সমাজ-সভ্যতার সাম্য দর্শনের কলামিষ্ট- ড. সন্দীপক মল্লিকের বিশ্লেষণ ধর্মী লেখা “অঞ্জলিকবিতা,চৈতন্য-মুগ্ধতার আভরণ”

378
ড. সন্দীপক মল্লিকের বিশ্লেষণ ধর্মী লেখা “অঞ্জলিকবিতা, চৈতন্য-মুগ্ধতার আভরণ”

অঞ্জলিকবিতা, চৈতন্য-মুগ্ধতার আভরণ
ড. সন্দীপক মল্লিক

কবিতা অনুভবের সম্পূর্ণতা-সঞ্চয়নের দিশা। কবিতা নয়ন-আলপনার মমতা-মুগ্ধ আলো। কবিতা আয়ুষ্মান প্রেরণার পরাগ। কবিতা মনন-বৃত্তির ধ্যানসিদ্ধি অবিনাশী সজ্জা। কবিতা পূর্ণাভ বাসনার আদরভরা শব্দ-শুদ্ধ রূপমা। কবিতা জীবন-স্বস্তির অমৃতময় প্রকাশনা। কবিতা মাঙ্গলিক ভাব-শয্যার প্রেষণা-অঞ্জলি। কবিতা প্রেম-মাধুরীর গীতময় গৌরব। কবিতা সাত্বত জীবন-সত্যায়নের স্তুতি-বিন্যাস। কবিতা সর্বজনীন বোধি-বিভূত স্বারূপ্য। কবিতা চৈতন্য ও মুগ্ধতার আভরণ।
‘কবিতা’ শব্দের ব্যুৎপত্তি : কবিতা [কবি+তা(তল্)]।(হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়, বঙ্গীয় শব্দকোষ, প্রথম খণ্ড ; নতুন দিল্লী : সাহিত্য অকাদেমি, ১৯৯৬ খ্রি., পৃ. ৫৪১) কবি[কব্(বর্ণন। স্তুতি, প্রশংসা)+ই(ইন্)।(ঐ)
ব্যুৎপত্তির বিস্তৃতি অনুভবসিদ্ধ হয় মননে। ব্যক্তিক বাসনায় দেহজ পুলকের সঞ্জীবিত হয় লীলা । বিচিত্র বিষয় ও বস্তুর সংসর্গ বৃত্তায়ত করে মনোদীপায়নী শক্তিকে। তবে আয়ুষ্মান প্রজ্ঞা-পরিব্যাপ্তিই মৌলিক কল্যাণ-কান্তিকে নিরুপদ্রব করে। অবিনাশী বর্ণনার ছন্দায়ন কবিতার চারু-শ্রীকে করে প্রসন্ন।
১.
সৃজন-সম্পূর্ণতার এক মহারহস্যের লীলাময় প্রকাশ কবিতার শৈলী। ধ্যানায়ত পুলক আর আত্মদীপ্ত মহিমায় অলঙ্কৃত হয় কবিতার পারাবত। আয়ু-বৃদ্ধিদ প্রভুত্ব আর কালিক অভিজ্ঞার প্রত্যয়ন কবিতার শরীর বিনির্মাণ করে। ওজস্বী বিশ্বাস আর শাশ্বত শ্রী-অঙ্কুরের সম্প্রীত বাতায়ন খুলে দেয় কবিতা। প্রেরণা-প্রভাতের অমলিন আবর্তনে বোধি-স্বত্বের চারুতা আত্মঃস্থ করে কবিতা।
কবিতা ব্যক্তিক বিভূষণা। কবিতা সর্বজনীন প্রাণের অনুরণনা। কবিতা বিশ্ববীক্ষা-সমুন্নত ভাবায়তনের আরতি। কবিতা অর্থ-দীপান্বিত হৃদয়-বেদনার দিশা। কবিতা সত্য-মগ্নতার সম্বেগী আলেখ্য। কবিতা রূপশ্রীমান অন্তরের বৈভব। কবিতারই এক নৈর্বক্তিক প্রসূন অঞ্জলিকবিতা।
কবিতা বস্তুর প্রসূন-সম্ভূতি। কবিতা দর্শন-সমন্বয়ী হৃদয়ের বিন্যাস। কবিতা দ্বিদল-জ্যোতির ঐকান্তিক প্রলম্বন। কবিতা আর্থ-অভিনিবেশী জীবনের প্রক্ষালন। কবিতা সমাজ-সন্দীপী প্রত্যয়নের মোহনা। কবিতা যৌবরাজ্য-বিভূষিত সত্য। কবিতা প্রার্থনালব্ধ ঐশী-অধিকার। কবিতা জৈবী শুদ্ধতার প্রকৃষ্ট নিকেতন। কবিতা মত-আয়ত্ব বাণী-সংঘটক।

কবিতা নব-রস-সঞ্চয়নের লীলাময় নিলয়। কবিতা সময়-সম্পন্ন মানবিকতার অনাহত আবহ। কবিতা আবৃত-আবিলতা-নিঃশেষণের প্রগাঢ় অভিধা। কবিতা আত্ম-সন্তাপ-সংবৃত আলাপন-ঐশ্বর্য। কবিতা নিবিষ্ট নয়নের নিমগ্ন নীড়। কবিতারই প্রণব-সমুত্থিত অনুভব অঞ্জলিকবিতা।

কবিতা-আনন্দ-আর্বিভূত শব্দ-বাক্য-বিধায়না। কবিতা ক্রন্দন-চঞ্চল নিরীক্ষার অপাপবিদ্ধ প্রসারণা। কবিতা ক্রমান্বয়ী আত্ম-সমীক্ষণ । কবিতা বিনষ্টি-নিঃশেষণের বাঙ্-মানস-গোচর-বিভা। কবিতা বিবেকের আরক্তিম-অব্যর্থ বিন্যাস। কবিতা পরম-সৃজন-লীলা-সমুত্থিত রূপায়ণা। কবিতা অপাপবিদ্ধ কাল-স্বস্তির দীপ্তি। কবিতা বোধ-সম্পৃক্ত নির্মেদ চারুকথন। কবিতা বোধি-বিধৌত অলঙ্কার। কবিতা মনস্বিতা-উর্বর সমীক্ষণ-সংবৃতি। কবিতা অস্তিত্বের সৌরভ-চন্দন। কবিতারই এক অবিনশ্বর সৃজন-শ্রীশুদ্ধি অঞ্জলিকবিতা।

২.
কবিতা শরীর-বৃত্তের শুদ্ধ-সঞ্চালক। কবিতা মনোমোহিত অগ্রণী প্রভাবক। কবিতা অনলস শরীরী শক্তির বান্ধব-জ্যোতি। কবিতা শরীরী সৌন্দর্যের অব্যর্থ মাধুরী। কবিতা প্রেম-শূন্যতার ফাগুন। কবিতা শ্রী-হস্ত-যত্নের শ্রম-বিশ্বাসী রূপায়ণা। কবিতা দৈ¦ত-সত্তার সম্মিলনী সঞ্চয়ন। কবিতা অদ্বৈত-সত্তার মদিরতা। কবিতা বৈজিক ত্বরণ-সন্নিধান। কবিতা মন্ময়-অভিনিবেশ। কবিতা তন্ময়-তপোবন।

কবিতা বস্তু-বসন্তের প্রসাধন। কবিতা বিষয়-বিন্যস্ত বোধের প্রলম্বন। কবিতা নির্মেদ প্রত্যয়ের সবুজ। কবিতা সংহত প্রাণের পরাগ। কবিতা বৈষম্য-নিরোধী শক্তি। কবিতা জন-দীপ্তির প্রজ্ঞাপন। কবিতা অমূল্য পৌষের শস্যময় বাতাবরণ। কবিতা অভ্রান্ত-অক্ষয় সিদ্ধি। কবিতা বীজঘ্ন বিশ্বাসকে নিঃশেষ করে। কবিতা অলক্ষ্য ও অগম্যকে রূপান্বিত করে। কবিতা পরশ্রী-প্রেমার্দ্র-প্রজ্ঞার ধারক। কবিতা ভ্রম-বিনাশী সময়ের সুঘ্রাণ। কবিতা অপভোগ-স্পৃহ জটিলতা-সংহারক। কবিতা ঐকতান-সমৃদ্ধ সংহতির দ্যুতি। কবিতা নিঃসঙ্গতা-নিঃশেষক শিল্প-প্রক্ষেপণা। কবিতা ঘুম-ঘোর-সুস্মিত বাক্য-অবয়ব। কবিতা সত্য-স্ফূর্ত বৈদগ্ধ্যের আরাধনা। কবিতা ইহ-সংসর্গী পূর্ণতার গীতময় সজ্জা। কবিতা ঐশ্বর্য-সংজ্ঞাপিত অবারণ নূপুর। কবিতারই কালান্তর-প্রপন-প্রসন্ন প্রকরণ অঞ্জলিকবিতা।

৩.
কবিতা পরিশুদ্ধ ঈপ্সার নন্দিত চারুতা। কবিতা পরশ্রীকাতরতা-নিঃশেষণের প্রলম্বন। কবিতা দুর্ভাগ্য-সংহারক ঐশ্বর্য। কবিতা নৈর্ব্যক্তিক এবং অলস চিন্তা-কর্মায়োজন-নিরোধী শিল্প-অবয়ব। কবিতা মিথ্যে-অপনয়নের মাধ্যম। কবিতা জীবন-আয়োজনের দিশা। কবিতা অর্বাচীন অচলায়তনের বিপরীত বর্তিকা। কবিতা নির্মোহ সংস্থিতি-সংস্থাপক। কবিতা দর্শন-ক্লান্ত ভাবনার রসময় শরণ। কবিতা অহং-স্থিতির উপচার। কবিতা বৃত্তি-মীমাংসার পাথেয়-সন্দীপনা। কবিতা সমুন্নতি-শৌর্যের চিত্রায়োজন। কবিতা পরাকথন-বিভা। কবিতা উৎপ্রেক্ষা-উপমার সুসমঞ্জস পরিবৃত্ত। কবিতা অনিঃশেষ বৈদগ্ধ্য-বিন্যাস। কবিতা অনন্ত-প্রগতি-প্রসূন। অঞ্জলিকবিতা কবিতারই পরম-সৃজন-জ্যোতির এক সংসিদ্ধ প্রভূষণ ।

‘অঞ্জলিকবিতা’ মন-মননের ভাব-প্রকাশক এক নবীন শিল্পরূপ। গীত-প্রকরণে যেমন ‘আভোগ’ বা ‘আভোগী’, সনেটে যেমন ‘অষ্টক’-‘ষটক’-সাংগঠনিক ভঙ্গি, তেমনি ‘অঞ্জলিকবিতা’ও ধারণ করে ভিন্ন কিছু বৈশিষ্ট্য। এর অংশ দু’টি : ক. প্রতিমা, খ. অঞ্জলি। ‘প্রতিমা’য় সংরক্ষিত হয় কবিতার শরীর। বিষয়-ভাব-অনুসারেই কবিতার বিনির্মাণ হয় সচল । কবি ছন্দ-মুক্তছন্দ-সনেট-গদ্যকবিতা-রূপায়ণায় সৃজন করেন তাঁর কথকতা। তবে ভাব-অনুযায়ী কবিতা-দেহ ক্ষুদ্র বা দীর্ঘতর হতে পারে।
‘অঞ্জলি’ অংশে কবি তাঁর অঞ্জলি অর্পণ করেন। প্রতিমা অংশের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হবে এ অংশের নির্মিতি। মাত্রা-ছন্দ-অন্ত্যমিল অবশ্যই সর্বোচ্চ চার পঙ্ক্তিতে সীমাবদ্ধ হবে। বিশেষভাবে উল্লেখ্য, ‘সনেটাঞ্জলি’র ক্ষেত্রে প্রতিমা অংশটি হবে শতভাগ সনেট। অঞ্জলি অংশটি অবশ্যই হবে চৌদ্দ অক্ষরের বা মাত্রার। অঞ্জলিকবিতা- ‘সনাক্তকারী’ কিছু নিয়ম : ক. প্রতিমা ও অঞ্জলি অংশকে একটি ‘স্পেস’ দিয়ে পৃখক করতে হবে। ‘অঞ্জলি’ অংশের শেষে ‘।।’(ডাবল দাড়ি) আবশ্যিক।
‘অঞ্জলিকবিতা’য় উত্তর-আধুনিকতা-সঞ্চয়িত ভাবশৈলীও বিভান্বিত। বিশ্বস্ত দৃকপাৎ Ñ এ শৈলী প্রজন্মান্তরের আয়ুষ্মান প্রবৃদ্ধি লালন করবেই। যৌক্তিক শিল্পায়োজনের অনলস অলঙ্কার হয়ে এ শৈলী সমুত্থিত হবে কবি ও পাঠকের ধী-বিত্ত-পূর্ণাভ বৃত্তে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here