হাফ রোজা……
অগ্নিমিতা দাস
…… আন্টি কি দারুন সেমাই বানিয়েছে। এই পাতলা পাতলা সাদা রুটিগুলো কি দিয়ে তৈরি রে?
জাকির হাসতে হাসতে বলল—– তোকে জেনে কাজ নেই। তুই খালি খেয়ে যা! বলতে বলতে ঘাসের ওপরে রাখা টিফিনের কৌটা বন্ধ করতে ব্যাস্ত হয়ে পড়লো।বসুধা জিন্সের ধুলো ঝাড়তে ঝাড়তে উঠে বলল—- কেন আমি বুঝি রান্না করতে পারবো না? খুব পারবো?
—- সব পারবে মহতারমা! আমি তোমায় রান্না করতে দেবো না। নিজের হাতে রান্না করে খাওয়াবো।
বলেই দুজনেই হো হো করে হেসে উঠলো।
বসুধা আর জাকিরের ছেলের অ্যডমিশনের সময়ে ফর্ম ফিলাপ করছিলো জাকির। ফর্মটা জমা দিতে গিয়ে চোখ বুলিয়ে বসুধা দেখলো ধর্মের জায়গাটা তার লেখা আছে হিন্দু । সে মনে মনে ভাবলো এত উদার কেও হতে পারে। জাকির ওর মনের ভাব বুঝতে পেরে বলল—– ধর্মের জায়গাটা আমার না কোন বিশেষ ধর্মের লিখতে বাধে। ইচ্ছে করে মানবতা লিখি। আমাদের রায়ানের ও লিখবো ভেবেছিলাম। কিন্তু স্কুল কতৃপক্ষ যদি কিছু বলে। তবে দেখো নিও একদিন এই কলামে শুধু একটাই ধর্ম থাকবে সেটা মানবতা। বসুধা বিয়ের পর ধর্ম পরিবর্তন করে নি। আইনত বিয়ে হয়েছে পদবী পরিবর্তন না করে। বসুধা বলেছিল—– সবাই যদি কিছু ভাবে? জাকিরের কঠোর ভাবে উত্তর এসেছিল—– তুমি প্লীজ আমাদের ভালোবাসার অপমান করো না। ধর্ম সেটা আবার কি। খায় না গায়ে মাখে। নাম পরিবর্তন করলেই বুঝি ভালোবাসাটা বেড়ে যায়। জাকিরের বাড়ির লোকজন কে ও সেইভাবে আপত্তি করার সুযোগ পায় নি,তবে আত্মীয় স্বজন মহলে হালকা কানাঘুষো চলতো। কিন্তু ওদের প্রেম ,ওদের এই অন্য স্রোতে গা ভাসানোটাকে বোধহয় মনে মনে সবাই সমীহ করতো।
—– ওঠো সেহরি করবে না? সময় তো পেরিয়ে যাবে? বসুধা জাকিরকে ধাক্কা দিয়ে ওঠালো।
ঘুমচোখে জাকির বলে উঠলো—— আমায় ডাকলে কেন? আমি এত রাতে করে বাড়ি ফেরার পর খেয়ে শুতে বারোটা তারপর এই তিনটেই উঠলে আমি কালকে পুরো ডাউন হয়ে যাবো।আমি সেহরি খাবো না। উপরওয়ালা ক্ষমা করে দেবে।
——তোমার তাহলে হাফ রোজা। রেগে গিয়ে বসুধা বলল। এটা কিন্তু নিয়ম।
——তুমি তো করছো সব নিয়মমতো। তাহলে আমার আর হাফ কই? তুমি তো চোখে ঠুলি এঁটে অনেক বই পড়ো। আমার থেকে নামাজের বেশি জানো। আমার কাছে কর্মই আসল ঈশ্বর। তুমি পুরো করলেই আমার ফুল হয়ে যাবে। বলে পাশ ফিরে শুলো। বসুধা সেহরি করে ফজরের নামাজ পড়তে বসলো।
বসুধা আর জাকির দুজনেই বেরোবে। স্নান করে বসুধা তোয়ালে দিয়ে মাথা মুছতে মুছতে বলতে গিয়ে থমকে গেল। দেখলো জাকির স্নান সেরে দেওয়ালে আটকানো সিংহাসনে জল বাতাসা দিয়ে ধূপ জ্বালিয়ে পরম ভক্তি ভরে প্রণাম করছে। বসুধার আজ চারদিন, শাস্ত্র মতে ঠাকুর ছোঁয়া বারন।
রায়ানের ভীষণ জ্বর। সারারাত বসুধা আর জাকির
জেগে ছেলের পাশে। পরদিন একটু তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে জাকির বসুধার হাতে একটা মোড়ক দিয়ে বলল—– এটা বাবুর বালিশের নীচে রেখে দাও। ফেরার পথে জয় বলল কালীবাড়িতে একটু পূজো দিয়ে প্রণাম করে আসতে। বাবুরটা জ্বর তাই ভাবলাম, মাথায় ঠেকিয়ে দিও।
জাকির ঈদ বা বকরীদের দিন ছাড়া কোনদিন টুপি পরে নামাজ পরতো না। গায়ে সব সময় ভুরেভুরে সুগন্ধি মেখে থাকতো। অনেকে আড়ালে বলতো টুপি না পরে এত সেন্ট মেখে নামাজ হয় না। জাকির তো কাউকে তোয়াক্কা করতো না। ও বলতো——-যেখানে ছোট থেকে পড়েছি, সেখানে এত ছোট ছোট নিয়মকানুন কে তুচ্ছ করতে শিখেছি। অচলায়তনকে ভেঙে মনকে উদার হবার মন্ত্রে দীক্ষিত হয়েছি।
বসুধা আজ ও ভোরে উঠেছে। যন্ত্রের মতো সেহরি খেয়েছে। আগে আগে অভ্যাসবশত বিছানায় হাফ রোজাদারকে ডাকতে যেতো। কিন্তু বিছানা খাঁ খাঁ।
হাফ রোজাদার তো এখন তার সব রোজা সম্পূর্ণ করতে ঈশ্বরের কাছে চলে গেছে। আগে আগে বসুধা ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে পাগলের মতো কেঁদেছে। মনে হয়েছে এইবার বুঝি তো তার হাফ রোজাদার তাকে রাগিয়ে গায়ে চিমটি কেটে বলবে—— এলাম তোমার জ্বালায়। কিন্তু এত ভোরে আমি চা ছাড়া কিছুই খেতে পারবো না। তুমি খাও আর ভুঁড়ি বাগাও!
আজ অনেক তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে উঠে বসুধা স্নানে গেছে । রায়ান অকাতরে ঘুম দিচ্ছে। বাপের মতো ধাত পেয়েছে। হাফ রোজা হয়তো করে না তবে বললে ফাজলামি মেরে বলে——আমি মাঝে মাঝে রোজা রাখি। ডায়েটিংর জন্য।
বসুধা জানলার বাইরে সদ্য ফোটা আলোর দিকে তাকিয়ে ভাবছিল এই মহামারীর কালো অন্ধকার দূর হয়ে নতুন সকাল হবে। মনটা আজ বড্ড উথাল পাথাল করছে।
” আ ভি যা আভি যা
এ্যই সুভা আভি যা
রাত কো কর বিদা”
মুঠোফোনে ডাক প্রিয় বান্ধবীর ঈদের শুভেচ্ছা
জানানোর জন্য।
© মিতার কলমে অগ্নি