“রয়েছো নয়নে নয়নে ”গল্পটি লিখেছেন ভারত থেকে কলমযোদ্ধা অজন্তা প্রবাহিতা

466
“রয়েছো নয়নে নয়নে ”গল্পটি লিখেছেন ভারত থেকে কলমযোদ্ধা অজন্তা প্রবাহিতা

রয়েছো নয়নে নয়নে

কলমে -অজন্তাপ্রবাহিতা

নীলিমা সান্যাল
অমরাবতী
আকাশবাড়ি
২০/১০ /২০২০ আনোয়ারশাহ রোড কলকাতা -৪৫
প্রিয় নীলিমা
প্রতিবছর এই একটি মাত্র চিঠি লিখি তোমায়। বছর ঘুরে যখন মা আসবার সময় হয়ে আসে, আমার তখন মনে হয় এই কাজটা। এ নয় যে সারা বছর তোমার কথা মনে পড়ে না। প্রতি মুহূর্তে মনে পড়ে। সঞ্চয় করে রাখি মনের মণিকোঠায় যা যা বলার আছে তোমায়। এই সময়টা অফিসের চাপ একটু কম থাকে ,ছুটির মেজাজে থাকে সবাই। আমি থাকি তোমায় ঘিরে।
প্রতিবারের মতো এইবারও মা আসছেন,কিন্তু এক্কেবারে অন্যরকম ভাবে। সেপ্টেম্বরে মহালয়া হলো,মলমাস বলে পুজো
এক মাস পড়ে । তুমি তো কোরোনার গল্প জানোই না। সে কি অদৃশ্য এক ভাইরাস এলো রে বাবা, ধরলে পরে মৃত্যু অবধারিত। সারা পৃথিবীর কত লোক মারা গেছে এই রোগে আক্রান্ত হয়ে, তার কোনো গণনা নেই।আমরাও তাই খুব সাবধানে আছি।
মার্চ মাস থেকে তো আমরা গৃহবন্দী হয়ে আছি। ভাগ্যিস, ছোট্টর বইটা ফেব্রুয়ারী মাসে বেরিয়ে গেছে। তোমার সাথে ওর দেখা হয় নি। আমার বহু কাঙ্খিত ছোটবোন। তোমার সাথে দেখা হয়নি বলে তার ভারী আফসোস। তোমার কথা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জিজ্ঞেস করে আমায়,’বৌদি কেমন ছিল,কী হয়েছিল’। ‘এই সময় বৌদি কী করতো ?’ ‘কী খেতে ভালোবাসতো ?’ ইত্যাদি নানান জিজ্ঞাসা ওর মনে। ওর প্রশ্নের উত্তর দিতে দিতে কেমন করে যেন, তোমার আরো কাছে পৌঁছে যাই। মনে হয়,এই তো তুমি,বিকেলের চায়ের কাপটা নিয়ে এসে ধরিয়ে আহ্লাদী সুরে বলছো আমায়,”এই রবিবারে কিন্তু সিনেমা দেখতে যাবো,অফিসের ফাইল নিয়ে বসবে না।”
তুমি নেই আমার কাছে, এই কথাটা কখনো বিশ্বাসই হয় নি।কাছের মানুষ তো কাছেই থাকে,সে কি দূরে যেতে পারে !মেঘের বাড়ি আকাশ জানি ,কিন্তু জোৎস্না আমার ঘরে। সেই জোৎস্নার আলোয় আমি তোমায় দেখতে পাই। স্নান সেরে,ভিজে গায়ে, এলো চুলে আমার কাছে এসে বসো। তোমার গায়ের গন্ধে মাতাল হয়ে ওঠে মন। নিবিড় হয়ে ওঠে মুহূর্তরা। সম্পূর্ণ হই আমি।
জানো,ওর বইতে রুদ্র আর মুনমুনের গল্প পড়তে গিয়ে আমাদের প্রেম পর্বের কথা মনে পড়ে গেলো। নিজে পছন্দ করে বিয়ে করবো, এই কথাটা বাবার কাছে বলবার সাহস কোনোদিনও ছিল না। বৌদি যদি সেই সময়ে হেল্প না করতো,তাহলে প্রায় কেঁচে গিয়েছিলো আমাদের ব্যাপারটা। আমি তো অন্য কাউকে বিয়ে করতে পারতাম না। কিন্তু,তোমার বাবা তো তোমায় অন্যত্র বিয়ে দিয়ে দিতো,আর আমি বেচারি দেবদাস হয়ে এক মুখ দাড়ি নিয়ে তোমার শ্বশুর বাড়ির সামনে দিয়ে যাওয়া আসা করতাম আর ভাবতাম,একবার দেখা দাও,পারো।
ছোট্টর গল্পে রুদ্র, মুনমুন লিভ-টুগেদার করছে। কত কী পাল্টে গেছে সময়ের সাথে সাথে। সম্পর্কও এখন ঝালিয়ে নেয়া হয়। একদিকে ভালো। পরে মতানুভেদ তৈরী হবার চেয়ে আগেভাগেই পরস্পরকে বুঝে নেওয়া খুব জরুরী। এখনকার ছেলেমেয়েরা অনেক বেশি বাস্তববাদী ও সচেতন।
এবারে পুজোর বাজারে কেনাকাটার সেই উদ্দীপনা নেই। সোমা,রূপাও এবারে পুজোর কেনাকাটার লিস্ট ধরায় নি। বুড়িমারও কোনো দাবি নেই। কোরোনার জন্য সকলেরই আনন্দের জোয়ারে ভাঁটা পড়ে আছে।
আমি বেশির ভাগ দিনই বাড়ি থেকে অফিস করছি, আর বুড়িমা বাড়ি থেকে স্কুল করছে। রূপা অনেক বোঝদার হয়েছে, জানো। মাঝে মাঝে একটু আধটু ঝগড়া করে বৈকি, কিন্তু আবার নিজে থেকে মানিয়ে নেয়। ওহ ! ঝগড়া বলতে মনে পড়লো,ছোট্ট কী ঝগড়া করে আমার সাথে কী বলি,এক্কেবারে কাঁদিয়ে ছেড়ে দেয়। আমি হাপুস নয়নে কেঁদে ওর কাছে সারেন্ডার করলে, তবে ও ঠান্ডা হয়। এসব নিয়েই নিজেকে ডুবিয়ে রাখার চেষ্টা করি আজকাল ।তুমি থাকলে আমাদের ভাইবোনের ঝগড়া দেখে হেসে কুটিপাটি হয়ে যেতে।
অফিস থেকে বাড়ি ফিরি যখন,সদর দরজা খোলাই থাকে,বুড়িমা সোফায় বসে থাকে আমার অপেক্ষায়। ঠিক যেমনি সোমা ছোটবেলায় বসে থাকতো,বাপীর অপেক্ষায়, একই রকম ভাবে বসে থাকে। আমার ঘরে ঢুকে বিছানার পাশে রাখা ছবিতে তোমার মুখটা দেখে মনে হয়,তুমিও আমার অপেক্ষায় ছিলে। আমি এখনো অফিস থেকে ফিরে এসে চুপ করে তোমার পাশে বসে থাকি। চোখ বন্ধ করে অনুভব করি তোমার স্পর্শ। সেই নরম স্পর্শে আমার সারাদিনের ক্লান্তি মিটে যায়। আজও কত কথা বলি তোমার সাথে। তুমি সেই আগের মতোই এক মনে তাকিয়ে থাকো আমার দিকে। মন দিয়ে আমার কথা শুনে যাও। চিতার আগুন তোমার শরীরকে পুড়িয়ে ছাই করে দিয়েছে হয়তো,তোমার স্পর্শের অনুভূতি টুকু কেউ কেড়ে নিতে পারে নি। এমনকি সময়ও নয়।
প্রতিবার মায়ের কাছে কায়মনোবাক্যে তোমার আত্মার শান্তি কামনা করি। আমায় ছেড়ে চলে যাবার জন্য এতো তাড়া কেন ছিল নীলা ? এই বয়সে এসে আমার সব থেকে বেশি প্রয়োজন মনে হয় তোমার। লোকে বলে,”ভাগ্যবানের বৌ মরে”,আমার দুর্ভাগ্যের পরিহাস আমিই বুঝতে পারি।
সারাদিন পরিশ্রমের পরে যখন বিছানায় গা এলিয়ে দেই,পিঠে অসহ্য যন্ত্রনা করে,মনে হয়, তুমি আগের মতো মাথায়, বুকে পিঠে একটু হাত বুলিয়ে দাও। সকালে উঠেই তো আবার ছুটতে হবে। পাশে তাকিয়ে দেখি,তোমার জায়গাটা শূন্য। কিন্তু তোমার গায়ের গন্ধটা এখনো আছে। তোমার জায়গায় অন্য কাউকে আমি বসাতে পারি নি ,পারবোও না।আমার সব টুকু জুড়ে শুধু তুমি আর তুমি।
মনপ্রাণ উজাড় করে তোমায় ভালোবেসেছিলাম। আজও বাসি। “নয়ন তোমায় পায় না দেখিতে,রয়েছো নয়নে,নয়নে। ”
অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে আছি,তোমার সাথে দেখা হবে অন্য ঠিকানায়। তুমি যে সব কাজ অসম্পূর্ণ রেখে গেছো। সেই কাজ গুলো আমায় শেষ করতে হচ্ছে।
যখন তুমি ছিলে,আমায় গুছিয়ে দিতে,তখন সবকিছু বড্ডো স্বাভাবিক মনে হতো। আজ আমার সবকিছু আমাকেই করে নিতে হয়। সোমা আপ্রাণ চেষ্টা করে আমার যেন কোনো কষ্ট না হয়। তোমার ছবি ওর মধ্যে প্রতিফলিত হয়। ধীর, স্থির, মিতভাষী। ও শ্বশুর বাড়ি ফিরে গেলে আমার ঘর ফাঁকা। তখন হয়তো আমি কোনো আশ্রমে চলে যাবো। এই এতো বড় বাড়িতে একা থাকতে পারবো না গো। এখানে রন্ধ্রে রন্ধ্রে তুমি আছো।
ভোরে উঠে মায়ের কাছে প্রার্থনা করি,আমি যেন কোনো এক শরতের মেঘ হয়ে তোমার সাথে মিলে যাই।
“তুমি ছাড়া কেহ সাথী নাই আর
সমুখে আনন্ত জীবন বিস্তার,
কাল পারাবার করিতেছ পার
কেহ নাই জানে কেমনে
রয়েছ নয়নে নয়নে।”
শারদীয়ার অনেক ভালোবাসা ও আদর তোমার জন্য। মেয়েদের আমি বলে রেখেছি,এই ডাইরী যেন আমার সাথে দিয়ে দেয়। এই ডাইরী আমার ভালোবাসার সাক্ষী।
ইতি
তোমার দেব

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here