করোনা ঈদ
নাসরিন জাহান মাধুরী
যখন ছোট ছিলাম ঈদের চাঁদ দেখার জন্য বাসার সামনে যে বিশাল মাঠ ছিলো একান্নবর্তী পরিবারের ছোট বড় সবাই দৌড়ে যেতাম ইফতারির পরেই, চাঁদ দেখা গেলেই চিৎকার সবার ঈঈঈদ! টিভির সামনে বসে রমজানের ঐ রোজার শেষে, কিংবা চাঁদের পাল্কি চড়ে গান শুনে খুশিতে ডগমগ।
তর সইতোনা, কখন সকাল হবে ঈদের সকাল। নতুন জামাজুতো কখন পড়বো। ঈদের দিনে মায়ের ব্যস্ততা ভোর থেকে, কত রান্নার আয়োজন। সেমাই, পোলাওকোরমা, কত রকমের পিঠা।
আব্বা, কাকা, ভাইয়েরা সবাই সাদা পাজামা পাঞ্জাবি পরে ঈদগাহে। আমরা ততক্ষণে নতুন জামা গায়ে বাসার বড়দের সালাম শুরু করে দিয়েছি। সারাদিন মহানন্দে এবাড়ি ওবাড়ি ঘুরেফিরে ক্লান্ত। তবুও বিটিভির বিশেষ আয়োজনের অপেক্ষায় বসে থাকতাম।
বড় হতে হতে আনন্দ আরো বেড়েছে, অপেক্ষায় থাকতাম কখন আব্বার সাথে মার্কেটে যাবো নতুন ঈদের নতুন জামা যে লাগবেই।
এরপর মায়ের কাছ থেকে শেখা সেলাই করা, নিজের পোশাক বোনদের পোশাক নিজেই ডিজাইন করে, নকশা করে সেলাই করি, ভারতীয় সানন্দা পত্রিকার ডিজাইন দেখে দেখে।
আস্তেধীরে ঈদের দিনে আমরাও আম্মাকে সহযোগিতা করি, রান্নায়, ঘর সাজানোয়। পরিপাটি করে রাখি ভাইবোনেরা মিলে। বাসার আমেজটাই বদলে যেতো। ক্যাসেট প্লেয়ারে বাজতো প্রিয় গান গুলো। মেহমানদের আনাগোনা, যাকে বলে উৎসব মুখর।
তারপর শ্বশুরবাড়িতে ঈদ ছিলো অন্য রকম। হঠাৎই এক পরিবেশ থেকে অন্য পরিবেশ। মন কেমন করতো সবার জন্য, আবার শ্বশুরবাড়ির দায়িত্ব আছে বউদের।
তবুও আনন্দ ছিলো সবাইকে নিয়ে।
যখন নিজের সংসার হলো হাসি আনন্দে কেটে যাচ্ছিলো।
ছোট বোনটাও চলে আসতো আমাদের কাছে, বেশ ভালো কাটতো সময়।
এবারের ঈদ এলো অন্য রূপে। এমন ঈদ জন্মে প্রথম দেখলাম। কোন আনন্দ ছিলো না। পৃথিবীটাই যেখানে অসুস্থ, প্রতিদিন মৃত্যুর মিছিল দীর্ঘতর হচ্ছে করোনার ভয়াল থাবায়, সবাই যখন স্বেচ্ছায় অন্তরীণ নিজেকে বাঁচাতে, পরিবার সমাজকে করোনার থাবা থেকে বাঁচাতে তখন আর ঈদের আনন্দ কোথায়?
তবুও ঈদ বলে কথা। আবার আমার ঈদ দুইটা কারণে ভিন্ন। এক হলো বন্দী ঈদ। দুই হলো, এই প্রথমবার আমার হাজবেন্ড দেশের বাইরে আর আমি ছেলেমেয়েকে নিয়ে ঈদ করছি।ছেলেমেয়েরা আমার হয়ে সব করে দিচ্ছে, অবাক করে দিয়ে মেয়েটাই বেশি রান্না করলো ঈদের স্পেশাল আইটেম। আমিও করেছি,কোন আগ্রহ ছিলোনা তাতে। মাঝেমাঝেই মন খারাপ করে বসে থেকেছি।
একের পর এক ফোন আসছে, নয়তো ভিডিও কলে কথা বলছি।
সকালে প্রমমেই আম্মাকে ফোন করে জানতে পারি আম্মা অসুস্থ, মন খারাপ হয়ে যায় তখনি।
পিয়াল আর চপল ভাইয়ের ফোন বাজেনি। ওরা সব সময় আগে ঈদের শুভেচ্ছা জানাতো।তাই আরো মন উদাস ছিলো, দিনটাও ছিলো মেঘে ঢাকা, আমার মনের মতোই।
তারপরও মন ভালো করার জন্য মেয়েকে নিয়ে ছবি তুললাম। ছেলে ছবি তুলতে আগ্রহী না।চুল বড় হয়ে গেছে বলে। ঈদের জামাতেও যেতে দিইনি সোস্যাল ডিসট্যান্সিংএর বাধ্যবাধকতায়।
এভাবেই কেটে গেলো এক অচেনা ঈদ, হয়তো ইতিহাসের পাতায় রয়ে যাবে ২০২০ সাল এক আতংক হয়ে। চিরচেনা ঈদ আবার সমহিমায় ফিরে আসুক। এটাই কামনা।