এবার একুশে পদক নিবেন অরুন্ধুতী বোস!!লেখক ও কবি—–শামসুন নাহার এর ভিন্ন মাত্রার গল্প“অরুন্ধতীর একুশে পদক ”

552
লেখক ও কবি—–শামসুন নাহার

অরুন্ধতীর একুশে পদক

                   ————————————
                   শামসুন নাহার——–

অরুন্ধুতী বসে আছে জাতীয় কবিতা মঞ্চে।আজ একুশে পদক দেয়া হবে।ওকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে।সে এবার একুশে পদকে মনোনীত হয়েছে।

অরুন্ধুতীর বয়স ষাট। শ্যামলা গড়ন।লাল পেড়ে অফ হোয়াইট কালারের ইন্ডিয়ান সিল্ক শাড়ী পরে এসেছে।সিঁথিতে সিঁদুর। নাকে ডায়মন্ডের নাকফুল।গলায় চিকন একটা চেইন। কপালে লাল বড় একটা টিপ।হাতে সোনার বালা।কোঁকড়ানো চুলগুলো খোঁপার বাইরে দিয়েও বাতাসে দোল খাচ্ছে।

অরুন্ধুতীর বুকের ভিতরটাও দোল খাচ্ছে। আজ ও দেশের সর্ব্বোচ্চ পদকে ভূষিত হতে যাচ্ছে।অথচ মনে কোন শান্তি নেই।সেই যৌবন থেকে যখন ওর বিয়ে হয়,তখন থেকেই ওর লেখার হাতে খড়ি। জীবনের প্রতিটা পদক্ষেপে ও বাঁধা গ্রস্থ হয়েছে।ওর স্বামী কোনদিনও পছন্দ করেনি ও লেখার জগতে থাক।প্রথম প্রথম চুরি করে লিখলেও, একসময় লেখা বন্দ করে দিয়েছে এরপর পড়াশুনা করতে চেয়েছে। সেখানেও বাঁধা। ওর স্বামী চায়নি লেখাপড়া করে ও শিক্ষিত স্বাবলম্বী হোক।ওর স্বামী অমল বোস সব সময় চেয়েছে স্ত্রী থাকবে পায়ের তলায়।যখন যা অর্ডার করবো তাই করবে।সন্তান উৎপাদন লালন পালন, সংসার সামলানো আর রাতে বিনোদনের জন্য শয্যাসঙ্গী।

এরই মাঝ দিয়ে সবাই ঘুমিয়ে গেলে অরুন্ধুতী সবুজ ডিম লাইটের আলোয় পড়াশুনা করেছে,আর পরীক্ষার সময় হাতে পায়ে ধরে সময়টুকু চেয়ে নিয়েছে।এ ভাবেই সে এম,এস,এস পাশ করেছে।নিয়েছে দুইটা ডিপ্লোমা ডিগ্রীও।অথচ একের পর এক সরকারী চাকুরী হলেও ওকে করতে দেয়া হয়নি।

অরুন্ধুতী সংসার করেছে, সন্তান লালন পালন করেছে,আজ ওরা সবাই প্রতিষ্ঠিত। তবুও অরুন্ধুতীর কোন স্বাধীনতা নেই।আঁধারের সাথে ও বসবাস করেছে।ও বেঁচে থেকেও মরে আছে সংসারের এক জঞ্জালের মত।এই সমাজের ভয়ে চক্ষু লজ্জায় এক পরাজিত জীবনে কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি।পারেনি প্রতিবাদ করতে।তারপর বয়স চল্লিশ পেরিয়ে ও আবার লেখার জগতে ঢুকে গেছে।সেই একই ভাবে চুরি করে।আজ ওর জীবনী,ওর লেখার দক্ষতা,সমাজের অসংগতি তুলে ধরে ও বাংলা সাহিত্যে অনন্য অবদান রেখেছে।আর সরকার ওর অবদানের কথা বিবেচনা করেই এই একুশে পদক দেয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহন করেছে।

যখন অরুন্ধুতী নির্বাচক কমিটির চিঠি পায়” আপনি এবার একুশে পদকে মনোনীত হয়েছেন”তখন ও চিঠিটা ওর স্বামীকে দেখাতে ভয় পাচ্ছে।যদি রেগে যায়।যদি বাজে কথা বলে,যদি বলে আমি নিষেধ করা সত্বেও কেন তুমি লেখালেখি করলে?কি জবাব দেবে ভেবে পায়না।

তবুও ও ধীর পায়ে অমল বোসের সামনে যেয়ে দাঁড়ায়,বলে একটা কথা ছিলো,
ওর স্বামী মুখ তুলে চায়, কিছু বলবে?
হ্যাঁ বলছিলাম যে,আমার নামে একটা চিঠি এসেছে একটু দেখবে।
দাও— বলে অমল বোস চিঠিটা নিয়ে নেয়।চিঠি পড়ে খানিকক্ষণ তাকিয়ে থাকে স্ত্রীর মুখপানে।আজ তার মনে হলো কতবড় কৃতিত্ব তার স্ত্রীর।অথচ এতবড় প্রতিভাকে ও গলাটিপে হত্যা করেছে।মনে মনে যে খুশি হলোনা তা নয় তবে ভয়ও পেলো।সে মাত্র এইচ,এস,সি পাশ।আর তার বৌ দেশ সেরা লেখক।এবার যদি বউ তার কথা না শুনে।তাই মুখে গম্ভীর ভাব এনে বলল আমার নিষেধ সত্বেও তুমি এসব করেছো?

অরুন্ধুতী কাঁপছে, পা দুটো যেন শরীরের ভার রাখতে পারছে না।খুব কাঁপা কাঁপা গলায় বলল,শুধু এবার অনুমতি দাওনা,আমি এ পদকটা গ্রহণ করতে চাই।
—শোন তোমার ছেলে মেয়ের কাছে তারা কি বলে,একথা বলে উঠে চলে গেল অমল বোস।

এবার ছেলে মেয়ের পালা,ওদেরকে ফোন করতেই ওরা লাফিয়ে উঠলো ” মা তোমার এত সন্মান”,বাবাকে বলছি তোমাকে যেতে দিতে।
ছেলে মেয়ে বাবাকে ফোন দিয়ে বুঝিয়ে বলল,বাবা এটা আমাদের গর্ব।এটা পরিবার সমাজ তথা দেশের গর্ব।মাকে যেতে দাও।

বাবা অনেকক্ষণ ভেবে বললেন দিতে পারি অনুমতি এক শর্তে।সে যেন গৃহ কর্মাদি যেমন করছিলো তেমন করে,তার ভিতরে যেনো কোন উচ্ছ্বলতা না দেখি।
যাহোক অনেক ভয়ে ভয়ে অরুন্ধুতী অনুমতি পেয়েই খুশি।
ও ঢাকা এসেছে, মঞ্চে বসে আছে,একটু পরেই অনুষ্ঠান শুরু।অথচ ওর বুকের মাঝে তোলপাড়।আজ এতবড় একটা আনন্দকে ভাগ করার মত বুঝি কেউ নেই।

অরুন্ধুতীর চোখ দিয়ে শিশির বিন্দু গড়িয়ে গড়িয়ে পড়ছে,আর মাইকে নাম ঘোষনা হচ্ছে জীবনের সাথে যুদ্ধ করে করে জয়ী এক মহীয়সী নারী,যে এই আধুনিক যুগেও বেগম রোকেয়াদের মত নিঃশব্দে নিশাচরের মত লিখে লিখে বাংলা সাহিত্যে রেখেছেন এক অনন্য অবদান।আমরা বলতেই পারি চেষ্টা থাকলে লক্ষ্যে পৌঁছানো শুধু সময়ের ব্যাপার।
এবার একুশে পদক নিবেন অরুন্ধুতী বোস।

1 COMMENT

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here