দৈনিক আলাপ খেলাধুলা ডেস্ক : আবেগ সামলানোর চেষ্টা করেন তিনি প্রানপণ। পারেন না। প্রিয় খেলনা হারিয়ে ফেলা শিশুর মতো কাঁদেন; কাঁদতেই থাকেন। চোখ মোছার টিস্যু ভিজে চুপচুপে হয়ে যায়; চোখের দুঃখী জল তবু ফুরোয় না। ফুরিয়ে যায় কেবল বার্সেলোনার সঙ্গে লিওনেল মেসির ২১ বছরের এক আশ্চর্য প্রেমের গল্প।
মেসি আর বার্সেলোনায় থাকছেন না — এই খবর দুনিয়াজোড়া আছড়ে পড়ে দিন তিনেক আগে। শান্ত সমুদ্রে হঠাৎ তীব্র জলোচ্ছ্বাসের মতো। প্রথমে তাই অবিশ্বাস। এরপর স্তব্ধতা।
বার্সেলোনার প্রেসিডেন্ট হুয়ান লাপোর্তা সংবাদ সম্মেলন করে জানান, ক্লাব ও মেসি নতুন চুক্তিতে পৌঁছলেও কেন তাঁকে ধরে রাখা গেল না। সাবেক এবং সদ্যই সাবেক হয়ে যাওয়া সতীর্থরা ভালোবাসা-কৃতজ্ঞতা-গৌরবের কথা জানান ফেসবুক, টুইটার, ইন্সটাগ্রামে। ক্লাবের সর্বকালের সেরার সঙ্গে ড্রেসিংরুম শেয়ার করেছেন, এর চেয়ে গৌরবের আর কী হতে পারে তাঁদের জন্য!
মেসি চুপ করে ছিলেন তখনো। একেবারে চুপ। এমন হুট করে বিদায়টা সহ্য করতে পারছিলেন না বলেই হয়তো-বা!
অবশেষে, ক্লাবের ঘোষণার তিন দিন পর, আনুষ্ঠানিক বিদায়ের সংবাদ সম্মেলনে এলেন তিনি। সেখানে শুধু সাংবাদিকরাই নন, ছিলেন বার্সেলোনার বর্তমান ফুটবলাররাও। ক্লাবের কর্মকর্তারা। কথা শুরুর আগেই কান্নায় ভেঙে পড়েন মেসি। সংবাদ সম্মেলন কক্ষের সবাই তখন দাঁড়িয়ে করতালিতে কুর্নিশ জানাচ্ছেন মহাকালের ফুটবল জাদুকরকে।
কী তুমুল বিষাদের অর্কেস্ট্রা বেজে ওঠে ওই ছোট্ট রুমটিতে! যা চার দেয়ালের সীমানা পেরিয়ে ছুঁয়ে যায় পৃথিবী নামক গ্রহের প্রতিটি ফুটবলপ্রেমীর হৃদয়।
নিজেকে সামলে মেসি জানান তাঁর আবেগে মাখা অনুভূতি। বলেন, ‘আমি যে কী বলব, সেটিই এ কদিন ধরে ভেবেছি। কিন্তু সত্যটা হচ্ছে, আমি কিছু ভাবতে পারছি না। এখানে আমি আমার সারা জীবন কাটিয়েছি। চলে যাওয়ার জন্য মোটেই প্রস্তুত ছিলাম না। গত বছর ভীষণ গোলমেলে অবস্থায় আমি চলে যেতে চেয়েছিলাম। কিন্তু এ বছর আমি ও আমার পুরো পরিবার নিশ্চিত ছিলাম যে, আমরা বার্সেলোনায় থাকছি। সব কিছুর চেয়ে এটাই চেয়েছিলাম সবচেয়ে বেশি করে। কিন্তু আজ আমাকে বিদায় বলতে হচ্ছে। ১৩ বছর বয়সে এ শহরে এসেছিলাম আমি। ২১ বছর পর আমার স্ত্রী এবং কাতালান-আর্জেন্টাইন তিন সন্তান নিয়ে চলে যাচ্ছি। আমার অনুভূতির সবটা তাই বুঝিয়ে বলাটা অসম্ভব।’
আসলেই তো, সবটা কিভাবে বলবেন মেসি? ওই যে শরীরে হরমোনজনিত সমস্যার কারণে যখন তাঁর ব্যয়বহুল চিকিৎসা করানোর সামর্থ্য ফুরিয়ে যায় পরিবারের; যখন কোনো ক্লাব সে খরচ চালিয়ে যেতে চায়নি, তখন তো ১৩ বছরের ছেলেটির ওপর ঠিকই আস্থা রেখেছিল বার্সেলোনা!
সে আস্থার প্রতিদান সুদে-আসলে বার্সেলোনাকে ফিরিয়ে দেন মেসি। ক্লাবের ইতিহাসের সফলতম সময়ের সারথী হয়ে।
বার্সার একাডেমী ‘লা মেসিয়া’তে যোগ দেবার বছর চারেক পর মূল দলে মেসির পথচলা শুরু; ২০০৪ সালে। বার্সেলোনায় তখন আরেক জাদুকর রোনালদিনহোর রাজত্ব। এই ব্রাজিলিয়ান জিতলেন বিশ্বসেরা খেলোয়াড়ের মুকুট। কিন্তু সে পুরষ্কার নিয়ে রোনালদিনহো ঘোষণা দেন, ‘আমাকে যে বিশ্বসেরা খেলোয়াড়ের পুরষ্কার দেয়া হচ্ছে, আমি তো বার্সেলোনারই সেরা নই। আমাদের সেরা ফুটবলার লিও’।
তখন বাড়াবাড়ি মনে হয়েছিল। আর এখন রোনালদিনহোকে মনে হয় ফুটবল-জ্যোতিষী। মেসি যে একদিন সর্বজয়ী হবেন, সেটি তো তিনি বুঝতে পেরেছিলেন মেসির ক্যারিয়ারের শৈশবেই!
এরপর রূপকথার মতো মেসির এগিয়ে চলা। রাইকার্ড-রোনালদিনহোর পর গার্দিওলা-মেসির জুটি। চ্যাম্পিয়নস লিগ, লা লিগার শিরোপা শোভা বাড়ায় বার্সেলোনা ট্রফিকেসে। বিশ্বসেরার স্বীকৃতিতে ফিফা বর্ষসেরা, ব্যালন ডি’অর লুটোতে থাকে মেসির জাদুকরী বাঁ পায়ে।
স্বর্ণালি সাফল্যের চারটি মৌসুম শেষে কোচ গার্দিওলা চলে যান। তিতো ভিলানোভা, জেরার্দো মার্তিনো, লুইস এনরিকে, এর্নেস্তো ভালভারদে, কিকে সেতিয়েন, রোনাল্দ কুমান — কত কোচ এলেন-গেলেন! ধ্রুবতারার মতো নু ক্যাম্পের আকাশে থেকে যান মেসি।
রোনালদিনহোর সান্নিধ্যে যাঁর শুরু, পরবর্তীতে জাভি, ইনিয়েস্তা, অঁরি, এতো, ভিয়া, ভালদেস, নেইমার, সুয়ারেসদের সঙ্গে লড়াই করেন মেরুন-নীলের সাফল্যের জন্য। বার্সেলোনা-রিয়াল মাদ্রিদের এল ক্লাসিকোকে তুলে নেন অন্য মাত্রায়। ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদোর সঙ্গে অবিম্মরণীয় দ্বৈরথে ইতিহাসের চিরকালীন গল্পের হাজারো উপাদান দিয়ে যান।
সেই রোনালদো রিয়াল ছেড়েছেন বছর তিনেক আগে। আর মেসির ওই সতীর্থদের অনেকে এখন অবসরে, অনেকে অন্য ক্লাবে। কিন্তু মেসির কোনো দিন ক্লাব বদলাতে হবে, ভাবা যায়নি।
গত বছর ক্লাব ছাড়ার যে ইচ্ছে-বোমা ফাটিয়েছেন, সেটি তো মূলত ক্লাব প্রেসিডেন্ট ইয়োসেপ মারিয়া বার্তোমেউয়ের সঙ্গে ঝামেলায়। সেই বার্তোমেউ চলে গেছেন। মেসির থেকে যাওয়াটাই তাই নিশ্চিত ছিল। কিন্তু মাঝের সময়টায় ক্লাব এত বাজেভাবে পরিচালিত হয়েছে যে, তার খেসারতেই লা লিগার ফিনান্সিয়াল ফেয়ার প্লের নিয়মের মারপ্যাঁচে মেসিকে বার্সেলোনা ছাড়তে হচ্ছে।
পেছনে পড়ে রইলো তাই ২১টি বছর। ৭৭৮ অফিসিয়াল ম্যাচ। ৬৭২ গোল। ১০ লা লিগা, ৮ স্প্যানিশ সুপার কাপ, ৭ কোপা দেল রে, ৪ চ্যাম্পিয়নস লিগ, ৩ ক্লাব বিশ্বকাপ, ৩ ইউরোপিয়ান সুপার কাপসহ ৩৫টি শিরোপা। আর তাঁর অসংখ্য ব্যক্তিগত অর্জনে সবচেয়ে জ্বলজ্বলে ছয়-ছয়টি ব্যালন ডি’অর।
এই বার্সেলোনাতে খেলতে খেলতেই যদি অবসর নিতেন মেসি, সেটি হত সবচেয়ে যথার্থ। ক্যারিয়ার-সায়াহ্নে শৈশবের ক্লাব নিওয়েলস ওল্ড বয়েজে ফিরলে সেটিও হত আরেক রোমান্টিক পুণর্মিলন। তা না হয়ে এখন কেবলই বিচ্ছেদের বেহালা বেজে চলছে। কারণ মেসি ইউরোপেই থাকছেন। কিন্তু বার্সেলোনায় না। হয়তো পিএসজিতে।
কে জানে, নতুন ক্লাবের জার্সিতে হয়তো এক দিন নু ক্যাম্পে খেলতে আসবেন মেসি। প্রতিপক্ষ হয়ে। বার্সেলোনাকে হারানোর পেশাদার মানসিকতা নিয়ে। ফুটবলটা কখনো কখনো কেমন নিষ্ঠুরই না হয়!
১৩ বছর বয়সের মেসিকে বার্সেলোনা প্রথম সই করায় ন্যাপকিন পেপারে। বহুল চর্চিত সেই গল্পটি তো নিশ্চয়ই আপনার জানা! কী আশ্চর্য দেখুন, ২১ বছর পর এমনই আরেক টিস্যু পেপার কিভাবেই না মিলিয়ে দিল সব কিছু! এবার টিস্যু পেপারে মেসির চোখের জলে লেখা রইল বার্সেলোনায় তাঁর প্রেমের গল্পের শেষ অংশটুকুন। বিদায়ের। বিরহের। বিচ্ছেদের।
বার্সেলোনা থেকে তাই বিদায় লিওনেল মেসি। বিদায় কিংবদন্তি। বিদায় ফুটবল জাদুকর।
এখন চলে যাচ্ছেন আপনি, এটাই চরম সত্য। আর এই সত্যের ভেতরে লুকনো সত্যটা হল, এই ক্লাবে আপনাকে একদিন ফিরতে হবে। ফিরতেই হবে। আপনার বার্সেলোনা শহর থেকে সহস্র মাইল দূরে এই বাংলার এক কবি জীবনানন্দ দাশ যেমনি করে শঙ্খচিল, শালিখের বেশে কিংবা ভোরের কাক হয়ে ফেরার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন কার্তিকের নবান্নের দেশে; তেমনি আপনিও নিশ্চয়ই নু ক্যাম্পে ফিরবেন এক দিন। হয়তো খেলোয়াড় নয়, হয়তো-বা অন্য কোনো ভূমিকায়।
এখনকার বিদায়ের এই তুমুল বিষন্নতার মাঝেও এটুকুই তো বার্সেলোনা সমর্থকদের স্বান্তনা। প্রিয় লিওনেল মেসি, আপনি কী আর সেটি জানেন না!