্য তখন মধ্য দুপুর ছুঁই ছুঁই করছে। আমি বারান্দা থেকে পুরো ব্যাপারটি খেয়াল করলাম। হাঁসের উপর এই নির্যাতন আমার সহ্য হলো না। আজ ছুটির দিন, জব্বার সময় এবং দিন হিসেবে গোলমাল করেছে।

ছুটির দিনে পুরুষদের আরাম নেই, সাজসকালেই বউ ঘুম ভাঙিয়ে বাজারের থলে আর লিস্ট হাতে ধরিয়ে দেয়। আমিও বউয়ের হাতে বাজার ধরিয়ে দিয়ে প্রায় ঘণ্টাখানেক হলো বারান্দায় বসে খবরের কাগজ মুখস্থ করছি। টানা কয়েকদিন বৃষ্টির পরে আজ সূর্য মুখ দেখিয়েছে।

পাড়ার গিন্নিদের দুপুরের খাবারের এন্তেজাম এতক্ষণে প্রায় শেষ হওয়ার কাছাকাছি। এই অসময়ে কে হাঁস রাখবে? হাঁস খাওয়ার হ্যাপা অনেক। তবুও হাঁস দেখে আমার চোখ দুটো চকচক করে ওঠে। চোখের সামনে তেলতেলে হাঁস ভুনা আর চালের রুটির প্লেট সামনে এসে হাজির হয়। আহ শব্দ করে চোখ খুলতেই দেখি হাওয়া। জেগে জেগে স্বপ্ন দেখার জন্য নিজেকে তিরস্কার করি। মনে মনে ঘাড়ের উপর একটি মাথা নিয়ে শঙ্কিত হই। নিজেকে সান্ত্বনা দিয়ে বলি, ‘লোভে পাপ পাপে মৃত্যু।’ ঘরের শান্তির কাছে লোভকে বলি দিই।

হাঁসের ডাকে তাকিয়ে দেখি জব্বার মাথা উঁচু করে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। চোখাচোখি হতেই বিরক্তি ঝাড়ি। মনে মনে গাল দিই এই অসময়ে আসার জন্য। শালার ব্যাটা, সারা সকাল ঘুমিয়ে তুই এই দুপুরে এসেছিস হাঁস বেচতে। মনে মনে গজগজ করতে করতে একটা বাজখাই গলায় ধমক দিয়ে উঠি। জব্বার ভ্যাবাচেকা খায়, বলি, হাঁসগুলোর গলা চিপছিস ক্যানরে ব্যটা, মেরে ফেলবি নাকি। আমি জব্বারের হাতে ঝুলে থাকা হাঁসগুলোর দিকে জুলজুল চোখে তাকিয়ে থাকি।

জব্বার ওর কালো পান খাওয়া দাঁত বের করে বলে, স্যার হাঁস তিনটা নিয়া নেন, পানির দরে দিয়া দিমু, সক্কাল থিকা ঘুইরা মাত্র একখান বেচছি, নিয়া নেন স্যার, আমি সব বাইছা কাইটা কুইটা দিয়া যামুনি, নেন স্যার, আমার ঘরের পালা হাঁস।

আমি নিজের লোভ সামলাতে পারি না। কেটে দেয়ার কথায় একটা ঝুঁকি নিয়ে নিই। মনে মনে ভাবি, বউকে খুব চমকে দেয়া যাবে। আবার ভাবি কয়দিন পরে তো কোরবানির ঈদ, বউ কিছুদিন আগেই ওয়ার্নিং দিয়েছে যাতে বেশি মাছ মাংস না কিনি। কী করি কী করি ভাবতে ভাবতে লোভেরই জয় হলো।

জব্বারকে ইশারা দিয়ে খুব আস্তে নিচে গ্যারেজে নেমে যাই। ওকে ডেকে নিয়ে একদম পেছনে চলে যাই যাতে কেউ নিচে নেমে এলে আমাকে দেখতে না পায়। জব্বারকে বলি খুব সুন্দর করে পরিস্কার করে কেটে দিতে। আমরা দুজন মিলে জবাই করি। জব্বার পালক ছাড়িয়ে মাংস কাটতে থাকে।

জানতে চাই পালা হাঁস কেন বিক্রি করছ? ছেলে মেয়ে কয়জন? কী কাজ করো? ইত্যাদি ইত্যাদি।

হঠাৎ মনে হলো জব্বারের মুখে বিষাদের এক ছায়া নেমে এলো। “কন্সট্রাকশন শ্রমিক হিসেবে কাজ করি স্যার। ডেইলি মুজুরি ভিত্তিক। এক ছেলে ও মেয়ে। মেয়ে পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ে ছেলে দ্বিতীয়। প্রতিবার কোরবানির ঈদের আগে কেজি দুয়েক গোরুর মাংস কিনি, কারণ ছেলে গোরুর মাংস খুব পছন্দ করে। ঈদের দিন সরকারি ভাগ পেতে পেতে বিকেল হয়ে যায়। কিন্তু বাচ্চা ছেলে কিছু বুঝতে চায় না। সবার বাড়ি থেকে যখন মাংসের সুঘ্রাণ আসতে থাকে তখন সে মাংসের জন্য খুব কান্না করতে থাকে। এবার বৃষ্টির জন্য কাজ বন্ধ ছিল তাই কোনো টাকা পয়সাও পাইনি। তাই ঘরের পালা হাঁস চারটা বিক্রি করতে নিয়ে আসছি। মেয়েটা আমার কেঁদে বুক ভাসিয়েছে। হাঁসগুলো সে খুব যত্ন করে পালত।”

জব্বারের কথা শেষ হতেই বুকের ভেতর মোচড় দিয়ে উঠল। উপর থেকে গিন্নির খিচুড়ি আর গোরুর মাংসের ঘ্রাণ নাকে এসে লাগে। কিন্তু কেন যেন এই ঘ্রাণটা অন্যদিনের মতো এনজয় করতে পারলাম না। চোখের সামনে নিজের ছেলে মেয়ে দুটোর মুখ ভেসে উঠল। হাঁসগুলোর জন্য নাকি জব্বারের মেয়ের জন্য, ঠিক জানি না, বুকে একটা চিনচিনে ব্যথা অনুভব করলাম।

আমি হাঁসগুলো প্যাকেট করে উপরে নিয়ে খুব নিঃশব্দে ফ্রিজে ঢুকিয়ে রাখি। হাঁসের দাম নিয়ে নিচে নামি। জব্বারের হাতে টাকা দিতেই ওর চোখ ছলছল করে ওঠে। আমার হাত ধরে বলে, ” স্যার আপনি আমারে বাঁচাইলেন, হাঁস বেচতে না পারলে আজ না খাইয়া থাকতে হইতো।” আমি জব্বারের হাতে চাপ দিয়ে সান্ত্বনা দিই। ওর হাতে কিছু টাকা দিয়ে বলি, হাঁস বিক্রির টাকা দিয়ে মেয়েকে হাঁস কিনে দিতে। আর এই টাকাটা দিয়ে ঈদের জন্য মাংস ও অন্যান্য জিনিস কিনে নিতে। জব্বার মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকে। আমি ওকে বলি, তোমার মতো আমিও একজন বাবা। এটা দান নয়, উপহার হিসেবে নাও তোমার বাচ্চাদের জন্য।

জব্বার চোখ মুছতে মুছতে চলে যায়। খাবার টেবিলে সেদিন এত স্বাদ যে কোথা থেকে এল! ইচ্ছে করছিল গিন্নির হাত দুটোতে চুমু খাই। কিন্তু পরক্ষণেই হাঁসের কথা মনে হতেই চুপসে যাই। অপেক্ষা করতে থাকি বোমা ফাটার। এ এক ভয়ানক অপেক্ষা!

Content Protection by DMCA.com

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here