আল্লাহর সান্নিধ্য লাভের উপায়
শারমিন সিদ্দিকী
একজন মুসলিম নারী হিসেবে ইসলাম সম্পর্কে গভীর জ্ঞান আমার নেই। কিন্তু মনটা সবসময় আল্লাহর সান্নিধ্য লাভে ব্যাকুল থাকে। তাই মাঝে মাঝে আল্লাহ, সৃষ্টি, ধর্ম ইত্যাদি বিষয় নিয়ে ভাবি এবং ঈমান- আমলের মাধ্যমে আল্লাহর সান্নিধ্য লাভের চেষ্টা করি। কিন্তু এখনও ঐ পর্যন্ত পৌঁছাতে পারিনি। তবু্ও আমার ক্ষুদ্র জ্ঞান দিয়ে যতটুকু বুঝতে পারি বা উপলব্ধি করি তাই আজ উপস্থাপন করতে চেষ্টা করছি।
আমরা সবাই জানি এই বিশ্ব ব্রম্মান্ডের সৃষ্টিকর্তা, অধিপতি, মালিক একমাত্র আল্লাহ। হ্যাঁ আল্লাহ। যার কোন আকার নেই, ঘুম নেই ক্ষুধা নেই আসমান- জমিন সর্বত্রই যার জ্ঞাত। এমনকি সমস্ত সৃষ্টিকূলের অন্তরের ভিতরের খবরও তিনি জানেন। এমনকি ক্ষুদ্র প্রাণী পিপড়া থেকে শুরু করে বিশাল সমুদ্রের তলদেশে পাথরের গায়ে যে শ্যাওলা আছে তারও রিজিক তিনি নির্ধারণ করেন। এই দুনিয়া সৃষ্টির ভেদ, রহস্য আমরা কেউই ভালোভাবে জানিনা। যদি জানতাম তাহলে হতাশায় বুক চাপড়াতাম না। আসলে কোন মাখলুকাতেরই কোন সাধ্য নেই কোন কিছু অর্জন করা, যতক্ষণ পর্যন্ত না আল্লাহ দেন। আমরা নির্বোধ মানুষেরা সেটা কখনোই উপলব্ধি করতে পারি না। তবে হ্যাঁ, আমরা যা পেয়ে থাকি, পাই বা অর্জন করি তা কিন্তু আল্লাহ পাক সরাসরি দেন না। কোন না কোন মাধ্যমে দেন। যাকে সাধারণ ভাষায় উছিলা বলা হয়।
এখন মূলকথায় আসা যাক, আল্লাহ আছেন। আমাদের মাঝে সর্বক্ষণ, সদা জাগ্রত আছেন এবং সবকিছু দেখেন। আল্লাহ আছেন এটা কীভাবে বুঝব বা অনুভব করব? আমরা সবাই ইসলামের শরীয়ত মেনে চলার চেষ্টা করি। শরীয়তের বাইরে এক বিন্দু পরিমান ত্রুটি দেখা গেলে সেটাকে আমরা বিদাত বলি। এই বিদাত শব্দের অর্থ কী? সেটাও মনে হয় আমাদের গোচরে নয়। আমি যেটা বুঝি সেটা হচ্ছে বর্জন বা বাইরে। মানে ইসলামের বিধানের বাইরের অংশ। শরীয়ত -শরীয়ত করেই আমরা জীবন পার করে দেই। শরীয়তের বাইরেও আরও স্তর আছে। যা কিনা শরীয়ত ঠিক রেখে অর্জন করতে হয়। সেগুলো হলো – শরীয়্য,তরীকত,মারেফাত ও হকীকত। কোন মুমিন নর বা নারী এ স্তরগুলি অতিক্রম করতে পারলেই আল্লাহর সান্নিধ্য লাভ সম্ভব।
কথা হচ্ছে, এতো গুলো স্তর অতিক্রম করতেতো অনেক সময় ও সাধনার ব্যাপার। তাহলে কি করে সম্ভব?
ইসলামের বিধান অনুযায়ী ইবাদতের কিছু শ্রেণি বিন্যাশ আছে। যেমন – ফরজ ,সুন্নত, ওয়াজিব ও নফল। প্রথমে আসি ফরজ কী? ফরজ হচ্ছে সরাসরি আল্লাহর হুকুম পালন করা। যা কিনা প্রত্যেক মুসলমানদের জন্য বাধ্যতামূলক। করতেই হবে। যেমন অফিসে নিয়মের বাইরে ছুটি কাটালে বেতন কাটা যায়, ঠিক তেমনি ফরজ আদায় না করলে শাস্তি পেতে হয়।ফরজের মধ্যেও বিভিন্ন প্রকারভেদ আছে। এবার আসি সুন্নত কী? সুন্নত হচ্ছে আমাদের সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ নবী -রাসুল হযরত মুহাম্মদ (স) কে অনুসরণ করা। সেটা নামাজ, পোশাক- আশাক,খাওয়া -দাওয়া, চলাফেরা ইত্যাদি। সুন্নত পালন করলে হযরত মুহাম্মদ (স) এর সন্তুষ্টি ও মহব্বত অর্জন করা যায়। আর রাসুল (স) এর সন্তুষ্টি মানেই আল্লাহর সন্তুষ্টি। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে সুন্নতকে ফরজের মতোই পালন করা হয় যেমন – ফজর ও জোহরের নামাজে সুন্নত বাদ দেয়া যায় না। আবার এশার চার রাকাত ফরজের পরে দুই রাকাত সুন্নত বাদ দেয়া যায় না। এখন আসি ওয়াজিব এ। ওয়াজিব আদায় করলে অনেক সওয়াব, আর না করলেও গুনাহ হবেনা। তার মানে হচ্ছে যদি ওয়াজিব আদায় করা হয় তাহলে লাভ আছে কিন্তু না করলে কোন ক্ষতি নেই। কোন কোন ক্ষেত্রে ওয়াজিব কে ফরজের পরেই স্থান দেয়া হয়েছে। এবার আসি নফল ইবাদতে। নফল আদায় করলে অনেক অনেক অনেক গুন সওয়াব আর আদায় না করলেও বিন্দু পরিমাণ ক্ষতি নেই। তাই আমরা অনেকেই নফল বাদ দিয়েই চলার চেষ্টা করি। আমরা এই ভেদটা জানিনা যে নফল ইবাদতই আল্লাহর সান্নিধ্য লাভের সেতু। নফল ইবাদত হচ্ছে নির্দিষ্ট সময় ও শ্রমের পরে ওভার টাইম কাজের মতো। যতো অতিরিক্ত শ্রম দিবে, ততো বেশি লাভবান হবে। এখানেও ঠিক তা-ই। যতো বেশি নফল ইবাদত করা যাবে, ততো বেশি আল্লাহর সান্নিধ্য লাভের সেতু মজবুত হবে।
আমরা অনেকেই বলি আগে ফরজ আদায় করো, পরে নফল নিয়ে টানাটানি করো। কিন্তু আমরা নির্বোধ মানুষেরা বুঝি না যে, ভালো কিছু পেতে হলে আমাদের অতিরিক্ত সার্ভিস দিতে হবে।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, নফল ইবাদত গুলো কী? নফল ইবাদত হচ্ছে ফরজ রোজার বাইরে রোজা রাখা, নফল নামাজ পড়া, আল্লাহর পবিত্র নামগুলো বেশি বেশি জিকির করা, অসহায়ের পাশে দাড়ানো,দান- ছদকা করা, মোরাকাবা ইত্যাদি। আর এই মোরাকাবার মাধ্যমেই আল্লাহর সান্নিধ্য লাভ সম্ভব হয়। অনেকেই বলতে পারেন, মোরাকাবা কী? মোরাকাবা হচ্ছে আল্লাহর ধ্যান। ইংরেজিতে যাকে আমরা মেডিটেশন বলি। ধ্যানের মাধ্যমে আল্লাহকে যদি অন্তরে প্রতিষ্ঠা করতে পারেন, তবেই বুঝতে পারবেন আপনি কতোটা আল্লাহর সান্নিধ্য লাভ করতে পেরেছেন। আল্লাহর সান্নিধ্য লাভের যে স্বাদ,সুধা, তৃপ্তি পৃথিবীর অন্য কোন কিছুতেই তা পাওয়া যায় না। আর এই স্বাদ যদি একবার কেউ পেয়ে থাকে তাহলে সে জান্নাত বস জাহান্নামের চিন্তা করবে না। সে এক আল্লাহকে পাওয়ার জন্য ব্যাকুল হয়ে যাবে। আল্লাহর প্রেমে মত্ত হয়ে যাবে। উদাহরণ স্বরূপ ছোট্ট একটা ঘটনা উপস্থাপন করি।
রাবেয়া বসরী নামে এক মুসলিম নারী ছিলেন। যিনি আল্লাহর ধ্যানে সদা মশগুল থাকতেন। একদিন তার ভাই লক্ষ্য করলো যে — তার বোন গভীর রাতে ইবাদতের পর ঘর থেকে বের হয়ে যায়। স্বাভাবিক ভাবেই ভাইয়ের মনে খটকা লাগলো, আমার বোন এতো ধার্মিক, পরহেজগার সে কেন গভীর রাতে বাইরে গেল? বাইরে তার কী এমন কাজ? একদিন রাতে ভাই তার বোনের পিছনে পিছনে গেল। গিয়ে দেখে তার বোন খোলা জায়গায় আকাশের দিকে তাকিয়ে দুই হাত তুলে কি যেন পান করছে। ভাই তার বোনকে জিজ্ঞেস করলো — “বোন তুমি কি পান করছ?” বোন উত্তরে বলল– ” ভাই এ এক অমৃত সুধা যা স্বয়ং আল্লাহ আমাকে দেন আর আমি তা তৃপ্তি দিয়ে পান করি বোনের এই কথা শুনে ভাই বলল, তাহলে আমাকেও একটু দাও আমি খেয়ে দেখি? বোন বললেন তুমি কি এটা সহ্য করতে পারবে? ভাই বলল আমি যদি তোমার ভাই হয়ে থাকি তবে নিশ্চয়ই পারব। ভাইও পান করলো এবং বিশ্ময় ভাবে বোনের দিকে তাকিয়ে
বললো — “এ এমন অমৃত সুধা যে,আমি জীবনেও কখনো এর স্বাদ পাইনি। আমি তোমাকে ভুল বুঝে ছিলাম। আমাকে ক্ষমা করো।”
রাবেয়া বসরী ও তার ভাইয়ের এই ঘটনা থেকে বুঝা যায় যে, ঈমান – আমলে চেষ্টা করলেই আল্লাহর সান্নিধ্য লাভ করা সম্ভব।