দৈনিক আলাপ ওয়েবডেস্ক : ঢাকা মহানগরীর ড্রেনেজ ব্যবস্থাপনা, বৃষ্টির পানি নিষ্কাশন ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় সমন্বয়ের ঘাটতিতে সৃষ্ট জলাবদ্ধতা নিরসনে ঢাকা ওয়াসা, দুই সিটি করপোরেশনসহ দায়িত্বপ্রাপ্ত সংশ্লিষ্ট সবগুলো প্রতিষ্ঠানই ব্যর্থ হয়েছে বলে জানিয়েছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)।
টিআইবি মনে করে, অন্যের কাঁধে দোষ চাপিয়ে নির্দিষ্ট কোনো প্রতিষ্ঠানেরই এই ব্যর্থতার দায় অস্বীকারের সুযোগ নেই। তাই দায়িত্ব পালনে অবহেলার দায় অন্যের উপর না চাপিয়ে সংকট সমাধানে এককভাবে সিটি করপোরেশনকেই এই দায়িত্ব দেওয়া জরুরি।
কার্যত ভিন্ন ভিন্ন প্রতিষ্ঠানের (ঢাকা ওয়াসা, ঢাকা সিটি করপোরেশন ও পানি উন্নয়ন বোর্ড) হাতে ড্রেনেজ ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব থাকায় এবং এর ফলে সমন্বয়হীনতার, অসুস্থ প্রতিযোগিতা ও পারস্পরিক দোষারোপের সংস্কৃতিতে জলাবদ্ধতা সমস্যা প্রকট আকার ধারণ করেছে বলেও জানিয়েছে সংস্থাটি।
আজ রোববার এক বিবৃতিতে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘আইন অনুযায়ী ঢাকা মহানগরীতে প্রধান ড্রেন লাইনগুলো নির্মাণ ও রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব ঢাকা ওয়াসার এবং শাখা লাইনগুলোর দায়িত্ব সিটি করপোরেশনের ওপর ন্যস্ত। ঢাকা শহরের মোট ড্রেনেজ লাইনের মধ্যে ৩৮৫ কিলোমিটার ঢাকা ওয়াসার অধীনে এবং প্রায় ২ হাজার ৫০০ কিলোমিটার ঢাকা সিটি করপোরেশনের অধীনে। এর বাইরে ৭৪ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে ২৬টি খাল ও ১০ কিলোমিটার বক্স কালভার্টের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বও ঢাকা ওয়াসার। আইনের এই মারপ্যাঁচে বর্ষায় সৃষ্ট জলাবদ্ধতা নিরসনে একে অন্যের ওপর দায় চাপিয়ে নিজেদের দায়িত্ব এড়াতে চায় প্রতিষ্ঠানগুলো। এতে বর্ষা এলেই জনগণের ভোগান্তি বছর বছর আরও তীব্র হয়।’
তিনি বলেন, ‘অবিলম্বে আইনের প্রয়োজনীয় সংশোধন করে একক প্রতিষ্ঠানের হাতে সম্পূর্ণ ড্রেনেজ ব্যবস্থাপনা, পয়ঃনিষ্কাশন খাল ও কালভার্ট রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব প্রদান করতে হবে। এক্ষেত্রে নাগরিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে দুই সিটি করপোরেশনকেই এই দায়িত্ব প্রদান করা উচিত এবং তাদের হাতেই এক্ষেত্রে ওয়াসার এখতিয়ারভুক্ত কাজের পরিবীক্ষণের দায় থাকা উচিৎ।’
জলাবদ্ধতা নিরসনে অর্পিত দায়িত্ব পালনে বিগত বছরগুলোতে ঢাকা ওয়াসা কার্যত ব্যর্থ হয়েছে মন্তব্য করে নির্বাহী পরিচালক বলেন, ‘ঢাকা ওয়াসার একটি প্রতিবেদনে তাদের আওতাধীন ২৬টি খালের মধ্যে ২০টির প্রবাহ পূর্ণ সচল দাবি করা হয়। এর মধ্যে কাটাসুর খালকেও সচল উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু টিআইবির গবেষণায় দেখা যায়, উল্লিখিত খালের প্রবাহ সচল নেই। বিভিন্ন কঠিন বা ভারী বর্জ্য ড্রেনের উপরিভাগ এবং খালের মুখে জমে রয়েছে, যা চিত্রসহ গবেষণা প্রতিবেদনে তুলেও ধরা হয়। এ ছাড়া, গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্যেও দেখা যায় সর্বশেষ (২০১৯-২০) অর্থবছরে ঢাকা ওয়াসার ২৬টি খালের মধ্যে অন্তত ১০টিতে কার্যত পুনঃখনন ও পরিষ্কারের কাজ করা হয়নি।’
ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘ওয়াসার আওতাধীন খাল ও ড্রেনেজ ব্যবস্থার উন্নয়ন ও রক্ষণাবেক্ষণে নিয়মিত তদারকির ঘাটতিও লক্ষণীয়। সংশ্লিষ্ট বিভাগের কর্মকর্তাদের প্রতি মাসে কমপক্ষে দুবার খাল ও ড্রেন পরিদর্শনের নিয়ম থাকলেও তা করা হয় না। ফলে খাল দখল, খালের মধ্যে অবৈধ স্থাপনা নির্মাণসহ বিভিন্নভাবে খাল ভরাট হয়ে থাকে। তাই ওয়াসার ব্যর্থতা অস্বীকারের কোনো সুযোগই নেই। আবার ওয়াসার ওপর এককভাবে সব দোষ চাপিয়ে ড্রেনেজ অব্যবস্থাপনা ও বর্জ্য অপসারণে ব্যর্থতার দায় সিটি করপোরেশনও কোনোভাবেই এড়াতে পারে না।’
টিআইবির গবেষণালব্ধ তথ্য অনুযায়ী ওয়াসা তার দায়িত্বে থাকা খাল ও ড্রেনগুলো রক্ষণাবেক্ষণ ও দখলমুক্ত করতে ব্যর্থ হয়েছে এ কথা যেমন সত্য, তেমনি এই খাল ও ড্রেনগুলোতে পতিত কঠিন বর্জ্য অপসারণের পর সেগুলো পাড় থেকে অপসারণ না করে ওয়াসার ওপর দায় চাপানোর নজিরও সিটি করপোরেশনের আছে। আবার সিটি করপোরেশনের অধীনে যে প্রায় ২ হাজার ৫০০ কিলোমিটার ড্রেন আছে, সেগুলোও কতটা বর্জ্যমুক্ত বা সচল সেটাও প্রশ্নবিদ্ধ।
বিশেষ করে বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় সমন্বিত ও কার্যকর কোনো পদ্ধতি গড়ে তুলতে ব্যর্থ হওয়ায় যত্রতত্র ময়লা আবর্জনা ফেলা, ড্রেনগুলোর সংস্কারকাজে অযথা সময়ক্ষেপণ এবং নিয়মিত পরিচ্ছন্ন না করা, নাগরিকদের মাঝে সচেতনতা সৃষ্টিতে ব্যর্থতা ইত্যাদি বিষয়ে সিটি করপোরেশনের দায় এড়ানোর কোনো সুযোগ নেই। বিদ্যমান আইন অনুযায়ী ড্রেনেজ সম্পর্কিত যেকোনো সংস্কারের ক্ষেত্রে ঢাকা ওয়াসার সঙ্গে সমন্বয়ের কথা থাকলেও, সিটি করপোরেশন ড্রেন কিংবা বৃষ্টির পানি নিষ্কাশনের নালা নির্মাণের ক্ষেত্রে বাস্তবে তা অনুসরণ করে না। আবার সিটি করপোরেশন কর্তৃক উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডের ফলে ঢাকা ওয়াসার কোনো ড্রেনের ক্ষতি হলেও সে বিষয়ে ঢাকা ওয়াসাকে অবগত করে না। এর ফলে কোনো প্রতিষ্ঠানেরই কাজের পূর্ণ সুফল জনগণ ভোগ করতে পারে না।
ঢাকা মহানগরীর জলাবদ্ধতা নিরসনের লক্ষ্যে স্থানীয় সরকার বিভাগ কর্তৃক ২০১৮ সালের মে মাসে ‘ঢাকা মহানগরীর জলাবদ্ধতা নিরসনে অপারেশনাল/অ্যাকশন কমিটি’ শীর্ষক একটি কমিটি গঠিত হয়। এ কমিটির অন্যতম কাজ নির্ধারণ করা হয় জলাবদ্ধতা নিরসনে বিদ্যমান খাল-ড্রেন অবৈধ দখলমুক্ত, পরিষ্কার, খনন ও পুনঃখনন কার্যক্রম পর্যালোচনা করা। কিন্তু সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে সমন্বয়হীনতার কারণে এ কাজগুলো বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি। তাই এই সমন্বয়হীনতার জাল ছিন্ন করতেই সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রের বিশেষজ্ঞদের সম্পর্কিত করে প্রণীত সুনির্দিষ্ট কৌশল অনুযায়ী ঢাকা মহানগরীর জলাবদ্ধতা নিরসনের সার্বিক দায়িত্ব একক প্রতিষ্ঠানের কাছে ন্যস্ত করতে হবে বলে মনে করছে টিআইবি।