“মানবতাকে সর্বোচ্চ স্থান দিয়েছিলেন লালন ফকির ” প্রবন্ধটি লিখেছেন ওপার বাংলার কলমযোদ্ধা – কাকলি ভট্টাচার্য্য মৈত্র

538
“মানবতাকে সর্বোচ্চ স্থান দিয়েছিলেন লালন ফকির ” প্রবন্ধটি লিখেছেন ওপার বাংলার কলমযোদ্ধা - কাকলি ভট্টাচার্য্য মৈত্র

মানবতাকে সর্বোচ্চ স্থান দিয়েছিলেন লালন ফকির–

                           কাকলি ভট্টাচার্য্য মৈত্র

“খাঁচার ভিতর অচিন পাখি কেমনে আসে যায়”
সকল প্রকার জাতিগত বিভেদ থেকে সরে এসে মানবতাকে সর্বোচ্চ স্থান দিয়েছিলেন লালন, লালন ফকির।
তিনি ছিলেন একজন মানবতাবাদী সাধক।আর এই মনোভাব থেকেই তাঁর রচিত গান। আর এই গানের দর্শনে প্রভাবিত হয়েছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, অ্যালেন গিন্সবার্গের মতো বহু খ্যাতনামা মানুষ।

লালন ছিলেন বহুমুখী প্রতিভাসম্পন্ন একজন বাঙালি ফকির। যিনি, লালন ফকির, লালন সাঁই,লালন শাহ, মহাত্মা লালন নামেও পরিচিত ছিলেন। তিনি একাধারে দার্শনিক, মানবতাবাদী, সমাজসংস্কারক এবং সর্বোপরি বাউল সাধক।
লালন ফকিরের গান মূলত বাউল গান হওয়া সত্ত্বেও, বাউল সম্প্রদায় ছাড়াও অনেক সংগীত শিল্পী গেয়েছেন।
” সব লোকে কয় লালন কি জাত সংসারে।
লালন বলে জাতের কি রূপ
দেখলাম না এই নজরে।।”
লালনের জীবন সম্পর্কে সেভাবে কোনো তথ্য পাওয়া যায় না। তাঁর রচিত গান থেকেও, তাঁর জীবন সম্পর্কে কোনো তথ্য পাওয়া যায় না। তাঁর জন্ম কোথায়, নিজে কখনো প্রকাশ করেন নি। এ নিয়ে অনেক বিতর্কও রয়েছে। ১৭৭৪ খ্রিষ্টাব্দে অবিভক্ত বাংলার ঝিনাইদহ জেলার হরিশপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন, এমন তথ্য কোনো কোনো সূত্রে পাওয়া যায়। এ নিয়েও মতবিরোধ রয়েছে।
হিতকরী পত্রিকায় বলা হয়েছিল যে, লালন কম বয়সে তীর্থে গিয়ে গুটিবসন্তে আক্রান্ত হয়ে গুরুতর অসুস্থ হন। তাঁর সহযাত্রীরা লালনকে মৃত ভেবে ত্যাগ করেন এবং নিজেদের গন্তব্যে চলে যান।
মলম শাহ নামে এক ব্যক্তি কালিগঙ্গায় ভেসে আসা মুমূর্ষু লালনকে উদ্ধার করে বাড়িতে নিয়ে আসেন। মলম শাহ এবং তার স্ত্রী মতিজান বিবি লালনকে সুস্থ করে তোলেন। পরে, মলম শাহের কাছেই, লালন দীক্ষিত হন। পরবর্তী কালে, দার্শনিক গায়ক সিরাজ সাঁইয়ের প্রভাবেও প্রভাবিত হন।
” জাত গেল জাত গেল বলে
একি আজব কারখানা……”
লালনের ধর্মবিশ্বাস নিয়ে অনেক মতভেদ রয়েছে। লালনের কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছিল না। নিজের সাধনালব্ধ জ্ঞানে, হিন্দু-মুসলমান উভয় ধর্মের শাস্ত্র আয়ত্ত করে ছিলেন। বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যায়, তিনি বেঁচে থাকতেও, বিশেষ কোনো ধর্মের রীতি নীতি পালন করতে দেখা যায় নি। তাঁর রচিত গানেও কোনো বিশেষ ধর্মের প্রতি পক্ষপাতিত্ব দেখা যায় না। প্রবাসী পত্রিকার নিবন্ধে বলা হয়– সকল ধর্মের মানুষের সঙ্গে তাঁর খুবই সুসম্পর্ক ছিল। তিনি, জাতের ভেদাভেদ বিশ্বাস করতেন না।

লালনের ধর্মবিশ্বাস সম্পর্কে ঔপন্যাসিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় বলেছেন——
” লালন ধার্মিক ছিলেন, কিন্তু কোন বিশেষ ধর্মের রীতি নীতি পালনে আগ্রহী ছিলেন না। সব ধর্মের বন্ধন ছিন্ন করে মানবতাকে সর্ব্বোচ স্থান দিয়েছিলেন জীবনে।”

আবার সুধীর চক্রবর্তী লিখেছেন——
” কাঙাল হরিনাথ তাঁকে জানতেন, ঠাকুরদের হাউসবোটে তাঁর যাতায়াত ছিল, মীর মশাররফ তাঁকে চিনতেন, লেখক জলধর সেন বা অক্ষয় কুমার মৈত্র তাঁকে সামনাসামনি দেখেছেন, অনেকবার। গান শুনেছেন…. তবুও জানতে পারেন নি লালনের জাতপরিচয়, বংশধারা বা ধর্ম।

একটি গানে লালন প্রশ্ন রেখেছিলেন ——–
” এমন সমাজ কবে গো সৃজন হবে।
যেদিন হিন্দু মুসলমান বৌদ্ধ খ্রিস্টান জাতিগোত্র নাহি রবে।”

লালন অনুসারী মন্টু শাহের মতে, তিনি হিন্দু বা মুসলিম কোনোটাই ছিলেন না। বৌদ্ধধর্ম বৈষ্ণবধর্মের সহজিয়া মতবাদ, সুফিবাদ এবং আরও অনেক ধর্মীয় মতবাদ বিদ্যমান এমন একটি ধর্ম “ওহেজানিয়াত” নামে একটি ধর্মের অনুসারী ছিলেন। তাঁর অনুসারীরা, লালনের গানকে এই আধ্যাত্মিক মতবাদের কালাম বলেন। লালন অসাম্প্রদায়িক ও মানব ধর্মে বিশ্বাসী ছিলেন। চট্টগ্রাম, রংপুর, যশোর এবং পশ্চিমবাংলার অনেক লোক লালন ফকিরের শিষ্য ছিলেন। তাঁর শিষ্যের সংখ্যা প্রায় দশ হাজারেরও বেশি ছিল।

বিভিন্ন সূত্র থেকে পাওয়া যায়, জোড়াসাঁকো ঠাকুর পরিবারের অনেকের সাথেই তাঁর পরিচয় ছিল। উনিশ শতকের শিক্ষিত সমাজে, তাঁর প্রচারের পেছনে ঠাকুর পরিবারের বড় ভূমিকা আছে।
আবার কাঙাল হরিনাথকে রক্ষা করতে গিয়ে ঠাকুর জমিদারের লাঠিয়ালদের বিরুদ্ধে লাঠি ধরতে হয়েছিল লালন ফকিরকে।
১৮৯০ সালের ১৭ই অক্টোবর ১১৬ বছর বয়সে নিজের আখড়ায় মৃত্যু হয়।

” আট কুঠুরী নয় দরজা আঁটা
মধ্যে মধ্যে ঝরকা কাঁটা
তার উপরে সদর কোঠা
আয়না মহল তায়।। “— দেহতত্ত্ব.

লালন ফকির বিশ্বাস করতেন, আত্মসাধনায়। ” খাঁচার ভিতর অচিন পাখি”র সন্ধান পাওয়া যায় পার্থিব দেহসাধনার ভেতর দিয়ে দেহত্তর জগতে পৌঁছানোর মাধ্যমে। এটাই বাউল তত্বের নির্বান বা মোক্ষ বা মহামুক্তি লাভ।
তিনি মনে করতেন, সকল মানুষের মধ্যেই বাস করেন এক “মনের মানুষ “, আর সেই মনের মানুষের জাত, ধর্ম,বর্ণ, লিঙ্গ,কূল কিছু নেই।
তাঁর বিশ্বাস ছিল দৃশ্যমান শরীর আর অদৃশ্য মন আলাদা হলেও একই শরীরে বাস।সকল মানুষের মনে ঈশ্বর বাস করেন।মানব আত্মাকে তিনি রহস্যময় অজানা ও অদেখা এক সত্তা রূপে দেখেছেন।তাই তো তিনি বলতে পেরেছেন——-

” খাঁচার ভিতর অচিন পাখি কেমনে আসে যায়…”
মনের ভেতরের এমন এক সত্তাকে তিনি ধরতে পেরেছিলেন, যা অনায়াসে যাওয়া-আসা করে, একে কিছুতেই বন্দি করা যায় না।

সহজ সরল ভাষায় মানবজীবনের রহস্য, অসাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গি—- আধ্যাত্মিক ভাবধারায় রচিত প্রায় দুই হাজার গানে প্রকাশ পেয়েছে।

লালন সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, ” লালন ফকির নামে একজন বাউল সাধক হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ,জৈন ধর্মের সমন্বয় করে কী যেন একটা বলতে চেয়েছেন— আমাদের সবারই সেদিকে মনোযোগ দেওয়া উচিত।”

লালন ফকির এতটাই প্রতিভাসম্পন্ন ছিলেন, তিনি মুখে মুখে গানের কথা রচনা করে সুর দিয়ে সেই গান পরিবেশন করতেন। তাঁর গানে— আত্মতত্ব, দেহতত্ত্ব, গুরু বা মুর্শিদতত্ব, প্রেম-ভক্তিতত্ব, সাধনতত্ব, মানুষ-পরমতত্ব, আল্লাহ- নবীতত্ব, কৃষ্ণ- গৌরতত্ব। এমন আরও অনেক বিষয় রয়েছে লালনের গানে।
মার্কিন কবি এলেন গিন্সবার্গের রচনাবলীতেও লালনের রচনাশৈলীর অনুকরণ দেখা যায়।এতটাই লালনের দর্শনে তিনি প্রভাবিত হয়েছিলেন। এরকম অনেকেই লালনের দর্শনে প্রভাবিত হয়েছিলেন।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লালনের গানে প্রভাবিত হয়ে, লালনের রচিত কুড়িটি গান প্রকাশিত করেছিলেন ” প্রবাসী” পত্রিকার হারামনি বিভাগে। এছাড়াও জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর সম্পাদিত পত্রিকায় ১৩০৫ -এ পারমার্থিক গান– ” ক্ষম অপরাধ ও দীননাথ” কথা ও গানটি স্বরলিপি সহ প্রকাশিত হয়।
আজও লালনের গান বা ” লালনগীতি” বেশ জনপ্রিয়। সকলেই সমাদর করেন।
(প্রায় ৬০০ শব্দ)
তথ্য সূত্র: ইন্টারনেট

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here