ভারত থেকে সমাজ-সভ্যতার কলমযোদ্ধা-অগ্নিমিতা দাসের সাম্য দর্শনের লেখা গল্প “ভালোবাসার খেয়া”

295
ভারত থেকে সমাজ-সভ্যতার কলমযোদ্ধা-অগ্নিমিতা দাসের সাম্য দর্শনের লেখা গল্প“ভালোবাসার খেয়া”

ভালোবাসার খেয়া
কলমে_ অগ্নিমিতা দাস

_ কি রে এখন কি চাই? দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা কচিকাঁচাগুলোর দিকে তাকিয়ে ঋতমা বললো। একটা দিন ছুটি, গুচ্ছের কাজ পড়ে আছে, তার মধ্যে এই ডোরবেল বাজলে কাজের দফা রফা। এই দিনেই কেবল থেকে নেটের, খবরের কাগজের লোক দলবেঁধে টাকা নিতে আসে। উপায় নেই! অন্য দিন হলে কে ও খুলবে না। ঋতমার ব্যাগ সেইজন্য আজকের দিনে সবসময় কার্বাডের বাইরেই থাকে। আজ আবার সকাল থেকেই অকাল বর্ষন। কিসের চাঁদা রে? সামনের কটা চুলের মেয়েটা যেন অবাক হওয়া কথা শুনছে এমন করে বলে উঠলোকিসের লেগে তা জানো না? সরসতী পুজো না সামনে।কথার মধ্যে শ্ শ্ করে কথা বলার প্রবণতা প্রবল। এই ছেলেমেয়েগুলোর দল পিছনের রেল কলোনীর বস্তিতে থাকে। ঋতমা হাউসকোটে হাত ঢুকিয়ে সবাইকে একবার ভালো করে দেখে বলে উঠলো যে ঠাকুরের পুজো করবি, তার বানান বল।
_ বানান টানান জানি না। পড়ালিখার দেবতা এটা জানি। ইস্কুলে পুজো হতো। খিচুড়ি খেতাম, পাড়ায় পাড়ায় হয়। হাতকাটা বাপীরা এই পুজোর দিন মস্তি করে, গতবছর দিনভর মাইকে টুম্পা সোনা হাম্পি দে না চলে ছিলো। মাল খেয়ে খেয়ে শা আমাদের খালি খাটাবে। হাতে মাল্লু ঠেকাবে না। এবার আমরা করবো । বেশ গর্বের সাথে ওদের থেকে অপেক্ষাকৃত একটু বড়ো ছেলেটা বললো। চোয়াড়ে মুখ, হাফ ন্যাড়া মাথায় চুলের হাজার কারিগুরি, জামাটা ও অন্যদের থেকে বেশ চকমকে।একেই দলের পান্ডা বলে মনে হলো।
_
বানান জানিস না। পড়াশোনার ধার দিয়ে যাস না। পুজো করলেই হলো। বিদ্যার দেবী তাকে ভালো না বাসলে কিসের পুজো ।
_ চল! চল! এইসব ফালতু কথা শোনার আমাদের টেইম নেই । যতো ভদ্রনোক্কেরা জ্ঞান মারাবে , দেবার বেলায় হাত দিয়ে জল গলে না। কিশোর ছেলেটা অন্যদের হাত ধরে টানলো। ফালতু কথা বলতে লজ্জা করছে না। তখন থেকে আজেবাজে ভাষা বলে যাচ্ছিস। লেখাপড়া করিস না, খালি টো টো করে ঘুরিস, নেশা করিস আর বড়ো হয়ে তোলাবাজি না হলে ওয়াগন ব্রেকারের কাজ করবি। তোদের ভালো হওয়ার ইচ্ছে হয় না।
মা কেটে পড়েছে আশীকের সাথে তখন আমার চারবছর, বাপটা বিয়ে করার পর রোজ এই মাগীটার হাতে মার খেয়ে খেয়ে পিঠে ছালা পড়ে গেছে । ইস্কুলে তো যাই, মিড ডে মিল খেতে। পড়ালিখা করে তো চাকরি পাবো না। বাপের মতো আমি রিক্সা চালাবো না। আমি হাতকাটা বাপীর মতো ডন হবো। _ তা তুমি হবে সে তো বোঝাই যাচ্ছে। মর্নিং শোজ দা ডে। এ্যই তোর নাম কি রে?
সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটা আস্তে আস্তে বলে উঠলো_ নাগমা ! আমি পড়ালিখা করি। তবে আমাদের বাড়িতে তো পুজো হয় না। ইস্কুলে হতো। দু’বছর থেকে তো তাও যেতে পারিনি। তাই কেষ্টোদা বললো বলে চাঁদা তুলতে বেরিয়েছি। আমার দাদী তো গাল দিচ্ছে মুসলমানের মেয়ে হয়ে হিন্দু দেবতার পুজো করবো বলে। নাকি পাপ হবে? কিসের পাপ দিদি? মেয়েটার একনিঃশ্বাসে বলা কথাগুলোতে ঋতমার বুকটা কেমন যেন করে উঠলো। ও তাড়াতাড়ি ভেতর থেকে পার্সটা খুলে একশো টাকা বের করে , বাইরে বেরিয়ে দেখলো সব ফাঁকা।ছেলেমেয়েগুলো এত তাড়াতাড়ি কর্পূরের মতো উড়ে গেল।

অন্যমনস্ক হয়ে ঋতমা হাতের কাজ সারছিলো। ছেলেটার আত্মসম্মানবোধ খুব প্রবল তাই ওদের টেনে নিয়ে গেলো। এই কেষ্টো আর নাগমা ওকে চুম্বকের মতো টানছিলো। এই সরস্বতী পুজো এলেই ওর মনটা ভার থাকে। দরজা বন্ধ করে শুয়ে থাকে। এখনো ওএতদিন পরে ও।
দুপুরে শুয়ে শুয়ে মনে মনে চলে গিয়েছিলো, কোন এক বাসন্তী দুপুরে।

_ কাল আমাদের বাড়িতে তোর দুপুরে নেমতন্ন। ঠাম্মা দাদু আসবে। তোকে দেখবে বলেছে। ওরা তোর ব্যাপারে সব জানে।

বিতানের কাঁধে মাথা রেখে ঋতমা সূর্যাস্ত দেখেছিলো। ক্লাস ইলেভেন থেকে বিতানের সাথে ওর প্রেম। এখন কলেজের থার্ড ইয়ার। বিতানের বাড়িতে ঋতমা অনেকবার বন্ধুদের সাথে গেছে। ওর মা ঋতমাকে খুব ভালোবাসে, ঋত বলে ডাকে। অনেকবার ওদের বাড়িতে পুজোআচ্চাতে গেছে।
ঋতমার মা স্কুলের টিচার, সরস্বতী পুজোর দিনে পিতলের একটা ছোট সরস্বতীকে পুজো করে। পুরোহিত ডাকে না, নিজেই পুজো করে। মা বাপী সবসময় বলে মনটাই আসল। মন দিয়ে লেখাপড়া করিস তাহলেই দেবী খুশি হবেন। ঋতমা পুজোর দিন হলুদ শাড়ি পরে খুব হাল্কা প্রসাধন করে বেরোচ্ছিলো।
_ ঋত! মায়ের ডাকে পিছু ফিরলো। _ বিতানের বাড়ি যাচ্ছিস। ঋতমা মাথা নাড়ালো। বিতানের কথা ওর মা জানে। আলমারি খুলে সোনার লকেট আর কানের দুল বের করে পরিয়ে দিলো। নিজের মেয়েকে দেখতে দেখতে বিভোর হয়ে বলে উঠলো_ সাক্ষাৎ মা সরস্বতী! ধুর ! বলেই মায়ের গালে চুমু দিয়ে ঋতমা ছুট লাগালো।
বিতানের বাড়িতে এসেই ঋতমা পুজোর কাজে লেগে গেলো। আলপনা দেওয়া থেকে, মালা গাঁথা, হোম হবে তার জোগাড় করা। বিতানের মা ঋতমাকে দেখে নিশ্চিন্ত হলো। মেয়েটা খুব কাজের। মাধবী শাশুড়ির সাথে ওর পরিচয় করিয়ে দিয়ে চোখে চোখ যেন ইশারা করলো, সেটা ঋতমার নজর এড়ালো না। লজ্জায় কান লাল হয়ে গেলো।
পুজো টুজো হয়ে গেলে ভোগ খাওয়ার সময়ে সবাই খেতে বসেছে। ঋতমা পরিবেশন করছিলো। বিতানের ঠাম্মির হাতছানি দিয়ে ডাকাতে ঋতমা লাবড়ার গামলাটা অহনার হাতে দিয়ে উনার কাছে গেলেন। সিঁথি ভর্তি সিন্দুর পরনে গরদের শাড়ি পরে বিতানের ঠাম্মিকে বেশ রাশভারী লাগছিলো।
_ আয় মা আয়! অনেক খেটেছিস! আমার নাতির পছন্দ তো বেশ খাসা বলে ওর থুতনিতে চুমু খেলেন। _ কোথায় বাড়ি? বাবার নাম কি? কি করেন?
_ বাড়ি তো পেয়ারাতলায়। বাবার নাম রজ্জাক কাজী আর হাইস্কুলের হেডমাস্টার। কি নাম?
রজ্জাক কাজী। মায়ের নাম মধুলিকা সামন্ত।
_ মানে ! তুমি মুসলমানদের মেয়ে? এই পুজো বাড়িতে এসে সব কাজ করে একি অধর্ম করলে? আমার নাতবৌ মুসলমানের মেয়ে আমি তো ভাবতেই পারছি না। ওগো শুনছো, আমি এই বাড়িতে এক মুহূর্ত থাকবো না। মাধবী তুমি মুসলমানের মেয়েকে বৌমা করতে পারো, পুজোর সৃষ্টির কাজ করাতে পারো আমি সহ্য করবো না? হায় ভগবান! এ কি অধর্ম হলো এই বাড়িতে। মালতী গঙ্গাজল আন, সারা বাড়িতে বালতি বালতি ঢাললে ও বোধহয় এই পাপ ধোবে না। সবাই হতবাক। খেতে বসে এঁটো হাতে সবাই পিছন ফিরে ঋতমা আর বিতানের ঠাম্মীকে দেখছে। ঋতমার মনে হচ্ছিল মাটি ফাঁক হয়ে গেলে ও ঢুকে যাবে। এই অল্প শীতে ও দরদর করে ঘামতে থাকে। কাঁপা কাঁপা হাতে ব্যাগটা অহনার হাত থেকে নিয়েই বেরিয়ে আসে। তখনো চলছে বিতানের ঠাম্মীর জোর জোরে বিলাপ। ঋতমা শোন! আরে দাঁড়া। একমিনিট!
ঋতমা কোন কথা না শুনে রানিং অটোতে উঠে পড়ে। বাড়ি ফিরে এসে মায়ের বুকে মুখ রেখে হাউহাউ করে কাঁদে।
অনেক সাধনার পর বিতানের কথায় লেকের ধারে আসতে ঋতমা রাজি হয়।
_
ঋত! শোন। তোর সবসময় সত্যিবাদী যুধিষ্ঠির হওয়ার কি দরকার। বাবার নাম রজ্জাকের জায়গায় রোহিত রাহুল কিছু বানিয়ে দিতে হতো। এনফ্যাক্ট মাও তো জানতো না। আমি পরে সব ম্যানেজ করে নিতাম। তোকে আমি ভালোবাসি বাট ইয়ু আর স্টাবার্ণ!
সপাটে গালে কে যেন চড় কষালো।

_ মানে বাবার নাম ও বানিয়ে বলতাম। ছিঃ ছিঃ! আমি আমার পরিচয় গোপন করতে পারবো না। আমি এই শিক্ষায় বড় হই নি, বিতান আমি খুব উদার ভাবে মানুষ। সরি একটা মিথ্যের ইমারত খুব তাড়াতাড়ি ভেঙে পড়বে। এই ইমারতটা বোধহয় আর বাড়ানো উচিত নয় বলেই ঋতমা গটগট করে কোনদিকে না তাকিয়ে চলে এসেছে। বিতানের শত অনুরোধ উপরোধে ও ঋতমা অটল থেকেছে। ফোন ব্লক করেছে, সোশ্যাল মিডিয়া থেকে বেরিয়ে এসেছে। তারপর শুরু হয়েছে বিদ্যাদেবীর আরাধনা। আজ ঋতমা সরকারি খুব উঁচু পোস্টে চাকুরিরতা। ঋতমা রাজি হয় নি বলে বাপী মা ও বিয়ের জন্য জোর করে নি। সম্পর্ক একটা আলগা হয়েছিলো সেটাও দুবছরের মাথায় ভেঙে গেছে।ঋতমা ও নিজের কাজের জগতে খুশি। সে অনেকবার ভেবেছে বিতান কি ভালোবাসার জন্য সব কিছুকে অগ্রাহ করতে পারতো না। সত্যিকারের ভালোবাসলে সব কিছুকে স্বীকার করে ভালোবাসতে হয়। সেখানে খাদ থাকে না। ঝিপঝিপ বৃষ্টিতে বিকেলে গায়ে স্টোলটা জড়িয়ে ঋতমা খুঁজতে খুঁজতে রেলকলোনীর ধারে নাগমাদের দেখা পেলো। তারা তখন হিমশিম খাচ্ছে ছেঁড়া ত্রিপল টাঙ্গানোর জন্য বৃষ্টির হাত থেকে ঠাকুরকে বাঁচাতে।ওকে দেখে তো ওরা অবাক। কেষ্টো অবাক হয়ে বললখুব তো গরম নিচ্ছিলেন? এখন এসেছেন দেখতেন আমরা চাঁদা নিয়ে ফুর্তি করবো না পুজো করবো। ঋতমা মিষ্টি হেসে বললো তুই পাকা পাকা কথা বলা বন্ধ করতো। এইসব কথা কোথা থেকে শিখেছিস? আমি ও তোদের সাথে পুজো করবো নিবি? নাগমা এগিয়ে এসে ওর হাতটা ধরলো।
কেষ্টো ফিল্মি কায়দায় বলে উঠলো_ জিন্দেগী নে সব কুছ শিখা দিয়া মেডাম! ঋতমা ওকে বকতে গিয়ে ও গুনগুন করে গেয়ে উঠলো
লাভ ইয়ু! জিন্দেগী! ওর হিন্দি গান শুনে সবাই একটু একটু করে এগিয়ে এলো। ঋতমা ওদের কাছ থেকে কথা আদায় করলো ওরা শনি রবিবার বিকেলে ওর বাড়িতে পড়তে আসবে। স্কুল রোজ যাবে। পুজোর আগের দিন রাতে সবাইকে তিনপাতা সরস্বতী বানান লিখতে হবে।ঋতমা ও হৈ হৈ করে ওদের সাথে মিলে পুজোর জোগাড়ে ব্যাস্ত হয়ে গেলো। সে টাকাপয়সা দিয়ে বস্তির মধ্যে বেশ বড়ো একটা পুজোর আয়োজন করলো। ও নাগমা, ললিতা, পুন্নি, চায়না, রাফিয়া, আমিনারা মিলে পুজোর জোগাড় করলো আলপনা দিলো। কেষ্টো জান লাগিয়ে খাটছে। সবচেয়ে অবাক সব কিছুর হিসাব পাই টু পা ঋতমাকে সে দিচ্ছে। অঙ্কে যে তার মাথা দুর্দান্ত সেটা ওর মুখে মুখে হিসাব দেখে ঋতমা বুঝতে পারলো।সে ঠিক করেছে পুজোর দিন ভোগ খাওয়াবে। সামান্য আয়োজন। হাসিফ কাগজের চাকতি কেটে কি সুন্দর টোকেন করেছে যাতে ওটা দেখিয়ে একবার একজন করেই বসতে পারে। ওদের উৎসাহ ওদের ঋতমার জন্য কে আগে প্রাণ করিবেক দান দেখার মতো।ঋতমা ভাবে ভালোবাসা পেলে মানুষ কত বদলে যায়। কি অদ্ভুত ক্ষমতা এই ভালোবাসার। সব কিছুই বদলে দেয়।

বহুবছর পরে ঋতমা হলুদ শাড়ি পরে সেজেগুজে প্যান্ডেলে এসেছে। পুরোহিত মশাই সবার নাম গোত্র জিগ্গেস করাতে ইমরান, হাসিফ, নাগমা , রাফিয়ারা ঋতমার কোল ঘেঁষে দাঁড়ালো। ঋতমা হেসে বললো_ ওরে আমার নাম ও ঋতমা কাজী। ঠাকুরমশাই সবার নাম ধরে পুজো দিন আর গোত্র বলুন মনুষ্যত্ব! পুরুতমশাই আগেই ঋতমার কাছে হাজার একটাকা পেয়ে গেছে, তাই গোত্র নিয়ে মাথা ঘামিয়ে সময় নষ্ট করলো না। তাছাড়া আজ তার মরার সময় নেই বলে কথা তো গোত্র! গরু মোষ যাই হোক। টাকা দিয়ে সব ধুয়ে যায়। অঞ্জলির সময়ে ইমরান, হাসিফ, কেষ্টো , চায়না, আমিনা ,পুন্নি, নাগমার সাথে ঋতমা ও গলা মিলিয়ে মন্ত্র উচ্চারণ করলো__
“নম সরস্বতি মহাভাগে বিদ্যে কমললোচনে। বিশ্বরূপে বিশালাক্ষি বিদ্যাং দেহি নমোহস্তু তে॥”
বিদ্যাদেবীর সামনে দাঁড়িয়ে ঋতমা প্রার্থনা করলো এই দৃশ্যের যেন শেষ না হয়। কেউ না কেউ যেন এই দৃশ্যকে ঠিক বাঁচিয়ে রাখে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here