ভারত থেকে কলমযোদ্ধা-শ্রীরূপা চক্রবর্তীর ভিন্নমাত্রার গল্প “জল, Water,পানি”

469
শ্রীরূপা চক্রবর্তীর ভিন্নমাত্রার গল্প “জল, Water,পানি ”

জল, Water,পানি
শ্রীরূপা চক্রবর্তী

দূরের মসজিদ থেকে ভেসে আসছে আজানের সুর। শরণ্যার ঘুম ভেঙে যায়। মোবাইলে অ্যালার্ম দেওয়া ছিল আরও কিছুটা পরে। কিন্তু ভিতরে অস্থিরতা থাকলে কি আর ঠিক মতো ঘুম হতে চায়!! তবু শেষ রাতের দিকে চোখটা লেগে গেছিলো। আজানের সুর ঘুম জাগানীয়া হয়ে এসে তাকে ডেকে তোলে।
আজ একটা নামী বেসরকারী স্কুলে শরণ্যার চাকরির ইন্টারভিউ। প্রাথমিক পর্বের বাছাই পর্ব হয়ে গেছে। আজই ফাইনাল ইন্টারভিউ শেষে যা জানানোর জানিয়ে দেওয়া হবে। তার এই চাকরিটার অপেক্ষায় রয়েছে বাড়ির প্রত্যেক সদস্য। সে বোঝে সব। আর পাঁচটা নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারে যেমন ছকে বাঁধা ছবি, শরণ্যার ক্ষেত্রেও তাই। এ চাকরি পাওয়া-না-পাওয়ার ওপর নির্ভর করছে তার বাবার ছানি অপারেশন, মায়ের রান্নাঘরে একটু জলের সুবিধা, দাদার কাঁধ থেকে সংসারের দায়িত্বটা একটু ভাগ করে নেওয়া — এমন আরও অনেক কিছুই। সে জানে এই মুহুর্তে এই চাকরিই তার পরিবারকে এনে দিতে পারে একটু স্বস্তির আনন্দ। টেনশন তাই খুব বেশি।
আশা ভরসা বহুক্ষেত্রেই উদ্দীপকের কাজ করে। যার ওপর আশা ভরসা যত বেশী, তা পূরণ করবার জন্য সে তত মরিয়া হয়ে ওঠে। সেই মরিয়া ভাব, প্রার্থনার রূপ নিয়ে জাতি ধর্ম নির্বিশেষে , যেখানে পৌঁছনোর হয়তো পৌঁছে যায়।
তখনও ভেসে আসছে ভোরের আজান। ভোরের শান্ত পরিবেশে তা শুনতে ভারী ভালো লাগে শরণ্যার। একটু হালকা বোধ করে সে। আজানের সুর যেন মদনমোহনের বাঁশি হয়েতার অন্তরে কড়াঘাত করে বলে,
——ভয় কি শরণ্যা !! আমি আছি তো।
পরন্ত বিকেল। ট্রেন আসছে যাচ্ছে। স্টেশন চত্বরে বাড়ী ফিরতি মানুষের ভীড়। রিক্সা স্ট্যান্ডে লম্বা লাইনটার দিকে তাকিয়ে লিয়াকত আলি ভাবতে থাকে—
——–সব কটা ভাড়া যদি আমিই পেতাম…
লিয়াকত আলি, সবার লিয়াকত ভাই। বাড়িতে বহু দিন পর সুন্দরবন থেকে মেয়ে জামাই এসেছে। আবেগের বশে, সকালে কাজে বেড়োনোর আগে, সে খুব বড় মুখ করে ছোট নাতিকে শুধিয়েছিল,
——–কি খেতে মন চায় রে বাবু??
সে ব্যাটাও যেন প্রশ্নটার জন্যই অপেক্ষা করছিল। দিব্যি বলে বসলো,
——-মাছ খাব, ক্ষীর খাব।

বাজারে টোটো আসবার পর থেকে রিক্সাচালকদের অবস্থা বেশ খারাপ। তার উপর মাসের শেষ। এতগুলো মুখে মাছ, ক্ষীর কোথা থেকে সম্ভব!! এখন তাই বাড়ী ফিরতি মানুষের লম্বা লাইনটার দিকে তাকিয়ে তার মনে হচ্ছে,
—–সব কটা ভাড়াই যদি পাওয়া যেত!
এসব সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে তার পালা এসে যায়। এক ভদ্রলোক রিক্সায় উঠে বলেন,
——-হালদার পাড়া, শতদল ক্লাবের কাছে নামবো।
লিয়াকত ভাবে,
——-যাক্ , শতদল ক্লাব, তবু একটু লম্বা রাস্তা, ২০টা টাকা আসবে।
শতদল ক্লাবে ভাড়া নামিয়ে ফেরার পথে পরে রামকৃষ্ণ মিশন। গেট বরাবর সোজা তাকালে দেখা যায়, হলুদ চাদরে , মালায় শ্রীরামকৃষ্ণের শ্রীমূর্তি। মিশনে তখন সন্ধ্যারতি চলছে। হঠাৎ কি মনে হতে লিয়াকত রিক্সাটা ধীর করে গেট বরাবর সেদিকে তাকায়। কিছু মুহূর্ত মাত্র। সচেতনে সে নিজেও হয়তো জানেনা, কেন সে গতি কমালো, কেনই বা সে গেট বরাবর তাকালো।
যাঁর উদ্দেশ্যে তখন সন্ধ্যারতি চলছে, একমাত্র তিনিই হয়তো লিয়াকত আলীর মনের ভাষাহীন আর্তি পড়তে পারলেন।
আবার ফিরে চলে সে স্টেশনের দিকে। আবার ভাড়ার জন্য অপেক্ষা। এবারে ভাড়া পেতে লাইনে অপেক্ষা করতে হলো না। একটি মাঝ বয়সী মেয়ে এসে দাঁড়ালো । যাবে সাহাবাগান। আমরা তার পরিচয় আগেই পেয়েছি—চাকরির ইন্টারভিউ শেষে
শরণ্যা বাড়ী ফিরছে।
খুব বেশি আনন্দ উচ্ছ্বাস হলে, শরীরী ভাষায় তার ছাপ পরে। এ মেয়েকে দেখেও লিয়াকতের মনে হলো, খুব যেন উপচে পরা খুশী। আর বাড়ী ফেরার তাড়াও যেন খুব বেশী। হাতে আবার দুখানা বড় মিষ্টির প্যাকেট। সেদিকে চোখ পড়তেই নাতিটার মুখ মনে পরে লিয়াকতের। দাদুর কাছে মাছ, ক্ষীর খেতে চাইলো। কিন্তু সে এমনই অভাগা দাদু , খালি হাতেই হয়তো বাড়ী ফিরতে হবে।
সাহা বাগান যেতে হলে, মোল্লাপারা দিয়েও যাওয়া যায়। তবে একটু ঘুর পথ হয়, এই যা। শরণ্যা লিয়াকতকে বলে,
——-কাকা, রিক্সাটা একটু মোল্লাপারা দিয়ে ঘুরিয়ে সাহাবাগানে নিয়ে চলুন।

ভোরবেলা যেখান থেকে ভেসে আসা আজানের সুর, তার কাছে শ্রীকৃষ্ণের অভয় বানী হয়ে পৌঁছেছিলো, আজ তার চাকরি পাওয়ার এত বড় আনন্দের দিনে, সেই মসজিদকেও তার একটাবার বাইরে থেকে প্রণাম জানাতে মন চাইলো।
মোল্লাপারা হয়ে সাহাবাগানে নিজের বাড়ীর কাছাকাছি পৌঁছতেই শরণ্যার খেয়াল হয়, ভাড়ার টাকা বের করা হয়নি।
চাকরি পাওয়ার আনন্দ উত্তেজনায় টাকা বের করতে গিয়ে, একটা ৫০০ টাকার নোট উড়ে রাস্তায় পরে যায়।
——-কাকা, রিক্সাটা একটু দাঁড় করান। টাকা পরে গেছে।
লিয়াকত বিরক্তি আড়াল করে, নিজেই নেমে গিয়ে টাকাটা তুলে এনে শরণ্যার হাতে দেয়।
টাকা টা নিতে গিয়ে শরণ্যার মনে হয়,
——-আহা!! না জানি মানুষটার এই টাকাটুকুর কত প্রয়োজন। নিজের হাতে ধরেও আমায় দিয়ে দিতে হচ্ছে !!
নিতে পারেনা শরণ্যা। ভাড়া মিটিয়ে চলে যাওয়ার আগে, ৫০০ টাকার নোটটা সে লিয়াকত কে দিয়ে বলে,
——–এটা আপনি রাখুন কাকা। আজ আমার জীবনের একটা আনন্দের দিন। আপনিও না হয়, এটা দিয়ে বাড়ীর সবাইকে নিয়ে একটু আনন্দ করবেন।

এও কি সম্ভব!!
দু মিনিট আগেও সে জানতো, আজ খালি হাতেই নাতির সামনে গিয়ে তাকে দাঁড়াতে হবে। আর সেখানে……..লিয়াকত বিশ্বাস করতে পারেনা।
এক মুখ খুশী আর আশীর্বাদ শরণ্যা কে উপহার দিয়ে, সে বারবার তার আল্লাহ কে ধন্যবাদ জানাতে থাকে। সাথে, মনে উঁকি দেয় কিছুক্ষন আগের দেখা এক ছবি। গায়ে হলুদ চাদর , গলায় মালা এক শ্রী মূর্তি, সামনে প্রার্থনারত মানুষ। সেই শ্রী মূর্তি ধারী শ্রীরামকৃষ্ণ ক্ষনিকের জন্য হয়ে যায় তার সারা জীবনের ধর্ম বিশ্বাসের নিরাকার আল্লাহ। নিজের অজান্তেই সে মূর্তির প্রতিও জেগে ওঠে তার অন্তরের কৃতজ্ঞতা।
আজ দিনের শেষে , ভিন্ন ধর্মপথে বিশ্বাসী, সমাজের দুই ভিন্ন স্তরের মানুষ উপলব্ধি করলো, প্রার্থনার আকুলতায় আর প্রাপ্তির আনন্দে, যে পথ ধরে, যে নাম ধরেই তাঁকে ডাকা হোক না কেন, পথ, নাম রূপ নির্বিশেষে তিনি এক ও অনন্য, অনন্ত, অক্ষয় কৃপাসিন্ধু হয়ে ভক্ত হৃদয়ে ধরা দেন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here