সায়ন্তনী মহাপাত্র একজন ভারতের খ্যাতনামা ফুডব্লগার। ইংরেজি ফক্স চ্যানেল , এন. ডি. টিভি থেকে বাংলা চ্যানেল ই. টিভি থেকে জি বাংলায় পরিচিত মুখ। সায়ন্তনী মহাপাত্রের রেসিপির জাদু আনন্দবাজার পত্রিকা থেকে সানন্দা সর্বত্রই বিরাজমান। আজকে সায়ন্তনী মহাপাত্রের সাক্ষাৎকার নিচ্ছেন লেখিকা অগ্নিমিতা দাস।
১) আপনার এই অভিনব উপায়ে ফুডব্লগার হওয়ার ইচ্ছে কি ভাবে জাগে?
উঃইচ্ছেটা বিয়ের পর পরই শুরু। বিয়ের আগে সেভাবে রান্নাঘরে ঢোকার প্রয়োজন হয়নি। তাই বিয়ের পরে কাজকর্ম করার ফাঁকে শুক্তো, মুড়িঘন্ট রাঁধতে হলেই মা কে ফোনে করতাম।সেখান থেকেই মনে হলো কোথাও লিখে রাখি এই রেসিপিগুলোকে পরের প্রজন্মেরও কাজে লাগবে। সেই দিয়ে শুরু। আর আমি সবসময়ই রান্নার রেসিপির সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত নানান অভিজ্ঞতার কথা লিখি। পরে দেখলাম লোকজন পড়ছেন, তাদের মতামত জানাচ্ছেন। তখন আরেকটু সিরিয়াসলি কাজটা করার কথা ভাবলাম। ছবির মাধ্যমেও যে একটা গল্প বলা যায় সেটাও শিখতে শুরু করলাম। এখন আমার জীবনের একটা মস্ত অংশ জুড়ে আছে এই কাজ, শুধু রান্না নয়, সেটা নিয়ে লেখাপড়া করা, তার ইতিহাস, বিভিন্ন উপকরণ, আঞ্চলিক খাবার ইত্যাদি নিয়ে জানার চেষ্টা করি ।
২) আপনার পড়াশোনা কোথায়?
উঃ আমার শান্তিনিকেতনে বাড়ি, ওখানেই পড়াশোনা।
৩) আপনার পড়াশোনার সাথে তো আপনার প্যাশনকে মেলানো যায় না?
উঃ আমার পড়াশুনোটা অনেক দিকে। ইকোনমিক্স পড়ার পর আমি ম্যানেজমেন্ট পড়েছি দিল্লি থেকে. তারপর চাকরি করার সময় সন্ধের ব্যাচ এ পড়েছি NIFT থেকে। আমার প্যাশন যদিও রান্না আর খাবার কিন্তু প্রফেশনালি হ্যান্ডিক্রাফটের ব্যবসার কাজে এখনো সেই পড়াশুনা কাজে লাগে
৪) এই সৃজনশীল মনোভাবের জন্য কে আপনাকে অনুপ্রাণিত করেন?
উঃআমার মা।আমি চিরকালই মাতৃভক্ত,মায়ের গুণমুগ্ধ মেয়ে।আমার মায়ের মতো মানসিক দৃঢ়তা বা সৃজনশীলতা আমি আজও কারোর মধ্যে দেখলাম না।যেটুকু পারি, যেটুকু করি সব মায়ের কাছে শেখা,মায়ের মতো করে কিছুই করতে পারিনি,চেষ্টাটুকু ছাড়া ।
৫) সানন্দা থেকে আনন্দবাজার প্রায়ই পাতায় পাতায় আপনার রেসিপি প্রকাশিত হয়,কাছের মানুষেরা যখন পড়ে আর আপনায় জানায় কেমন অনুভূতি হয়?
উঃখুবই ভালো লাগে. আনন্দটা আসলে তখনি সম্পূর্ণ হয় যখন সেটা ভাগ করে নেওয়া যায় তাই সবথেকে ভালো লাগে যখন শান্তিনিকেতন থেকে পুরোনো মানুষেরা বা আমাদের বয়স্ক আত্মীয়রা ফোন করে বলেন যে তাঁরা দেখে কত খুশি হয়েছেন।এই আশীর্বাদটা সবথেকে বড়ো পাওয়া ।
৬) শুনেছি পেট দিয়ে হৃদয়ে পৌঁছতে হয়। আপনার ক্ষেত্রে ব্যাপারটা কি রকম?
উঃ_ ( একটু হেসে) আমি এখনো রাস্তাটা খুঁজেই চলেছি , পেলে আগে আপনাকে জানাবো।
৭) আপনি তো বিভিন্ন কেক , কুকিস নিজে তৈরি করে অর্ডার নেন, কিভাবে এই বিশাল কর্মযজ্ঞ সামলান?
উঃ আমার দিদা বলতেন ইচ্ছে থাকলেই উপায় হয়। ইচ্ছেটা আছে বলে কেমন করে জানি না সব হয়ে যায়।
শুধু হোম বেকারি নয় আমি মাঝে মাঝে পপ আপ মেনু করি বিভিন্ন প্রদেশের রান্না নিয়ে, এছাড়াও “কলকাতা ম্যাজিক” বলে একটা সংস্থার জন্য কাজ করি।বিদেশী অতিথিদের জন্য বাঙালি ফুডের এক্সপেরিয়েন্স ক্রিয়েট করি। বিভিন্ন পত্রপত্রিকার জন্য লেখালেখি, রেসিপি তৈরী করা, ছবি তোলা এগুলো তো আছেই,আমি ভীষণ পারফেকশনিস্ট, যে কোনো কাজ মিনিট গুনে, খুঁটিয়ে প্ল্যান করে রাখি বলেই বোধহয় আজ অব্দি অসুবিধে হয়নি।
৮) জীবনের আদর্শ মানুষ কে?
উঃআমার মা ।
৯) শান্তিনিকেতনে পড়াশোনা করেছেন ওখানের কোন কোন বিষয়কে এখনো খুব মিস করেন?
উঃ শান্তিনিকেতনের সব কিছু মিস করি. ওখানকার আলো হাওয়া বাতাস মাটি গাছপালা , শ্রীসদনের সামনের রাস্তার রেলিং (আমরা বলতাম দাঁড়) এ বসে আড্ডা, বিনয়ভবনের মাঠে বর্ষার পরে ভেলভেট পোকা খোঁজা, কালবৈশাখী ঝড়ের সময় ছুটে ছুটে আম কুড়োনো, দোলের আগের রাতের ওই চরাচর ভাসানো চাঁদের আলো, ৭ই পৌষের ভোরবেলায় ঠকঠক করে কাঁপতে কাঁপতে বৈতালিক, আর পুজোর আগে অকারণে আনমনা হয়ে সাইকেল নিয়ে শ্যামবাটির দিকে রওনা দেওয়া।সবটাই তো পেয়ে হারিয়েছি।ওখানে থাকতে কতবার গেয়েছি ” আমরা যেথায় মরি ঘুরে সে যে যায়না কভু দূরে” তখন বুঝিনি কিন্তু এখন উপলব্ধি করি। এখন এই বয়সে এসেও মনের মধ্যে এক টুকরো শান্তিনিকেতন নিয়েই বাস করি। আমার সব কাজেই এই শান্তিনিকেতন থেকে শেখা, স্বল্পের মধ্যে সুন্দরকে পাওয়ার চেষ্টাটা রয়ে গেছে।
১০) খেতে ভালোবাসেন? না শুধুই খাওয়াতে?
উঃখেতে ভালোবাসি কিন্তু তার থেকেও ভালোবাসি খাওয়াতে. কেউ তৃপ্তি করে খেলে মন ভোরে যায় ।
১১) লাভ না এরেন্জ ম্যারেজ?
উঃ_এরেঞ্জড ম্যারেজ,রীতিমতো পেপার দেখে সম্মন্ধ করে।
১২) আপনার এই ফুডব্লগার হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য হাসব্যান্ডের অবদান কতটা?
উঃআমার হাসব্যান্ড ভীষণ হেল্প করে।নিজের কাজ নিয়ে সদাই ব্যস্ত তবুও সবসময় চেষ্টা করে পাশে থাকার। কিছু কিছু কাজে আমার থেকেও ওর আগ্রহ বেশি।এক্সপেরিমেন্টের নামে স্যাপ ব্যাঙ যা রাঁধি সোনা মুখ করে খেয়ে নয়, এটাও কি কম বড় কথা?
১৩) আপনি তো ফক্স চ্যানেলের বিকাশ খান্নার সাথে কাজ করেছেন, অভিজ্ঞতার কথা যদি একটু বলেন?
উঃ অনেকদিন আগের কথা. এই শুটটা হয়েছিল গঙ্গার ওপরে একটা নৌকায়. খুব ইউনিক ছিল পুরো ব্যাপারটা।
উনি এত বড় একজন সেলিব্রিটি শেফ কিন্তু একদম মাটির মানুষ, কোনো অহংকার নেই, ভীষণ নম্র, ভদ্র আর নতুন জিনিস দেখার ও শেখার কি অসম্ভব উৎসাহ।
আমি সেদিন রান্না করেছিলাম মাছের সন্দেশ. আইডিয়াটা ওনার ছিল আর কাজটা আমার ছিলো। ঠিকঠাক হবার পরে উনি খুব খুশি হয়েছিলেন।
১৪) সম্প্রতি কোন টিভি চ্যানেলে কাজ করছেন?
উঃআমি একসময় ই. টিভি বাংলায় প্রথম অনুষ্ঠানে নিয়মিত রান্না শেখাতাম, এর পর রকি এন্ড ময়ূর এর সঙ্গেও একটা কাজ করেছিলাম এন. ডি. টিভিতে ” good times”, পরে ওই চ্যানেলে এই শেফ কুনাল কাপুরের সঙ্গেও দুটো এপিসোড করেছিলাম. গত বছর “livingfoodz” চ্যানেলের জন্য গয়না বাড়ির ওপরে একটা অনুষ্ঠান করেছিলাম. এখন সেভাবে কিছু করছিনা কিন্তু মাঝে মাঝে বিভিন্ন টপিকের ওপরে বলার জন্য ডাক পড়ে। কয়দিন আগে “zee zest “এর দুটো এপিসোড ও একটু বললাম।
১৫) কোন জগতে বেশি কম্ফোর্টেবল প্রিন্ট না ইলেকট্রনিক্স?
উঃ-আমি লিখতে বেশি ভালোবাসি বলার থেকে।
১৬) আপনার ব্লগে তো রেসিপির পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ থাকে, কিভাবে এত বিশদে লেখেন?
উঃ রান্নাটা নিজেই করি তাই অসুবিধে হয়না,আর সবসময় মাথায় থাকে ডিটেলস না থাকলে, হয়তো একদম নতুন কেউ বা কোনো বিদেশী আমার রেসিপি যদি চেষ্টা করে তাঁরা হয়তো বুঝতে পারবে না।
১৭) আপনি আপনার ব্লগে অসাধারণ লেখেন, বই আকারে এই লেখার সংকলন প্রকাশিত করার ইচ্ছা আছে?
উঃইচ্ছে তো আছেই. একটা বিষয় নিয়ে রিসার্চ করার ও চেষ্টা করছি. দেখা যাক ভবিষ্যতে কি হয় ।
১৮) কাছের বন্ধু?
উঃ স্কুলের ছোটবেলার তিন চারজন খুব কাছের বন্ধু আছে তাদের সঙ্গে কথা হয় নিয়মিত, বড়বেলায় পাওয়া দুজন বান্ধবীও আছেন যারা খুব কাছের।
১৯) কর্মজগতে প্রতিযোগীতার মুখে পড়তে হয়েছে?
উঃআমি প্রতিযোগিতায় বিশ্বাস করিনা একেবারেই. তাই কোনো ইঁদুর দৌড়ও নেই। আসলে আমার মনে হয় প্রত্যেকের কাজের কিছু নিজস্বতা আছে তাই কাজ সবাই পাবে, তার জন্য যুদ্ধ করার দরকার নেই. এছাড়া জীবনের প্রায়োরিটিগুলো আমার খুব আলাদা। মা হিসেবে আমার জীবনে অগ্রাধিকার আমার ছেলে মেয়েদের।তারপরে আসে আমার কাজ,তাই প্রতিযোগিতায় নামার সময় ও হয়না।
২০) নিজে কি ধরনের খেতে পছন্দ করেন, মোগলাই, চাইনিজ না কন্টিনেলটাল?
উঃ সব খেতে ভালোবাসি তবে কখন কোনটা ইচ্ছে করে সবটাই মুডের ওপরে।যে কোনো খাবার খেতে সুস্বাদু হলেই আমি ভালোবেসে খাই।
২১) সবচেয়ে কষ্টের মূহুর্ত?
উঃমায়ের হঠাৎ করে চলে যাওয়া ।
২২) সবচেয়ে আনন্দের মূহুর্ত?
উঃ_আমার দুই সন্তানের জন্ম।
২৩) প্রিয় লেখক কে?
উঃআজকাল রান্নার বই বা ইতিহাসধর্মী বই বেশি পড়ি।চিত্রিতা ব্যানার্জী , লীলা মজুমদার পড়তে ভালো লাগে. মঙ্গলকাব্য গুলিও খুব প্রিয়, বারেবারে পড়ি।
২৪) রাগ হলে কি করেন?
উঃ আমার রাগ বেশিখিন থাকে না। একটুক্ষণ একা চুপ করে থাকি। তারপরে আপনি রাগ পড়ে যায়। তবে আজকাল আর তর্কাতর্কি ভালো লাগে না। যেখানে, যার সঙ্গে মতের মিল হয়না। আমি সরে যাই।
২৫) অবসরে কি করতে ভালোবাসেন?
উঃবসে থাকতে পারিনা মোটেই,হাতেরকাজ করতে খুব ভালোবাসি।আর্ট আমার সারাদিনে কোথাও না কোথাও জড়িয়ে থাকে।ত্রুশ বোনা, এমব্রয়ডারি, ফেল্ট দিয়ে কিছু বানানো, কিছু না কিছু করতেই থাকি।
২৬) ছুটিতে কোন জায়গায় যেতে পছন্দ করেন?
উঃ এমন কোনো জায়গায় যেখানে সেই জায়গার কালচারকে কে এক্সপেরিয়েন্স করা যায়। বেড়ানো তা আমাদের কাছে শুধু নতুন জায়গা ঘুরে দেখা নয় বরং সেই জায়গাটাকে তার সমস্তটুকু নিয়ে অনুভব করা। স্থানীয় খাবার চেখে দেখা, সেই রান্না শেখা, বাজার ঘুরে দেখা, উপকরণ সংগ্রহ, হাতের কাজের জিনিস দেখা। এগুলো না করলে আমার বেড়ানো সম্পূর্ণ হয়না, এখনো ছেলেমেয়েরাও এই ভাবেই ঘুরতে ভালোবাসে।
২৭) সংসার আর এই বিরাট কর্মযজ্ঞকে কিভাবে একা হাতে সামলান? ব্যালেন্সিং করতে পারেন?
উঃ কয় আর পারলাম। মাঝে মাঝেই দিনের শেষে মনে হয় কিছুই হলোনা ঠিক করে। তবে চেষ্টাটা থাকে ষোলো আনার ওপর আঠেরো আনা।দিনের তো ওটাই মজা,রাত ফুরোলেই একদম নতুন একটা দিন,আবার কোমর বেঁধে শুরু করে দি ।
২৮) রাস্তার ফুচকা খেতে খেতে আড্ডা দিতে বেশি প্রেফার করেন না ক্যাফেতে আড্ডা?
উঃ ফুচকা দেবভোগ্য জিনিস। ওসব খেতে খেতে কথা বললে পাপ হয়।তাই আড্ডা দিতে হলে হয় বাড়ি নয়তো কোনো ক্যাফে ।
২৯) ইংরেজি সাহিত্য না বাংলা সাহিত্যে?
উঃ_দুটোই ।
৩০) একজন সফল নারী হিসেবে কোন বার্তা যদি সবাইকে দেন? আপনার লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য আপনার অদম্য ইচ্ছার কথা যদি বলেন?
উঃ আমি যা করতে চাই তার দশ পার্সেন্ট ও করে উঠতে পারিনি।তাই এক্ষেত্রে আমার হয়তো কিছু না বলাই ভালো। তবে নিজের জন্য একটা লক্ষ্য স্থির না করলে বোধহয় ঠিকঠাক কিছু করে ওঠা মুশকিল।
অসাধারণ লাগলো ইন্টারভিউ খানা।আমার ডিপার্টমেন্টের মেয়ে তাই আরও আনন্দ হলো সবটা জেনে।আর বিকাশ খান্নার ওপর crush অনেক দিনের।কবে যে দেখা পাবো তাঁর, কে জানে!দুজনকেই এত্তো ভালোবাসা আর আদর।