সাহিত্যের অন্যতম সারথি নাসরিন আক্তার এর সমাজ চিত্রের অণুগল্প গল্প “নিখোজ সংবাদ ও একজন ফুলি ”

551
সাহিত্যের অন্যতম সারথি নাসরিন আক্তার এর সমাজ চিত্রের অণুগল্প গল্প “নিখোজ সংবাদ ও একজন ফুলি ”

                   “নিখোজ সংবাদ ও একজন ফুলি”

                                      নাসরিন আক্তার

তেল চিটচিটে চুলে সিঁথি কাটা , ছাপা রঙিন শার্ট ও ঢোলাঢালা পেন্ট পরে পার্কের কোণে বসে লোকটা ফোক ফোক করে বিড়ি টানে । বাদাম ওয়ালাকে ডেকে পাঁচ টাকার বাদাম কিনে, খোসা ছাড়িয়ে আয়েশ করে মুখে দেয় । এদিক ওদিক তাকিয়ে আর কাউকে না দেখতে পেয়ে ছোট ছোট পা ফেলে ফুলি সেদিকে এগিয়ে যায় যদি একটা হলেও মালা বিক্রি হয় সেই আশায়।
টানা তিনদিন পর সকালে একচিলতে রোদ উঠে আবার মিলিয়ে গেছে। ভেজা ঘাসের উপর ঝরা বকুল ফুল কুঁড়িয়ে মালা গাঁথে ফুলি । সাথের সবাই মালা বিক্রির তাগিদে এদিক ওদিক ছড়িয়ে পরে। ফুলিও ওদের সাথেই ছিলো ঝুপ করে বৃষ্টি আসায় এক একজন এক এক দিকে আশ্রয় নেয়।
ফুলি লোকটার পাশে দাড়িয়ে মৃদুস্বরে ডাকে –
-স্যার একটা মালা নিবেন।
প্রথমে লোকটা শুনতে পায় না দ্বিতীয় ডাকে ফিরে তাকিয়ে মাছি তাড়ানোর মত করে হাত নাড়ে।
ফুলি করুণ কণ্ঠে আবার বলে
-স্যার নেন না একখান মালা, মায় বিছনায় পইরা আছে ,কাইল থাইক্কা কিছু খাই নাই।
এবার লোকটা ভালো করে তাকায়, বয়স দশ কি বারো ময়লা ছেড়া জামায় অভাবি শরীরেও শরীরের বাড়ন্ত ছাপ স্পস্ট। তামাটে শির্ণ হাতে কয়টি বকুল ফুলের মালা।
লোকটা ছোট ছোট চোখ করে তাকিয়ে থাকে কয়েক মিনিট। এরপর কি ভেবে বলে উঠে
– কাজ করবি?
– কি কাজ স্যার?
– আছে, করলে চল আমার সাথে।
– টেকা দিবেন?
– হ, টাকাও পাবি লগে খাওন।
– কই যাইতে হইবো স্যার ?
– এইতো কাছেই,
– বিকাল বেলায় ফইরা আইতে পারমুতো? নাইলে মায় চিন্তা করবো।
– হ পারবি, এখন গেলে চল।
। টানা তিনদিন বৃষ্টিতে মায় কাজ করতে পারে নাই, আবার কাল থেকে জ্বরে পরে আছে। কয়টা টাকার আশায় ফুলি লোকটার পিছু পিছু হাঁটে।
——
সন্ধ্যায় বস্তির ঘরগুলোতে টিম টিম আলো জ্বলছে উঠে, মর্জিনার ঘর আঁধার।জ্বর শরীরে অভুক্ত মর্জিনা কাঁপা কাঁপা শরীরে উঠে সুইচ টিপে, বিড় বিড় করে মেয়েকে বকা দেয়
– হারামজাদি, হাইন্দা অইয়া রাইত অইলো অহনো ঘরে আউনের নাম নাই, হাইন্দা বাতিডাও জ্বালাইলো না।
ঝুপড়ির ঝাপ খোলে বাইরে এসে দাঁড়ায়। চিৎকার করে ডাকে কয়েকবার
– ফুলিরেএএ — ওওও –ফুলি—ইইই—
কোনো সারা না পেয়ে পাশের ঝুপড়ির ময়নাকে ডাকে
– ময়নারে আমার ফুলিরে দেখছোস নি?
– না খালা, ক্যা বাড়িত ফিরে নাই।
– না কোনোহানে দিহি না তো,
– সহালে বৃষ্টির পর ফুলি আর আমগো লগে আছিলো না খালা।
– শুনেই মর্জিনার ভিতরটা কেমন মোঁচর দিয়ে উঠে। মাইয়াডা গেলো কই! কাঁপা কাঁপা পায়ে এসে রেললাইনের পাশে দোকানটার সামনে দাঁড়ায়,
– মতিন ভাই আমার ফুলিরে দেখছোনি?
– না গো মর্জিনা বু আইজ তো দেহিনাই তারে। বলে মতিন নিজ কাজে মন দেয়। বৃষ্টি মুখর সন্ধ্যায় ওর দোকানে চা, বিড়ি পানের বিক্রি বেড়ে যায়। এক হাতে সামলাতে হয় মতিন কে । রেল লাইনে বস্তিটার পাশে ওরটা নিয়ে আরো দুইটা দোকান অথচ ওর দোকানেই ভীর বেশি।
মর্জিনা আরো কয়েকজনের কাছে মেয়ের খুঁজ করে কিন্তু কেউই কিছু বলতে পারে না।
রাত বাড়ে ঝিড়ি ঝিড়ি বৃষ্টির মধ্যেও জ্বর গায়ে মর্জিনা এদিক ওদিক মেয়েকে খুঁজে বেড়ায়।

ঝাপ ফেলা দোকান ঘরে সারাদিনের কাজ শেষে হাত মুখ বাঁধা অবস্থায় রক্তাক্ত ফুলি একসময় মেঝেতে নেতিয়ে পরে। সন্ধ্যার পর টেনে হ্যাচড়ে কচি শরীরটা একটা চটের বস্তায় ভরে রাখে লোকটা। হয়তো এই ছিলো ওর সারাদিনের মজুরি!
বৃষ্টির রাত ১২ টা বাজতেই চারিদিকে শুনশান নিরবতা নেমে আসে। একসময় নিষ্ঠুর নিস্তব্দতা ভেঙে ঝিকঝাক শব্দ তুলে রাতের লাস্ট ট্রেনটি ছুটে পালায়।ট্রেনের ঝিকঝাক শব্দটা সরে যেতেই দূরের ডোবাটায় ভারি কিছু পরার শব্দ হয়।
সারাটা রাত নির্ঘুম পার করার পর সকাল বেলা মর্জিনার বুকফাটা চিৎকারে বস্তির প্রতিটি ঘরে লোক জেগে উঠে। কিছুক্ষন মর্জিনাকে শান্তনা দেওয়ার পর সবাই নিজ নিজ কাজের ধান্ধায় বেরিয়ে পরে।
টিভি নিউজ বা কোনো পত্রিকায় ফুলির নিখোঁজ সংবাদ ছাপা হয় না।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here