“বিরঙ্গনা আশা ” গল্পটি লিখেছেন লন্ডন থেকে কলমযোদ্ধা মিনু আহমেদ

435

বিরঙ্গনা আশা—||

—মিনু আহমেদ।

আমাদের গ্রামের রহিমা একটি কন্যা সন্তান জন্ম দিয়ে তার নাম রেখেছিলো আশা।দুঃখ দুর্দশা আর বীভৎসতার যুগেও আশা ছিলো তার বাবা-মায়ের স্বর্গীয় সুখ,অতৃপ্ত ভালোবাসা।
দিনে দিনে আশা বড় হচ্ছে।তাই মা-বাবার দুশ্চিন্তা বাড়ছে।আশা কেনো কথা বলে না!আশার মুখে কেন ভাষা নেই?আশার মুখপানে চেয়ে তার মা ফরিয়াদ করে—হে আল্লাহ্!কেনো এমন হলো?কেনো আশার মুখে ভাষা নেই?
এভাবেই অস্থিরতার মধ্যে দিয়ে তার বাবা-মায়ের দিন কাটে।আশা কথা বলতে পারে না ঠিক কিন্তু সে সব কিছু বুঝতে পারে।মা-বাবা যখন ঘুমিয়ে থাকে।আশা তখন চাঁদনী প্রহর রাতে খোলা আকাশের নিচে বোবা ভাষায় অ্যা,অ্যা,এ্যা,এ্যা,উও,উও চিৎকার করে কি যেনো সব বলে।
তার ভাষা কেউ বুঝতে পারে না।তবে বোধ করতে পারি—হয়তো সে খোদার কাছে ফরিয়াদ করে বলে
হে আল্লাহ্!কেনো অন্যদের মতো আমার মুখে ভাষা দিলে না?কেন আমায় কথা বলার শক্তি দিলে না?
এভাবে রাত-বিরাত চিৎকার করে রোজ বুক ভাসায় আশা।কিন্তু তার চিৎকারে সৃষ্টিকর্তার ঘুম ভাঙে না।
নদীর স্রোতের মতো সময়ের তালে তালে আশার মা- বাবার দুশ্চিন্তা দিন দিন বেড়েই চলছে।
আশা কথা বলতে না পারলেও খুব ভালো ছাত্রী ছিল ।স্কুলে সব সময় সেরাদের সেরা হতো।এসএসসি পরীক্ষাতেও বেশ ভালো রেজাল্ট করে পাশ করে।
আশার মা-বাবা আশাকে তাদের মফসলের একটি কলেজে ভর্তি করে দেয়।আশা বোবা বলে কলেজে অনেকেই আশাকে ডিস্টার্ব করে।আবার অনেকে আশাকে কুপ্রস্তাবও দেয়।সভ্যতার যুগে যাকে বলে ইপ্টিজিং।
প্রদীপ নামের একটি ছেলে আশার খুব ভালো বন্ধু। ওরা একে অপরের মতো কথা বলতে না পারলেও পরস্পর পরস্পরের মাঝে নব সৃষ্টির আলো দেখতে পেয়েছিলো।
বাবা-মা সব সময় চিন্তা করতো বোবা মেয়েটাকে কোথায় বিয়ে দিবে?আশা বোবা হলেও রূপে-গুণে ছিলো অনন্য।কিন্তু শুধু রূপ গুণ দিয়ে কি হবে?এ নৃশংসতার যুগে বাঁচতে হলে মুখের ভাষা চাই।ভাষা বিনে হিংস্র শ্বাপদের মোকাবেলা করবে কি করে?
মুখে যদি ভাষা না থাকে—মানুষ আর পশু একই পাল্লায় মাপে মানুষ।তাই ভাষা ছাড়া সমাজে কি মূল্য আছে আশার?
আশা প্রতিদিন নিভৃতে জালানার পাশে দাঁড়িয়ে বাক প্রফুল্ল পথচারিদের দেখতো।
তখন ১৯৫২ সাল।হঠাৎ করে শহরে-বন্দরে পথে– রাজপথে মিছিল আর মিছিল।আশার শৈশবের এক বন্ধুর নাম বরকত।আশা তার ভাষায় বরকতের কাছে
জানতে চাইলো শহরে-বন্দরে এতো মিছিল কেন?কি হয়েছে দেশে—ভাষা নিয়ে?
বরকত অনেক চেষ্টা করে আশার মত করে আশাকে বুঝাতে চেষ্টা করলো।আমাদের বাংলা ভাষা নস্যাৎ করতে পাকিস্তানিরা উঠেপড়ে লেগেছে।তারা চায় আমাদের বাংলা ভাষার বাদ দিয়ে উর্দু ভাষাকে রাষ্ট্র ভাষা বানাতে।কিন্তু আমরা তা মানতে রাজি নই।তাই শহরে-বন্দরে এর প্রতিবাদে মিছিল মিটিং চলছে।এ কথা শুনে আশা মনে মনে পণ করলো–সেও মিছিলে যাবে।যে ভাষার জন্য আশার সংসারের আলো দেখা হলো না।সেই ভাষার জন্য সে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করবে ।এটাই ছিলো আশার পণ।
আশা বরকতের সাথে রাজপথে মিছিলে গেলো।
মিছিলে জয়ের ধ্বনিতে আকাশ-বাতাস কম্পিত হতে লাগলো।আশার মুখে কোনো শব্দ নেই।কিন্তু চোখে- মুখে ছিলো বিজয়ের গর্জন।
আশার চারিদিকে চিৎকার করে সবাই ভাষা জন্য স্লোগান দিচ্ছে।সেই স্লোগানে বোবা আশার চোখেও ফুটে উঠেছে ভাষার প্রাণ।নির্বাকে আশার অন্তর থেকে বেরিয়ে আসছে ভাষার জয় ধ্বনি।আশাও স্লোগান দিচ্ছে আশার ভাষায়।স্লোগান দিতে দিতে হঠাৎ মনে হলো—আশা তার কলেজ ব্যাগ কলেজে ফেলে এসেছে।
তাই ব্যাগ আনতে আশা কলেজে ফিরে গেলো কিন্তু আশা কলেজে ঢুকতেই তার পিচু পিছু কিছু বখাটে ছেলেরাও কলেজে ঢুকলো।তারা আগে ঐ কলেজেই পড়তো।
ফাঁকা কলেজে আশাকে একা পেয়ে তারা আশাকে বিরক্ত করতে লাগলো।আশার নির্বাকতা দেখে এক পর্যায়ে তারা আশার হাত ধরে টানাটানি করছিলো।
কিন্তু আশার মুখে ভাষা না থাকলে কি হবে!মনে প্রচুর সাহস ও জেদ ছিলো।
সেই সাহস আর জেদের তীব্রতায় আশা ঐ বখাটে ছেলের গালে স্ব-জোরে একটা থাপ্পড় মারলো।থাপ্পড় খেয়ে বখাটে ছেলেরা আরো উত্তেজিত হয়ে আশার উপর ঝাঁপিয়ে পড়লো।আশাকে সবাই মিলে ধর্ষণ করলো।ধর্ষণ শেষে বখাটেরা যখন খুশিতে আত্মহারা ।ঠিক তখনই মাটিতে পড়ে থাকা পিস্তলটি হাতে তুলে নিয়ে—পর পর দুটি গুলি করলো আশা।গুলি খেয়ে দুই বখাটে মাটিতে লুটিয়ে পড়লো।
যে ভাষার জন্য আশা রাজপথের মিছিলে মিছিলে
স্লোগান দিচ্ছিলো।আজ তার মুখে—সেই ভাষার বোল না থাকার কারণে সে নিজের সম্ভ্রম রক্ষা করতে পারেনি।
তাই সদ্য সব কিছু হারিয়ে মুক্তির মিছিলে দাঁড়িয়ে সেই ভাষাভাষির কালশত্রুদের প্রাণনাশে আনন্দে আত্মহারা হয়ে উঠেছিলো আশা।
কিন্তু তারাও আশাকে আর বাঁচতে দিলো না।হঠাৎ একটি গুলি এসে স্ব-জোরে আশার বাম পাঁজরে বিঁধলো।আশা ঈষৎ অ্যা…করেই মাটিতে লুটিয়ে পড়লো।বখাটেরা দৌড়ে পালিয়ে গেলো।কলেজের কেয়ার-টেকার গুলির আওয়াজ শুনে দৌড়ে এসে আশাকে নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি করলো।
আজ বিরঙ্গনা এক ভাষা যুদ্ধার বুকে বিঁধলো গুলি আর রক্তাক্ত হলো কলেজ,রাজপথ।আশা তার রক্ত দিয়ে লিখে গেলো ভাষার মিছিলে লাঞ্ছিত বিরঙ্গনার নতুন স্লোগান।
প্রদীপ শুনে দৌড়ে আসলো।আশাকে বুকে জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে বলছে—আশা কথা বলো?আশা কথা বলো?আশা প্রদীপের চিৎকার শুনলো না।
আশা আজ আশার আলো নিভিয়ে নিস্তব্ধের ওপারে চলে গেছে!ভাষার যুদ্ধে আশা আজ লাঞ্ছিত বিরঙ্গনা হয়েছে।আর প্রদীপ আশাকে জড়িয়ে ধরে চিৎকার করছে।
গল্পগ্রন্থ—ধর্ষিত সমাজ।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here