হারিয়ে যেতে লাগলাম আলো-আঁধারের ঐ অপূর্ব সংমিশ্রণের সাগরে!!লেখক লাকী ফ্লোরেন্স কোড়াইয়া এর বিশ্লেষণ ধর্মী ভিন্ন মাত্রার গল্প“রাতের নির্জনে!”

568

“রাতের নির্জনে!”

                            লাকী ফ্লোরেন্স কোড়াইয়া

গন্তব্য বহুদূর।অনেকটা বিরক্ত হয়ে সিগারেট ধরালো নিটো।ভাল নাম নিটোল।সংক্ষেপে সবাই ওকে নিটো বলেই ডাকে।পরকক্ষণেই কি মনে হতেই জানালা দিয়ে বাইরে ছুঁড়ে ফেলে দিল।আমি তাকালাম নিটোর দিকে। কি ধরা তো পরেই গেলে আমার এমন প্রশ্নবোধক চাহনি যেন নিটো বুঝে নিল। ঠোঁট উল্টে হাত জোর করে মাথা ডানে-বামে দুলিয়ে বুঝালো সরি রে!কিন্তু মুখে তালা।সিগারেটের গন্ধ একদম সহ্য করতে পারি না।আমি কোন অভিব্যক্তি প্রকাশ করলাম না।নিটোর পাশে বসা বিশু ঘুমে যেন পরজগতে পারি জমিয়েছে।মহাপ্রলয় হলেও বিশাল মানে বিশু বেটা জানতে পারবে না।ওদের পিছনের সিটে বসেছে শৈলী আর প্রমি।বাসের হালকা আলোতে শৈলীর ঠোঁটের কোণায় লেগে হাসিটা চোখে পড়ল।বুঝলাম “ও”নিশ্চয় স্বপ্ন দেখছে!একবার কথায় কথায় বলেছিল,বাস জার্নিতে “ও”স্বপ্ন দেখে!দেখুক,এতে যদি সময় কাটে তো মন্দ কি?জেগে উঠলে ওর কথার যন্ত্রণায় এই নিঝুম, মধ্যরাতে যাত্রীরা পাঁজাকোলে করেই বাস থেকে নামিয়ে দিবে।আমার পাশের সিটটা ফাঁকাই রয়ে গেল।বেশ আরাম করেই বসলাম।চোখ বুজে তাঁকে মনে মনে ধন্যবাদ দিলাম সিটটা ছেড়ে দেবার জন্য।ম্যাডাম আমি কি এখানে বসতে পারি?দেখলাম একজন মাঝারি আকারের শ্যামবর্ন মানুষ দাঁড়িয়ে।বললাম,এটা কি আপনার সিট?শান্ত গলায় উত্তর দিলেন,ভুল না হলে সিটটা আমারই মনে হচ্ছে।হাসলেন তিনি।উত্তরে মুগ্ধ হলাম!তাহলে তো এই সিটের উপর আমার কোন অধিকার নাই।নিঃসন্দেহে বসতে পারেন।বলে সিট থেকে আমার হাত ব্যাগ ও পানির বোতলটা সরিয়ে দিয়ে উনাকে বসতে দিলাম।উনি বসতেই প্রচণ্ড ঠাণ্ডা অনুভব করলাম!মনে হল যেন এ্যান্টার্কটিকা মহাদেশে বরফের সাগরে ভাসছি।আমি লাফ দিয়ে সরে বসার চেষ্টা করলাম।সাথে সাথে বাসটা প্রচন্ড ঝাঁকুনি খেল
আমিসহ বাসের সবাই জেগে গেল।চোখ খুলে কাউকেই দেখতে পেলাম না।বুঝলাম আমাকেও পেয়ে বসেছে স্বপ্নে।হেল্পার বলল,ঘুমান,এটা কিছু না।আমি হেল্পারের দিকে তাকালাম।মনে হল কিছু একটা লুকাচ্ছে সে।মুখের একটা পরিবর্তন লক্ষ্য করলাম।সবাই আবার ঘুমিয়ে পড়ল।শৈলী আমার দিকে তাকাতেই ঘুমাতে ইশারা করলাম।অনেক দূর হতে মিষ্টি ফুলের সুবাস পেলাম।বাস চলছে ঝড়ের গতিতে।চাঁদের হালকা আলেতে বাইরের সব কিছু অদ্ভুত দেখাচ্ছে।পিছনে কেউ একজন নানান সুরে নাক ডাকছে।

মনে হল কোন অশুভ আত্মা বুঝি তার উপর ভর করেছে।বাস ছুটে চলছে গ্রামের পিচঢালা পথ ধরে।পাকা ধানের গন্ধ নাকে এল।চাঁদের হালকা আলো দেখিয়ে দিল দুইপাশের ধানখেত।অথাৎ আমরা এখন ধান খেতের মধ্য দিয়ে পাড়ি জমাচ্ছি বহুদূরের পথ।খোলা জানালা দিয়ে ঠাণ্ডা বাতাস ঢুকছে। দারুণ!!!চোখ খোলা রাখার চেষ্টা করলাম।।কিন্তু এই অন্ধকার হাতরে কে একজন মনটাকে পিছনে ফিরে যেতে চাইছে!কিন্তু কে সে?পিছনের সেই অশুভ আত্মায় ভর করা লোকটি যেন নাঁকি সুরে বলে উঠল, কে আবার?যার সিটটা আপনি নিজের সিট মনে করে দখল করে আছেন,সেই ভদ্রলোকই!ঝট করে উঠে দাঁড়িয়ে পিছনে ঘুরলাম।দেখলাম একজন লোক অভিনব কায়দায় ঘুনাচ্ছে।বাম হাতটা এমন ভাবে কানের কাছে রেখেছে যেন কানে মোবাইল চেপে ধরেছে আর মুখটা চাতক পাখির মত হা করানো। মনে হলো বাসের সব বায়ু গিলে খাচ্ছে আর ঢাকনা ছাড়া কেতলির মত গরম ধোঁয়া ছাড়ছে।এই দৃশ্য প্রমাণ করে ঘুমের উপর মানুষের কোন নিয়ন্ত্রণ নেই। আরাম ককরে নিজের জায়গায় বসে পড়লাম।ঘুম আর মৃত্যুর মধ্যে পার্থক্য কী-সেটা জানতে ইচ্ছা হল।বড় কঠিন ভাবনা!ইচ্ছে হল জিজ্ঞেস করতে কেউ কি জেগে আছো?এসো,একটু আলাপ করি।হঠাৎ চোখের পাতা কেমন ভারি হয়ে যাচ্ছে মনে হল।কোন ভাবেই খোলা রাখতে পারছি না।একি!ঘুম নাকি মৃত্যু আসছে?বুঝতে পারছি না।অনুভুতি যেন ভোতা হয়ে যাচ্ছে।মৃত্যু বুঝি এভাবেই আসে?হায় মৃত্যু,এই যাত্রা পথে তোমার অাগমন কি এতই জরুরী?অনেক গাঢ় অন্ধকারে তলিয়ে যেতে লাগলাম!পরিচিত অপরিচিত কন্ঠ কানে ভেসে এল,কেউ কি কাঁদছে নাকি?আমারও খুব কান্না পাচ্ছে!কাঁধের উপরকোমল স্পর্শে অনুভব করলাম।নিশ্চয় কোন স্বর্গদূত আমাকেসান্ত্বনা দিতে এসেছে ভেবে আশ্বস্ত হতেই কানে এল,আর কত ঘুমাবেন আপা!উঠেন,আমরা চলে এসেছি। চোখ খুললাম। না,বেঁচেই আছি তাহলে!আহা,কি শান্তি পেলাম মনে।ঘুম আর মৃত্যুর মধ্যকার পার্থক্য টা এবার বুঝতে পারলাম।ঘুম ভাঙলে এ কাল,না ভাঙলে পরকাল!সবাই নামার পর আমরা নামলাম বাস থেকে। রাস্তায় দাঁড়িয়ে চোখ জুড়িয়ে গেল।চারিপাশে সবুজ পাহাড়!আকাশটা যেন পাহাড়গুলোর উপর আঁচড়ে পড়েছে!শৈলী তিড়িং বিড়িং কন্ঠে জিজ্ঞেস করল আপা,কোন চান্দের গাড়ি তো দেখছি না?কোন রিসোর্টেরর কথা বলেছিলেন?সেটা কোথায়?আমি চোখের ইশারায় রাস্তার বিপরীত দিকে দেখালাম।ঐদিকে চোখ পড়তেই সবাই লাফ দিয়ে উঠল!”গ্রীন পীক রিসোর্ট “লেখাটা যেন সবার ক্লান্তি দূর করে দিল।তবে আমাদের কাউকেই কষ্ট করতে হল না।রিসোর্টের ম্যানেজার আমার ভাইয়ের বন্ধু প্রাঞ্জল দুজন লোক নিয়ে এল।ওরা ব্যাগগুলো নিয়ে গেল।আসরা আরামে পাহাড়ি সিঁড়ি বেয়ে উঠে রিসোর্টের অফিস কক্ষে গিয়ে বসলাম।সেখান থেকে চাবি বুঝে নিয়ে চলে এলাম নিজেদের কক্ষে।ফ্রেস হয়ে রিসোর্টেরর রেস্টুরেন্ট এ এসে দারুণ নাস্তা করলাম।আশেপাশের প্রকৃতি যেন মায়াবী ইশারায় হাতছানি দিয়ে ডাকছে।আমরা আর বসে থাকতে পারলাম না।সারারাতের বিরাট বাস জার্নি আর বান্দর বনের ক্লান্তিদায়ক গরমকে উপেক্ষা করে আমরা নেমে এলাম নিচে।পাহাড়ের মাঝখান দিয়ে পীচঢালা পথ ধরে হাঁটতে লাগলাম এলোমেলো ভাবে।
বিকালে চান্দের গাড়িতে করে ঘুরতে বের হলাম।স্বর্নমন্দির,নীলাচল, মেঘালয় ঘুরে সন্ধ্যায় ফিরে এলাম ” গ্রীন পীক রিসোর্টে।সন্ধ্যার পাহাড়ি অন্ধকারের সাথে পাল্লা দিয়ে দিয়ে রিসোর্টের সব লাইট
জ্বলে উঠল এক এক করে।আসেপাশের পাহাড়েও তাই হল।আমার কক্ষের বারান্দায় দাঁড়িয়ে অপলক দৃষ্টিতে দেখে যাচ্ছি কল্পনার এই স্বর্গ!সত্যিই তো আমাদের এই বাংলা মা প্রকৃতির;অপরূপ সৌন্দর্যের লীলাভূমি!প্রকৃতির এমন সৌন্দর্যের প্রতি আমি বরাবরই দুর্বল!ক্যামেরা দিয়ে কিছু ছবি তুললাম।তারপর আবার হারিয়ে যেতে লাগলাম আলো-আঁধারের ঐ অপূর্ব সংমিশ্রণের সাগরে!!!

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here