রামমণির রাখি বন্ধন
শ্রীরূপা চক্রবর্তী
বয়স তার বছর দশেক হবে। কিছু দোকানী “রামমণি রামমণি” করে ডাকতে ডাকতে, সে এখন সকলের রামমণি। না, চণ্ডীদাসের রামমণির মতো রজক কন্যা সে নয়, পিতৃপরিচয়হীন পথশিশু সে। মায়ের সঙ্গে স্টেশন চত্বরেই তার বাস। তার এই “রামমণি” নামের আড়ালে একটা ছোট্ট গল্প আছে। স্টেশন সংলগ্ন এক হনুমানজীর মন্দিরে প্রায়ই সে যায়। মন্দিরে গিয়ে কারোর কাছে কিছু চাইতে কিন্তু তাকে দেখা যায় না। কমলা সিদুঁরে লেপা হনুমানজীর দিকে শুধুই তাকিয়ে থাকে। কি দেখে, সে রামমণি আর তার হনুমানজীই শুধু জানে। রামভক্ত হনুমানের ভক্ত ছোট্ট মেয়ে। সেই থেকে সকলের মুখে তার নাম হয়ে যায় রামমণি। নিত্য রেলযাত্রীরাও তাকে ঐ নামেই চেনে।
কয়েক দিন ধরেই রামমণি দেখছে, বিভিন্ন দোকানের বাইরে, আবার অস্হায়ী মাচা করেও বিভিন্ন রঙের রাখি বিক্রি হচ্ছে। এই বড় বড় ফুলওয়ালা, কিছু আবার সরু ছিপছিপে, কিছু বা পেখম লাগানো, আর কত তাদের রঙ!! মুগ্ধ হয়ে দেখে সে। সে জানে এসব চুড়ি দুল নয় যে নিজে পরবে। মায়ের কাছে সে জেনেছে এসব ভাইদের হাতে বেঁধে দেওয়ার জন্য। কিন্তু তার নিজের তো কোনো ভাই নেই। তাহলে? মনের মধ্যে একটা মুখ উঁকি দেয়। বড় সাধ হয়….
আজ রাখি পূর্ণিমা। সকাল থেকে রামমণির মনটা উদাস হয়ে আছে। রোজের হাত-পাতায় তার আজ মন নেই। তার চোখ মন কেড়ে নিয়েছে, ভাইদের , দাদাদের হাতে বাঁধা রাখি। রোজের মতো বিকেলে বিলিতি নামের কেকের দোকানের সামনে গিয়ে দাঁড়ায় সে। ওখানকার কেক পেস্ট্রি বড় প্রিয় তার। কারো কারো বদান্যতায় তার স্বাদ সে ইতিমধ্যে পেয়েছে। কিছুক্ষণ পর এক মহিলা দোকান থেকে বেরিয়ে আসে। উৎসব পার্বনের দিনে, উৎসব পার্বনের গুণেই হয়তো আমাদের ভিতর “ভালো আমি”টা তার উপস্থিতি জানান দিয়ে থাকে।
রামমণির দিকে চোখ পড়তেই, সে শুধোয়,
—–কিছু খাবি?
অন্যদিন হলে ঘাড় কাত করে তৎক্ষণাৎ উত্তর আসতো ‘কেক’। কিন্তু আজ তার কেক পেস্ট্রিতে রুচি নেই।
জামার খুঁট ধরে, মাথা নীচু করে সলজ্জ হেসে, উল্টো দিকের দোকানে থরে থরে সাজানো রাখিগুলো দেখিয়ে সে বলে ,
——-একটা রাখি কিনে দেবে?
——-রাখি কিনবি? তা বেশ তো, কোনটা পছন্দ আমায় বল্।
এতদিনের চেপে রাখা সাধ, এক লহমায় পূরণ হতে চলেছে। আনন্দে হারা রামমণির পছন্দ করতে একটু সময় লাগে। একটা বড় ফুলতোলা রাখি দেখিয়ে সে বলে,
——-দুটো কিনে দেবে?
মহিলার মুখে সস্নেহ হাসি,
——-তোর বুঝি দুটো ভাই?
——-না গো, একটাই ভাই, দু হাতে দুটো পরাবো, সুন্দর লাগবে না?
——–খুব সুন্দর দেখাবে, কিন্তু রাখি পরিয়ে ভাইকে কিছু খাওয়াবি না?
উত্তরের অপেক্ষা না করে, ভদ্রমহিলা আবার দোকানে গিয়ে দুটো চকোলেট পেস্ট্রি রামমণির হাতে দিয়ে বলে,
——–চল্ স্টেশনেই তো থাকিস্ বললি, ভাই কে কেমন করে রাখি পরাস্ , একটু দেখে যাই। কি রে? নিয়ে যাবি না?
রামমণি মহানন্দে এক হাতে রাখির প্যাকেট, আরেক হাতে পেস্ট্রির প্যাকেট ঝুলিয়ে চলল। এতক্ষণে অবশ্য সেই মহিলা তার ‘কাকী’ হয়ে গেছে।
——-জানো কাকী, আমি আর মা , ঐ যে স্টেশনে থাকি, পাশেই একটা চায়ের দোকান আছে, রফিকুল ভাই ওখানে কাপ মাজে, গ্লাস ধোয়, আমার থেকে ছোট, কিন্তু কত রাত অব্দি কাজ করে!!!
——-তুই ঐ ছোট্ট রফিকুল ভাই কে খুব ভালবাসিস বুঝি?
রামমণি আপন মনে বলে চলে,
——–ঈদের সময়, রফিকুল লুকিয়ে আমার জন্য ফির্ণি নিয়ে আসে। ওরা তো গরীব, তাই লুকিয়ে আনতে হয়। ঐ রাখি দুটো ওকেই তো পরাবো।
4 নং প্ল্যাটফর্মের ভিতর দিকে চায়ের একটা ছোট্ট দোকান। তারই পাশে রামমণি আর তার মায়ের ছেঁড়া, তালি দেওয়া, কুড়িয়ে পাওয়া জিনিসের সংসার।
চায়ের দোকানে একটা ছোট ছেলে কাজ করছে। বোঝা গেল সে-ই রামমণির রফিকুল।
রামমণি তার কাছে গিয়ে বলল,
——দেখ্ ভাই !! কি বড় বড় দুটো রাখি কাকীটা কিনে দিয়েছে! এগুলো আজ তোকে পরাবো। তুই-ই তো আমার ভাই।
এই বলে শীর্ণকায় দুটো কচি হাতে, ফ্রকপরা দিদি রাখি বেঁধে দেয়। রাখি বাঁধা কচি হাতের মালিকের ততক্ষণে এক মুখ নির্মল হাসি।
এতক্ষণ চায়ের দোকানের লোকটি ব্যবসা ভুলে মগ্ন হয়ে সব দেখছিলো। এ দৃশ্য হয়তো তাকেও কোনো ফেলে আসা অতীতে নিয়ে গিয়েছিল। নিজের আদরের বোন বা হয়তো কত শত আব্দার
না- করতে-পারা দিদি, হয়তো দীর্ঘদিন দেখা হয়না, হয়তো বা অন্য কিছু….
নিজেকে সে সামলে নিয়ে বলে,
——-নে, রাখি তো পরালি, প্যাকেটে তো আবার কি সব খাবারও আছে দেখছি, বেঞ্চি তে বসে খা তোরা, আমি ততক্ষণ একাই এদিকটা সামলাই।
রামমণি আর রফিকুল, দুই ভাই বোন, বেঞ্চে বসে পা দোলাতে দোলাতে পেস্ট্রি খেতে থাকে। কত কলকল তাদের কথা, কত হাসি, আনন্দ। তাদের সে হাসি আনন্দের ভিতর, রাখি বন্ধনের মৈত্রীর বার্তা চিরন্তন হয়ে ফুটে ওঠে