ভারত থেকে সাহিত্যের অন্যতম সারথি অগ্নিমিতা দাস এর গল্প“নোনাজল”

434
ভারত থেকে সাহিত্যের অন্যতম সারথি অগ্নিমিতা দাস এর গল্প“নোনাজল”

নোনাজল____

  অগ্নিমিতা দাস

__ একটু ডানদিকে তাকাও মা! একটু ক্লোজ হও , সূর্যটা আসছে না।
__ উফ্! তাড়াতাড়ি কর তো! রিজিতা বিরক্ত হয়ে বলল। তখন থেকে ছেলের কথায় অরিত্রর সাথে ফটোসেশন করে যাচ্ছে। ছেলের ফটোগ্রাফির খুব শখ, তাই পারফেক্ট না হওয়া অব্দি অগত্যা?
পাভেলের মাধ্যমিক পরীক্ষার পর সমুদ্র সৈকতে ঘুরতে আসা।রিজিতার ইচ্ছায় সমুদ্রে আসা
নাহলে বাপ বেটায় পাহাড় ভালোবাসে। সানরাইজ দেখে ছবি তুলে হোটেলের পথে হাঁটা দিল। হোটেল একদম সমুদ্রের সামনে।রোদ বেশ চড়চড় করে উঠছে দেখে ব্যাগটা হাতড়ে সানগ্লাসটা বের করতে গিয়ে সামনে দিকে তাকিয়ে চমকে উঠলো। বেশ কিছুটা দূরত্বে পেছন ফিরে জিন্স আর টপ পরা পরিহিতা মহিলা ফোনে কথা কথা বলতে বলতে এগিয়ে গেল।
হোটেলে ফিরা ইস্তক রিজিতা বেশ আনমনা। তার কি চোখের ভুল! কিন্তু গলার স্বরটা চাপা হলে ও খুব চেনা। মনের মধ্যে হাজার চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে। বারবার মনকে বশে আনার চেষ্টা করছে। কিন্তু মনের আলমারিতে থাকা আঁশটে গন্ধমাখা উলোঝুলো স্মৃতিগুলো বারবার উপচে বেরিয়ে আসতে চাইছে।চোখ জ্বালা জ্বালা করছে। কিন্তু কিছু সময় বুঝি চোখে খরা নামে।
সানসেট দেখতে এসে রিজিতা বেশ হুড়োহুড়ি করে পা ভিজিয়ে জলকেলি করার পর ধপ করে বালিতে বসে পড়লো। কোমরটা ধরে গেছে। পাভেল আর অরিত্র ছবি তুলতে অনেকটা দূরে চলে গেছে। রিজিতার বেশ ভালো লাগে ভিজে ভিজে বালিতে বসতে। বালি দিয়ে আঁকিবুকি কাটতে কাটতে সকালের কথা চিন্তা করছিল। সন্ধ্যা হবো হবো। হু হু করে হাওয়া দিচ্ছে। নীল আর লালের খেলা সারা আকাশ জুড়ে। রিজিতা কাঁধের ব্যাগটা নিয়ে আবার সমুদ্রে পা ভেজাতে গেল। সমুদ্র এখন অনেকটা কাছে।
_ তুই এখানে? চেনা কন্ঠস্বর। চমকে উঠে তাকাতেই দেখলো সকালের মহিলা তার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন ছুঁড়লো। রিজিতা কি করবে বুঝতে না পেরে হাওয়ায় এলোমেলো হয়ে যাওয়া চুল ঠিক করতে করতে বলল__ আমি এগোলাম!
__ প্লীজ একটু দাঁড়া। কতদিন পরে দেখা, তোকে কত খুঁজেছি।
_ আমার তোর সাথে এতদিন পরে আর কোন কথা থাকতে পারে না। বলেই রিজিতা সামনের দিকে পা বাড়ালো। বুকের ভেতর স্মৃতির পাহাড়গুলো যেন দুমড়ে মুচড়ে উঠছিলো।
রিজিতা আর শঙ্খ পাশাপাশি দূর্গাপুরের কোয়ার্টারে থাকতো।একই স্কুল। দুজনেই পড়াশোনায় তুখোড় ছিল। রিজিতার প্রথম প্রেম শঙ্খ। কিন্তু ক্লাস ইলেভনে শিন্জিনির বাবা বদলি হয়ে আসাতে রিজিতার জীবনে মেঘ ঘনিয়ে এল। অসম্ভব সুন্দরী শিন্জিনিকে প্রথম থেকেই রিজিতা সব রকম সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল। অঙ্কে কাঁচা ছিল বলে শঙ্খকে রিকোয়েস্ট করেছিল বিকেলে শিন্জিনিকে একটু দেখিয়ে দিতে। শঙ্খ প্রথমে বিরক্ত হয়ে ও পরে রিজিতার কথা ঠেলতে পারে নি।
কিন্তু রিজিতা জীবনের অঙ্কে যে এত কাঁচা ছিল তা সে নিজেই জানতো না। জানলো ভর সন্ধ্যায় নোটস নিতে শঙ্খের বাড়িতে গিয়ে যখন দেখলো ওর ঠাকুমা ছাড়া বাড়িতে কেও নেই। রিজিতা সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে ছাদ থেকে ভেসে আসা শিন্জিনির উচ্চস্বরে হাসি শুনতে পেল। ছাদের মুখে দাঁড়িয়ে উল্টোদিকের ল্যাম্পপোস্টের আলোয় দেখলো শঙ্খকে শিন্জিনি জড়িয়ে চুমুতে চুমুতে ভরিয়ে দিচ্ছে। দুজনেই এত মশগুল ছিল যে রিজিতার উপস্থিতি খেয়াল করে নি। ছুটতে ছুটতে ওর নামার শব্দে বোধহয় ওদের চমক ভাঙ্গে। উচ্চমাধ্যমিকের পর রিজিতারা কলকাতা চলে আসে। ততোদিন শঙ্খ আর শিন্জিনি ওকে এড়িয়ে গেছে। রিজিতার মনের অস্থিরতার দরুন ওর মতো মেয়ের খুব খারাপ রেজাল্ট হয়। কলকাতায় থাকতেই শুনেছিল ওরা দুজনেই এক কলেজে ভর্তি হয়েছে। তারপর শুনেছিল ওদের বিয়ে ও হয়ে গেছে।
হাতে হাল্কা টান অনুভব করে রিজিতা ঘুরে দাঁড়ালো।দেখলো শিন্জিনি সেই আগের মতোই সুন্দরী আছে।শুধু বয়স বেড়েছে এই যা!
_ আমার ওপর এখনো রাগ করে আছিস? আমি ভালো নেই রে, তোকে পরে যোগাযোগ করার অনেক চেষ্টা করেছি কিন্তু শুনেছিলাম তোর মুম্বাইয়ে বিয়ে হয়েছে। আসলে কি জানিস ওই বয়সটাই ছিল পুতুল খেলার বয়স, বাপীর বদলির পর ওখানে গিয়ে দেখতাম তুই সকলের নয়নের মনি। স্কুল থেকে পাড়া সবখানেই। এমনকি তোর খেলার পুতুলটা ও তোর খুব বাধ্য। বিশ্বাস কর ভালোবাসা কি তখন জানতাম না। আমি বরাবর আদুরে বলে সবার হার্ট থ্রব হতে চেয়েছিলাম তাই তোর হার্ট থ্রবকে কেড়ে নিতে চেয়েছিলাম।
পারি নি রে!বলতে বলতে শিন্জিনির গলাটা ধরে এল।
রিজিতার এবার অস্বস্তি লাগতে শুরু করেছে। এক্ষুনি যদি পাভেল আর অরিত্র চলে আসে কি হবে ভাবতেই মাথায় এলো যাকে নিয়ে এত দিনের জমে থাকা কষ্ট ,সেই শঙ্খ কোথায়?
শিন্জিনি বুঝি ওর মনের কথা বুঝতে পেরে বলে উঠলো___ আসলে শঙ্খ ছিল তোরই। অনেক বার অনেক সময় অনুভব করে নিজেকে ছোট বলে মনে হতো। ও আমার মধ্যে সেই ছোটবেলার রিজিতাকে খুঁজতো। যা প্রথম তাকে কেও ভুলতে পারে না বোধহয়। স্বামী সন্তান পেয়ে ও তুই যেমন পারিস নি!আমাদের সেপারেশন হয়ে গিয়েছিল বিয়ের বেশ কিছু বছর পর। কোন সন্তান না থাকার জন্য বন্ধনটা কাটাতে বেশি সময় লাগে নি। গতবছর খবর পেলাম শঙ্খ আর নেই। লাস্ট স্টেজে ব্লাড ক্যান্সার ধরা পড়েছিল। চলি! আমাদের দুজনের খেলার পুতুল আর নেই রে। এতদিনের জমে থাকা কথাগুলো বলে সত্যি রিলিফ লাগছে।

শিন্জিনি অনেকক্ষন চলে গেছে।রিজিতা অন্ধকারে একা।রিজিতাকে ভিজিয়ে দিয়ে চলে যাচ্ছে একের পর এক সমুদ্রের ঢেউ।রিজিতার চোখে ও এখন জোয়ার এসেছে। সমুদ্রের আর চোখের নোনাজল মাখামাখি। দুটোর স্বাদ এক!!!
© মিতার কলমে অগ্নি

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here