শুভ চিন্তার শুভ ভাবনার লেখক নাছরিন আক্তারের কিশোর গল্প “বিপদ সংকেত”

381
নাছরিন আক্তারের কিশোর গল্প “বিপদ সংকেত”

বিপদ সংকেত
নাছরিন আক্তার


লিফ্ট থেকে নেমেই অবাক হলেন প্রফেসার আরমান উইলসন । এটা নিশ্চই বায়োটেকনোলজি সেকশান, দুর্গন্ধে টেকা দায়। তার মানে নিশ্চয় নাম্বার টেপার সময় ভুল হয়েছিলো। আনমনে মাথা চুলকালেন এই আত্মভোলা বিজ্ঞানী, নিজের উপর একটু রাগও হলো। আহা! অনেকটা সময় নষ্ট হলো প্রায় ১ মিনি ৩০ সেকেন্ড । এমনিতেই স্বভাবটা পাগলাটে, রেগে গেলে আরো পাগলামি শুরু করেন তিনি। এই কারনেই প্রতিভাবান এই বিজ্ঞানীর নামের সাথে একগুয়ে, বা একরোখা বিশেষণ লাগাতে ভুল করেন না কেউ । সেদিন ছিলো ত্রৈমাসিক বিশ্ব বিজ্ঞান সম্মেলন । কম্পিউটার সেকশনের শীর্ষ গবেষক আরমান ও যোগ দিয়েছিলেন সেই সম্মেলনে। কথায় কথায় তিনি তার সুপার “বায়োনিক- ম্যান” তৈরীর পরিকল্পনার কথা সকলকে জানালেন।
অত্যন্ত উন্নত সফটওয়্যার দ্বারা পরিচালিত এই রোবটের বুদ্ধিস্তর অনেকটা মানুষের কাছাকাছি। আনন্দ কষ্ট থেকে শুরু করে হিংসা কিংবা ভালোবাসার মতো সূক্ষ্ম অনুভূতির অধিকারি হবে এই রোবট।তবে অন্য বিজ্ঞানীগন এতে খুশী হতে পারলেন না । তাদের ধারণা এই রোবট মানব সভ্যতার জন্য হুমকির সম্মুখীন হতে পারে । তাদের এই অনুমান তারা বিজ্ঞানী আরমানকে বললেন , সাথে এও বললেন এই ব্যাপারটা নিয়ে আরো ভালোভাবে ভেবে দেখতে। এতে রেগে টং হয়ে গেলেন রগচটা বিজ্ঞানী। সবার সামনে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিলেন এক সপ্তাহের মধ্যেই তৈরী করে দেখিয়ে দিবেন তিনি৷ আর তার প্রস্তুতকৃত রোবটের বুদ্ধিমত্তা ও দক্ষতা মানব সভ্যতার কল্যাণই সাধন করবে, অকল্যাণ নয়।
এসব ভাবতে ভাবতেই তার ল্যাবে যাচ্ছিলেন তিনি। কিন্তু ভুল করে লিফ্টের ( 225th up floor)এর বদলে(225th Down floor) চেপে দিয়েছেন। নিজের ভুল বুঝতে পেরে আবার গিয়ে লিফটে চড়লেন। ল্যাবে ঢুকেই ফোন করলেন বিখ্যাত রোবট মেকার্স কোম্পানি মেন্টেয়া ট্রিফ- এ।দু’ সপ্তাহ আগেই অর্ডার দিয়ে রেখেছিলেন একটা আধুনিক প্রযুক্তিসম্পন্ন রোবটের কাঠামোর জন্য। কোম্পানির ম্যানেজার তাকে আশ্বস্ত করলেন আর পাঁচ দিন পরেই তাঁর জিনিস ল্যাবে পৌছে দেয়া হবে।
গত পাঁচ দিন একটানা ভূতের মত খেটেছেন তিনি। খাটুনিটা শারীরিক নয়, মানসিক। বৃথা যায়নি তার এই পরিশ্রম । তিনি পেরেছেন তার স্বপ্নের সেই কম্পিউটারাইজড ব্রেন ও নার্ভস সিস্টেম বানাতে। সকালের দিকে কথামত রোবটের হার্ডওয়ার অংশটি পৌছে গেলো। এখন এর ভিতর সফটওয়ার সেট করলেই হয়ে গেল।খুব যত্নের সাথে কাজটি করলেন তিনি। এরপর শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত আরো একবার চেক করে নিলেন। এখন সম্পূর্ণ রেডি ছয় ফিটের শক্ত-সামর্থ্য চেহারার এযাবৎ কালের সবচেয়ে উন্নত রোবট,শুধু ঘারের কাছে পাওয়ার সুইচটা অন করলে চালু হয়ে যাবে রোবটটি। প্রথমে তিনি দুইহাত কচলে পরম সৃষ্টিকর্তার নাম নিয়ে নরম হাতে ঘারের কাছের সুইচটা টিপে দিলেন তিনি। অপনি দপ করে জ্বলে উঠলো রোবটের সবুজ চোখ দুটো। ঘরঘরে যান্ত্রিক স্বরে জিজ্ঞেস করলো — আমি কে?
তুমি RM-69 উন্নত প্রজাতির রোবট। খুসির সাথে উত্তর দিলেন বিজ্ঞানী। এর পর ঝটপট কয়েকটি কঠিন প্রশ্নের মাধ্যমে রোবটের বুদ্ধিমত্তা পরীক্ষা করলেন। বেশ সফলতার সাথে উতরে গেলো RM-69।এবার বিজ্ঞানী আদেশ করলো টেবিলের উপর রাখা ল্যাপটপটি খুলে পুনরায়,সেট করতে। রোবটটির হাতের তর্জনীর ভিতর থেকে বেরিয়ে এলো একটি অটোমেটিক স্ক্রু- ড্রাইভার। কিন্তু রোবটটি কম্পিউটারের দিকে না গিয়ে এগিয়ে এলো বিজ্ঞানীর দিকে। কিছু বুঝবার আগেই পুরো স্ক্রু- ড্রাইবারটি বিজ্ঞানীর বুকে ঢুকিয়ে দেয়। সাথে সাথেই মারা যায় পৃথিবীর সেরা দশ বিজ্ঞানীর একজন, যিনি দু’ দু’বার Physics এ পেয়েছেন এডিসল পুরস্কার।
বিজ্ঞানীকে মেরে রোবট কর্কষ স্বরে বলতে থাকে – আমি হলাম RM-69 সবচেয়ে উন্নত প্রজাতির রোবট। আমি আমার উপর কারো অর্ডার সয্য করবো না। যান্ত্রিক স্বরে একটানা কথাগুলো বলে ভাড়ি ভাড়ি পা ফেলে ল্যাব থেকে বেরিয়ে যায়।
প্রফেসার রবার্ট মারফি এই মূহুর্তে মহা খুসি। এই মাত্র ইউরেনাস থেকে ফিরে এসেছে স্পেস শার্টল Specific Rafton।
ইউরোনাসে এক সময় প্রাণের অস্তিত্ব ছিলো,তার পূর্বের এই ধারণা সত্য বলে প্রমানিত হয়েছে এই অভিযানে। টেট্রাট্রিলিয়ন বছর আগে কোন না কোন ভাবে এই গ্রহের বায়ুমন্ডলে মিশে গিয়েছিলো এক ধরনের বিষাক্ত গ্যাস,যদিও হিসাবটা আনুমানিক। কীভাবে ওখানে এই গ্যাসের উৎপত্তি হয়েছিলো তা আজও অস্পষ্ট। তবে সে গ্যাসটিকে গ্যাসজারে করে নিয়ে এসেছে মহাকাশচারীরা, যা এখন তার হাতে। এই গ্যাসের বিষক্রিয়ায় ইউরেনাসের প্রাণীজগৎ নিঃশেষ হতে সময় লেগেছিলো মাত্র বাহাত্তর ঘন্টা। কিন্তু বয়ে আনা এই সামান্য গ্যাস যদি কোন ভাবে পৃথিবীর বায়ুমন্ডলে মিশে যায় তাহলে সমগ্র প্রাণীজগৎ নিস্প্রাণ হতে সময় লাগবে মাত্র বত্রিশ ঘন্টা পঁচিশ মিনিট। তাই এটা খুব সাবধানতার সাথে সংরক্ষণ করতে হবে তাকে। মারফি তাই গ্যাস জারটিকে সুপারলক ড্রয়ারে রেখে দিলেন। এটাই এখন তার গবেষণার এক মাত্র বিষয়। এমন সময় খটমট শব্দে পিছনে তাকালেন মারফি, তাকিয়ে চমকে উঠলেন এমন দৈত্যাকার রোবট দেখে। “আমি RM -69 সব চেয়ে উন্নত প্রজাতির রোবট বলেই হাত বাড়িয়ে দেয় দৈত্যকার রোবট প্রফেরার মারফির দিকে।ও আরো বলে আপনার সহকর্মী বিজ্ঞানী প্রফেসর আরমান আমার সৃষ্টি করেছেন। বলেই হাত বাড়ায় গ্যাস জারটির দিকে। এই গ্যাসজারটি আমার চাই প্রফেসর মারফি।” বিস্ময়ের ঘোর কাটতে না কাটতেই নির্বাক প্রফেসার অবাক ও অসহায় চোখে চেয়ে দেখলেন শক্তিশালী Radio Activ – Ray এর সাহায্যে লক সিস্টেমটি নষ্ট করে গ্যাসজারটি নিয়ে চলে গেলো রোবটটি। কিছুক্ষণ পর সম্বিত ফিরে পেয়েই ছুটে চললেন টেলিফোনের কাছে। কয়েক মিনিটের মধ্যে বিশ্ববাসী জেনে গেলো আসন্ন বিপদের কথা। সারা পৃথিবীর ইনফরমিং এজেন্সি গুলো খোঁজতে লাগলো গ্যাসজারসহ রোবট RM-69 কে।
কিন্তু কোথাও রোবটটিকে খোঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। যেন হাওয়া হয়ে গেছি সেটি। এর মধ্যে সকলে লক্ষ্য করলো কোথাও বিজ্ঞানী আরমান নেই। দুইয়ে দুইয়ে চার মিলাতে কারও কষ্ট হলো না। সকলে ছুটলো বিজ্ঞানী আরমানের ল্যাবে।ঢুকেই দেখতে পেলো রোবট RM -69 বিজ্ঞানী আরমানের সাহায্যকারী রোবটের মাথার অংশ খুলে কী যেনো পরীক্ষা করছে।
বিজ্ঞানীদের দেখার সাথে সাথে ঘুরে বসলো সে, ‘আমি RM-69 ‘ আমার ল্যাবে আপনাদের স্বাগতম। নাটকিয় ভঙ্গিতে শুরু করলো সে – আপনাদের অতান্ত দুঃখের সাথে জানাচ্ছি যে, আপনাদের সহকারী বিজ্ঞানী আরমান উইলসন আর নেই। আপনারা নিশ্চই এই গ্যাসজারটির জন্য আমাকে খুঁজছেন। কিন্তু এটা তো আমি আপনাদের দিবো না। আমি বিশ্বের এই বোকা বোকা সকল প্রাণের বিনাশ চাই। এরপর এই বিশ্বকে আমি রোবটিক বিশ্ব বানাবো। প্রফেসর আরমানের হয়ে আমি প্রায় দশ হাজার রোবর মেকার্স কম্পানিকে লক্ষ লক্ষ রোবট বানাতে অর্ডার করেছি।এখন শুধু অপেক্ষা সেই রোবট গুলো তৈরী হওয়ার। সেগুলো হাতে পেলেই কম্পিউটারাইজ ব্রেন সেট করে দিলেই আমার উদ্দেশ্য সফল হবে। এখন আপনারা বোকা প্রাণীকুল মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত হন। ‘এই বলে সায়ংক্রিত পিস্তল বের করলো তর্জনী থেকে RM-69 রোবট। সবাই আতঙ্কে চোখ বন্ধ করলেন।এবার রোবটটি আবার থামলো আর নাটকিয় ভাবে আবার বলতে লাগলো আমার রবোটিক বিশ্বে আপনাদের বিদায় এবং আমাকে তৈরীর জন্য আপনাদের ধন্যবাদ। চরম ধ্বংসের জন্য প্রস্তুত,,,
বলতে বলতে খট শব্দ করে হাঁটু গেড়ে বসে পড়লো ও চোখের সবুজ আলো নিভে গেলো RM-69 রোবটের । সবাই অবাক, রুমে পিনপত্তন নিরবতা । সবাই ধীর পায়ে এগিয়ে গেলো রোবটের কাছাকাছি । এরপর প্রফেসার মারফি পরীক্ষা করে দেখলেন, চার্জ ফুরিয়ে গেছে রোবটের।
পরীক্ষামূলক ভাবে বিজ্ঞানী আরমান সামান্যই চার্জ দিয়েছিলেন রেবটটিকে।
বিজ্ঞানীরা নিস্ক্রিয় করে দিলেন রোবটের কম্পিউটারাইজ ব্রেন। বেঁচে গেলো বিশ্ববাসী আসন্ন মৃত্যুর হাত থেকে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here