দৈনিক আলাপ ওয়েবডেস্কঃ উজানের ঢলে দুধকুমার নদের পানি বিপদসীমা অতিক্রম করার পর ধরলা নদীর পানিও বিপদসীমা অতিক্রম করেছে। ফলে কুড়িগ্রামে নদী তীরবর্তী নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হয়ে কয়েক হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। নাগেশ্বরীতে দুধকুমার নদের বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ উপচে অন্তত পাঁচটি গ্রামে পানি প্রবেশ করছে বলে খবর পাওয়া গেছে।
শুক্রবার (১৪ জুলাই) সকাল ৯টায় পাটেশ্বরী পয়েন্টে দুধকুমার নদ বিপদসীমার ৫০ সেন্টিমিটার এবং সেতু পয়েন্টে ধরলার পানি বিপদসীমার ৯ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল বলে জানিয়েছে পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো)।
পাউবো নিয়ন্ত্রণ কক্ষ জানায়, জেলার প্রধান নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। বৃহস্পতিবার সকাল ৯টা থেকে শুক্রবার সকাল ৯টা পর্যন্ত গত ২৪ ঘণ্টায় দুধকুমার নদের পানি পাটেশ্বরী পয়েন্টে ৪২ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পেয়ে বিপদসীমার ৫০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। ধরলার পানি সদরের সেতু পয়েন্টে ৬৪ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পেয়ে বিপদসীমার ৯ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। একই সময়ে ব্রহ্মপুত্রের পানি নুন খাওয়া পয়েন্টে ৩৬ সেন্টিমিটার, চিলমারী পয়েন্টে ২৯ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পেয়ে বিপদসীমার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। বাড়ছে তিস্তার পানিও।
পাউবোর পূর্বাভাস অনুযায়ী আগামী ছয়দিন পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থেকে ব্রহ্মপুত্র নদের পানি চিলমারী পয়েন্টে বিপদসীমায় পৌঁছাতে পারে। এতে জেলার উলিপুর ও চিলমারী উপজেলার চরাঞ্চলসহ নদ নদী তীরবর্তী এলাকায় বন্যা পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে। তবে পূর্বভাসের চেয়ে দ্রুততার সঙ্গে সবকটি নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় বন্যা পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়ে তীরবর্তী হাজারো মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। অনেকে বাড়িঘর ছেড়ে নৌকায় আশ্রয় নিয়েছেন। কেউ কেউ নিরাপদ আশ্রয়ের উদ্দেশে বসতবাড়ি ত্যাগ করছেন বলে খবর পাওয়া গেছে।
অব্যাহত পানি বৃদ্ধির ফলে সদরের পাঁচগাছী, যাত্রাপুর, হলোখানা ও ভোগডাঙা ইউনিয়ন, উলিপুর উপজেলার বেগমগঞ্জ ও সাহেবের আলগা ইউনিয়ন; দুধকুমার অববাহিকার ভূরুঙ্গামারী উপজেলার আন্ধারীরঝাড় ইউনিয়ন, নাগেশ্বরী উপজেলার রায়গঞ্জ, বল্লভের খাস, নারায়ণপুর, নুনখাওয়া ও বামনডাঙা ইউনিয়নের নিম্নাঞ্চলের বাড়িঘরে পানি প্রবেশ করে হাজারো মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। অব্যাহত পানি বৃদ্ধির ফলে প্লাবিত এলাকার পরিধি বাড়ছে। এ অবস্থায় পরিস্থিতি অবনতির আশঙ্কা করছেন নদ-নদী তীরবর্তী বাসিন্দারা।
দুধকুমার নদের পানি বৃদ্ধি পেয়ে নাগেশ্বরী উপজেলার বামনডাঙা ইউনিয়নের মুরিয়া ও আনসার হাট এলাকায় একটি বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ উপচে কয়েকটি গ্রামে পানি প্রবেশ করতে শুরু করেছে। তবে পাউবো বলছে, সেটি তাদের কোনও বাঁধ নয়। একটি গ্রামীণ সড়ক। এর আগে সড়কটির ঢালু অংশে জিও ব্যাগ ফেলে সেটি রক্ষার চেষ্টা করলেও নদের পানি বাড়ায় তা উপচে গেছে জানিয়েছেন পাউবো কুড়িগ্রামের নির্বাহী প্রকৌশলী আব্দুল্লাহ আল মামুন।
স্থানীয়রা বলছেন, বাঁধটি উপচে যাওয়ায় সেনপাড়া, ধনিটারি, নামাহাইল্লা ও তেলিপাড়াসহ কয়েকটি গ্রামে পানি প্রবেশ করতে শুরু করেছে। পানির চাপে যেকোনও সময় বাঁধটি ভেঙে যেতে পারে।
কুড়িগ্রাম সদরের হলোখানা ইউনিয়নের সারডোবের বাসিন্দা নুর মোহাম্মদ বলেন, ‘শুধু পানি আর পানি। এমন করে পানি বাড়লে ১৭ সালের বান্যার মতো হবে।’
নাগেশ্বরী উপজেলার রায়গঞ্জ ইউনিয়নের ফাঁন্দেরচর গ্রামের চন্দ্রবানু বলেন, ‘আইজ তিন দিন থাইকা ঘরেত পানি। অহন আর থাহা যাইতেছে না। সবকিছু লইয়া উঁচা জায়গায় যাই। নাইলে পানিতে ডুইবা মরণ লাগবো।’ বাড়ির লোকজনসহ গরু ও হাঁস নিয়ে পাশের গ্রামের একটি ঈদগাহ মাঠে আপাতত আশ্রয় নেবেন বলে জানান চন্দ্রবানু ও তার স্বামী মেহের জামাল।
শুধু চন্দ্রবানু-মেহের জামালের পরিবার নয়, ফান্দেরচর গ্রামসহ কয়েকটি ইউনিয়নের অনেক পরিবার নিরাপদ আশ্রয়ের দিকে ছুটছেন।
শুক্রবার সকালে জেলা প্রশাসনের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা শাখা জানায়, এখনও উপজেলা পর্যায় থেকে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ও পানিবন্দি পরিবারের সংখ্যা জানা যায়নি। তবে প্রতিবেদন তৈরির কাজ চলছে। বিকাল নাগাদ প্রতিবেদন পাওয়া যেতে পারে। এরপরই সরকারিভাবে সহায়তা বরাদ্দ ও বিতরণের ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
নাগেশ্বরী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) আহমেদ সাদাত বলেন, ‘উপজেলার কয়েকটি ইউনিয়নের নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। বেশ কিছু বাড়িঘরে পানিও প্রবেশ করেছে। উদ্ভূত পরিস্থিতি মোকাবিলায় আমরা প্রস্তুত রয়েছি। ক্ষতিগ্রস্থদের তালিকা করা করা হচ্ছে।’
জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ সাইদুল আরীফ বলেন, ‘সম্ভাব্য বন্যা মোকাবিলায় জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে সর্বাত্মক প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। আমরা প্রয়োজনীয় শুকনো খাবার মজুদ এবং আশ্রয়কেন্দ্র ও প্রয়োজনীয় নৌকা প্রস্তুত রেখেছি। পশু খাদ্য যেন ঘাটতি না হয় সে প্রস্তুতিও নেওয়া হয়েছে। সর্বোপরি আমরা প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি রেখেছি।’
পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, ‘নদ-নদীর পানি বাড়ছে। ধরলা ও দুধকুমার বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। পানি আরও বাড়বে। পূর্বাভাস অনুযায়ী ব্রহ্মপুত্র নদের পানি বৃদ্ধি পেয়ে আগামী ১৮-১৯ জুলাই বিপদসীমার কাছাকাছি পৌঁছাতে পারে। এতে নিম্লাঞ্চলে স্বল্পমেয়াদি বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে। এরপর পানি দ্রুত নেমে যাওয়ার পূর্বাভাস রয়েছে।’