আশালতা – ( এক যোদ্ধা মায়ের গল্প )
অজন্তা প্রবাহিতা
সময়মতো বাড়ি থেকে বেরিয়েও একটু দেরি হয়ে যাওয়াতে গড়িয়া স্টেশনে ঢুকেই বারুইপুর লোকাল ধরবার জন্য পড়ি কি মরি করে ছুটতে লাগলো আশালতা। ছুটতে গিয়ে কিভাবে যেন চটিটা উল্টে গেলো, পায়ের বুড়োআঙুলের নখটাও তার সাথে উল্টে গেলো ,সাথে সাথে রক্ত বেরোতে আরম্ভ হলো। কিন্তু তখন কি আর অত দেখবার সময় আছে কারোর ? দশটা পনেরোর লোকাল মিস হয়ে গেলে খুব মুশকিল হয়ে যাবে। আজ অফিসে অনেক কাজ। কোনোমতে ভীড় ঠেলে উঠে একটা জায়গা পেয়ে বসে একটু দম নিয়ে বোতলের জলে হাতের রুমাল খানা ভিজিয়ে নিয়ে রক্ত পরিষ্কার করে ব্যান্ডেড খানা লাগাতেই মায়ের ফোন ঢুকলো ,
“হ্যালো মা , সময়মতো স্টেশনে পৌঁছে গেছি, সব ঠিক, শুধু ওই দৌড়ুতে গিয়ে কিকরে পায়ের বুড়ো আঙুলের নখটাতে লেগে গেছিলো। চিন্তা করোনা বেন্ডেড লাগিয়ে নিয়েছি। ট্রেন ছেড়ে দিয়েছে। এতো আওয়াজ তোমার কথা ঠিক মতো শুনতে পারছি না,পরে কথা বলছি।
পাশে বসে থাকা মেয়েটি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো ,” দিদি নখটাতো একদম উপরে গেছে , বেন্ডেডের পাশ দিয়েও রক্ত পড়ছে , কি করে নাববেন ?”
একটু হেসে আশালতা উত্তর দিলো , “নাবতে তো হবেই , নতুন চাকরীতে জয়েন করেছি , ব্যাথা, রক্তপাত এসব নিয়ে ভাববার সময় কোথায় ? দেখি ,অফিসের পরে বাড়ি যাবার সময় টিটেনাসের ইঞ্জেকশনটা নিয়ে ভালোকরে ড্রেসিং করে নেবো। স্টেশন আসছে ,উঠি।”
” সাবধানে নামবেন দিদি। ”
” হু “, বলে দরজার দিকে এগিয়ে গেলো আশালতা। টনটন করছে পা’টা।কিন্তু এখন ব্যাথার কথা ভাবলে চলবে না। অফিসে টাইমের ভীড় ঠেলে দরজা অব্দি পৌছুনো মানে এক প্রকার যুদ্ধ, তারমধ্যে খেয়াল রাখতে হচ্ছে কোনোভাবে যেন ব্যাথা জায়গায় কারো পা না পড়ে যায়। কোনোপ্রকারে ব্যালান্স করে ট্রেন থেকে প্ল্যাটফর্মে পা রাখতেই ব্যাথাটা খোঁচা দিয়ে উঠলো। উফফ ! মা গো ! হেরে গেলে চলবে না আশা , হেঁটে অটো স্ট্যান্ডে পৌঁছুতে হবে।” এই বলে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে ছুটতে লাগলো অটো স্ট্যান্ডের দিকে।
“দেখি তোমার কি হয়েছে ,এমন করে খুঁড়িয়ে হাঁটছো কেন ? “অফিসে ঢুকতেই বিদিশাদি বলে উঠলো।
“আর বোলো না , আজ সকালে দেরি হয়ে গেছিলো। উজানকে স্কুল বাসে চাপিয়ে দিয়ে দেখি অটোর বিশাল লাইন , সেখানেও পাঁচমিনিট দেরি হয়ে গেলো। স্টেশনে পৌঁছে দেখি ট্রেন ঢুকছে, ছুটতে গিয়ে জুতোটা উল্টে গেলো তারপর এই কান্ড। বেন্ডেড সঙ্গেই ছিল সেটা লাগিয়েছি কিন্তু তাতে কি আর হয় ? “
“ভালো করে ধুয়ে এসো ক্ষত জায়গাটা ,অফিসের ফার্স্ট-এড বাক্স আছে ,বাহাদুরকে বলে দিচ্ছি একটু ভালো করে ব্যান্ডেজ করে দিতে আমাদের আজ সাইটে গিয়ে সারাদিন দাঁড়িয়ে থেকে কাজ করতে হবে।তাই ভালোকরে বেঁধে নাও ,একটা পেন কিলার দিচ্ছি খেয়ে নিয়ে চলো। সময়মতো না পৌঁছালে অনেক হ্যাপা সইতে হবে। “
ঠিক আছে বিদিশাদি ।
ওই অবস্থাতেই সারাদিন কাটিয়ে রাতে বাড়ি ফিরতেই মায়ের ফোন , ” আশা, পা কেমন আছে ?”
” একদম ঠিক আছে মা। ও নিয়ে ভেবো না। “
” কি খাবি ? রান্না আছে ?”
” সকালে ডাল করে রেখেছিলাম , ওমলেট করে নেবো। “
” তুই কি টিটেনাস নিয়েছিস ?”
” হ্যা মা , আসার সময় নিয়ে নিয়েছি। সাথে পেনকিলারও কিনে নিয়েছি। “
” আজ দেরি করিস না। শুয়ে পড়িস। “
” হ্যা মা ! গুড নাইট। “
“মাম্মাম ! তুমি কি করে ব্যাথা পেলে ?” উজানের প্ৰশ্ন।
“ও কিছু না বেটা, সেরে যাবে , চিন্তা করো না। তোমার হোমওয়ার্ক নিয়ে এসো। “
” আমি সব হোমওয়ার্ক করে ফেলেছি ,দেখো। “
” বাহ্ ! এই তো ,গুড বয়। ইটস এইট থার্টি , চলো ডিনার সেরে ফেলি ,তারপর স্লিপিং টাইম। “
“ইয়েস মমি। “
উজানকে শুইয়ে দিয়ে নাইট ল্যাম্পটা জ্বেলে দিতেই উজানের আবদার , “একটু আমায় আদো করে দাও। “
” ওকে ,মাই বেবি। “
উজানের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে ওকে দেখতে লাগলো আশা।
ন’বছরের উজান নিজের বয়সী বাচ্চাদের তুলনায় অনেক শান্ত। কোনো কিছু নিয়ে বায়না বিশেষ করে না। ওর এই স্বভাবের জন্য একা হাতে সব সামলাতে পারছে আশা। ও যদি অবুঝ হতো তাহলে খুব মুশকিল হতো এতো কাজ করা।
ওকে ঘুম পাড়িয়ে উঠতে যাবে ,”মাম্মাম ! ধর্ম কি হয় ?”
” তুমি ঘুমাও নি বাবু ?”
” না মা ! আজ স্কুলে কৌশিক , কিংশুক কেউ আমার সঙ্গে ভালো করে কথা বলছিলো না।
ওরা বললো ,আমি মুসলিম ,একদম ভালো নোই। “
কথাগুলো কানে যেতেই যেন বিদ্যুৎ স্পর্শ হলো শরীরে ,অজানা আশংকায় ভয়ে বুক কেঁপে উঠলো আশালতার।
এক হাতে উজানের মাথাটা শক্ত করে বুকে চেপে ধরে জিজ্ঞেস করলো, ” দুবছর বাদে তোমরা আবার স্কুলে যাচ্ছো। কত গল্প ,কত খেলা জমে আছে তোমাদের ,সব বাদ দিয়ে এইসব কথা কেন ?”
” ওরা একটা সিনেমা দেখেছে , সেখানে মুসলিমরা খুব দুস্টু, হিন্দুদের ধরে ধরে মারছিলো। তাই ওরা এমন বললো। “
ছেলের মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে আশা বলে , “ধর্ম মানে বিশ্বাস। ধর্ম মানে ডিসিপ্লিন,আবেগ,সংযম আরো অনেক কিছু। যেমন , তোমার মামু প্রতি কালীপূজোতে উপোষ করে ,মামুর বিশ্বাস উপোষ করে মায়ের পুজো করলে সারাবছর অনেক শক্তিশালী থাকবে অনেক কাজ করতে পারবে। দিদা প্রতিবছর নিয়ম করে শিবরাত্রি করে যাতে দাদু খুব ভালো থাকে , আমি রোজা করি যাতে তোমার বাপী যেখানেই থাকুক যেন খুব ভালো থাকে। “
” মাম্মাম ! কিংশুক আর কৌশিক আমার বেস্ট ফ্রেন্ড ,ওরা কথা না বললে আমার স্কুলে যেতে ইচ্ছে করে না। “
” একদম ভেবো না সোনা , কাল আমি ওদের ফেভারিট চকোলেট কিনে দেব ওদের
জন্য,টিফিনে শেয়ার করে খেও ,দেখবে আবার সব আগের মতো হয়ে গেছে। এবারে ঘুমিয়ে পড়ো প্লিজ ,আমায় কিছু লেখা এডিট করে নীহার আংকেলকে পাঠানোর আছে। “
” তাড়াতাড়ি এসে যেও কিন্তু , তোমার গন্ধ না পেলে আমার ঘুম আসে না। “
” হ -মমম। তাই হবে আমার দুষ্টু সোনা। “
ঘর অন্ধকার করে দিয়ে টেবিল ল্যাম্পের আলোয় ল্যাপটপ খুলে কাজ শেষ করতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো আশালতা।
কাজ শেষ করে টেবিল ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলো , সোয়া বারোটা বাজে। সকালে ছ’টার মধ্যে উঠতে না পারলে সময়মতো ট্রেন ধরতে পারবো না। । এদিকে পা -টা বেশ ফুলেছে। হাতে ইনজেকশনের ব্যাথা। কোনো রকমে নিজেকে বিছানায় ফেলে পাশে সাইড টেবিলে রাখা অপূর্বের ছবিটা তুলে নিয়ে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। বুকের ভেতর থেকে কান্না ঠেলে বেড়িয়ে আসতে চাইছে।
” অপু ! তোমার কি এতো তাড়া ছিল যাবার ? একবারও ভাবলে না ছোট্ট বাচ্চা নিয়ে এতবড়ো জীবন আমি একা কী করে কাটাবো ? রোজ যুদ্ধ করে করে আমি ক্লান্ত হয়ে পড়ছি। তারওপর নিত্যনতুন ভাবে ধর্মের লড়াই উঠে আসছে। এ লড়াইয়ের তো কোনো শেষ নেই। সেই ছোট্টবেলায় তুমি আমায় ভালোবেসেছিলে ,আমি তোমায়। ধর্ম কখনোই আমাদের মাঝখানে কোনো রকম ভেদাভেদের দেয়াল তুলতে পারে নি। কিন্তু , আমাদের ছোট্ট বাবু যে এই বয়সেই ধর্মের বিভেদ অনুভব করতে পারছে। কি করে সামলাবো ওকে ? আমি একা পারছি না সামলাতে। তুমি এসো আমার কাছে। “
জলের ধারায় দুচোখ বুজে এলো। এক দমকা হাওয়ায় পায়ের কাছে খোলা জানলার পর্দাটা নড়ে উঠলো ,ঘরে কারো উপস্থিতি অনুভব করলো আশা। খুব পরিচিত একটা গন্ধ। অপু।
” হ্যা আমি ,আশা। “
” ছুটে গিয়ে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো আশা। ডুকরে কেঁদে উঠলো। তুমি ছাড়া আমি বড্ডো একা। আমার হাসিমুখটা সবাই দেখতে পায়। কিন্তু হাসির পেছনে আমার কষ্ট ,জ্বালা ,যন্ত্রনা উদ্বিগ্নতা কেউ দেখতে পায় না। “
” আমি তোমার কাছেই আছি আশা। তোমার থেকে দূরে গিয়ে কী করে থাকবো বলো ?”
” সত্যি বলছো, অপু ? আমাদের ছেড়ে কোথাও যেও না। আমি বড্ডো একা হয়ে যাই। “
নিঃশব্দ রাতে হাওয়ার সাথে গান ভেসে আসে –
বিরহ মধুর হল আজি মধুরাতে ।
গভীর রাগিণী উঠে বাজি বেদনাতে ॥
ভরি দিয়া পূর্ণিমানিশা অধীর অদর্শনতৃষা
কী করুণ মরীচিকা আনে আঁখিপাতে ॥**
অজন্তাপ্রবাহিতা