ওপার বাংলার প্রকৃতি প্রেমী ও কলমযোদ্ধা- অজন্তা প্রবাহিতার তথৃসমৃদ্ধ সাক্ষাৎকার ভিত্তিক লেখা ‘’ডাকাত কালীবাড়ি‘’

400
অজন্তা প্রবাহিতার তথৃসমৃদ্ধ সাক্ষাৎকার ভিত্তিক লেখা ‘’ ডাকাত কালীবাড়ি ‘’

ডাকাত কালীবাড়ি

অজন্তাপ্রবাহিতা

কে বলে পাষাণী তুই দয়ার অন্ত নাই

“হাতে লাঠি,মাথায় ঝাঁকড়া চুল,
কানে তাদের গোঁজা জবার ফুল। “
শুরুতে যখন এই কথা গুলো বলছি তখন বোঝাই যাচ্ছে যে আজ ডাকাতদের নিয়ে গল্প করবো । যে সময়ের কথা বলছি সেসময়ে বাংলায় দস্যু ডাকাতের অভাব ছিল না। ডাকাত বলতেই লুটমার খুন-খারাপির কথাই আমাদের মাথায় আসে। তবে,ডাকাতের মধ্যে ভালোমন্দ দুই-ই ছিল। ভিনদেশী রবীনহুডের গল্পের মতো এমন ডাকাতও ছিল যারা ধনীর কাছ থেকে টাকা ধনসম্পত্তি লুট করে গরিবের সেবা করতো। ইতিহাস সাক্ষী , ব্রিটিশ আমলে নীলকর সাহেবদের অত্যাচার থেকে গরিব প্রজাদের রক্ষা করবার জন্য প্রথম হাতিয়ার ধরে যে ‘ডাকাত’ হয়ে উঠেছিল, তার নাম ডাকাত বিশ্বনাথবাবু।
সেই সময় যে কোনো পেশার মতো ডাকাতিও একটি পেশা ছিল। সেই পেশায় সাফল্য লাভ করবার জন্য বেশির ভাগ ডাকাতেরই আরাধ্য দেবী ছিলেন মা কালী। বাংলার বিভিন্ন জায়গায় ডাকাতের দ্বারা স্থাপিত দশখানা কালীবাড়ির কথা জানা যায়।
দক্ষিণ কলকাতার পূর্ণদাস রোডে ( পূর্বতন মনোহরপুকুর রোড) ডাকাত কালীবাড়ির মাহাত্ম্য শুনে এবছরের গোড়ার দিকে দাদার হাত ধরে হাজির হয়েছিলাম সেখানে।
সদর রাস্তা থেকে মন্দিরের ভেতরে এগিয়ে যাবার সময় বেশ গা ছমছম করছিলো। ফটক হয়ে দুপা এগোতেই ডানদিকে চোখে পড়লো টকটকে লাল রঙের হাড়িকাঠ। বাঁপাশে হাতপা ধোবার জন্য টিউবয়েল তারপরেই ছোট্ট একটি শিবমন্দির তারসাথেই লাগোয়া মায়ের মন্দির। কষ্টিপাথর দিয়ে তৈরী মায়ের মূর্তি আসনে বিরাজমান।

১৮৯১ সালে এই মন্দির স্থাপনা করা হয়। এই মন্দিরকে কেন ‘ডাকাত কালীবাড়ি’ বলা হয় তা জানবার আগ্রহে মন্দিরের বর্তমান সেবায়েত কল্লোল ভট্টাচার্য মহাশয়ের সঙ্গে কথা বলি –
অপ্র – আপনি কি মনোহর ডাকাতের বংশধর ?
কভ – নাহ ! আমরা ডাকাতের বংশধর নই। ১৯৩০ সাল থেকে আমরা এখানে আছি। সেইসময় আমার ঠাকুরদা মায়ের সেবা করতেন , তারপর ঠাকুরমা , তারপর বাবা ও এখন আমি।
অপ্র – এই মন্দির স্থাপনের ইতিহাস কি ?
কভ – প্রায় দুশো বছর আগে এই অঞ্চল কেমন ছিল তা এখন কেউ ধারণাও করতে পারবে না। চারিদিকে ঘন বনজঙ্গল,পথ-ঘাট নেই, লোকবসতি বিরল। একদিকের একটা ছোট খালের মধ্যে দিয়ে চলতো সালতি নৌকো।বনের মাঝে নিরিবিলি স্থানে বাস করতো চোর দস্যু ও ডাকাতের দল। এই দুর্গম বনেই মনোহর বাগ্দী নাম এক বিখ্যাত ডাকাত ছিল। উনি ডাকাতের সর্দার ছিলেন।
দেশের চিত্রটি এক্কেবারে অন্যরকম ছিল। পলাশীর যুদ্ধের শেষে দেশে তখন অরাজকতা , অভাব ও দুর্ভিক্ষের প্রকোপ।। একদিকে দস্যু ও ডাকাতের ভয়ে মানুষের প্রাণ বাঁচানো দায় অন্যদিকে বাঘ, ভালুক, সাপ শুকরের ন্যায় বন্য প্রাণীদের ভয়। মানুষ গেলেই বা যাবে কোথায়?
সেকালের ভক্তরা নিবিড় বনপথে অথবা আদিগঙ্গা হয়ে নৌকাপথে কালীঘাটের কালী দর্শনের জন্য আসা যাওয়া করতো। এই নিবিড় বনপথেই ছিল মনোহরের আস্তানা। বাড়ি বলতে ছাউনি দেয়া মাটির দুখানি ঘর। মনোহরের পরিবার বলতে এক বুড়ি পিসি ও মনোহর। বাড়ির অল্পদূরে ছিল একটি ভাঙা মন্দির ও পাষাণী কালীমূর্তি। মূর্তিটি আকারে ছোট হলেও ভীষণদর্শনা ছিল। মূর্তির গায়ে কোনো অলংকার ছিলোনা, দেবী ছিলেন আয়ুধভূষিতা, মুণ্ডমালা বিভূষিতা,তাঁর হাতে ছিল নরবলি দেওয়া কোনো
হতভাগ্যের করোটি। এই ভয়ঙ্কর রূপের জন্যেই ডাকাতেরা এই কালীমূর্তির নাম দিয়েছিলো ‘কংকালমালিনী’। মনোহর ছিলেন কালীভক্ত। ভালো ডাকাতি হলে মায়ের কাছে বলি দেবেন এই মানত করে মনোহর মায়ের পুজো সেরে প্রতিদিন ডাকাতি করতে বেরোতেন । পশু বলির সঙ্গে নরবলি দেবার প্রথাও তখন ছিল।
একদিন কালীঘাটে পুজো দিয়ে রাজপুর গ্রামের এক পরিবারের তিনজন সেই নিবিড় বনপথের মধ্যে দিয়ে বাড়ি ফিরছিলো। এক বৃদ্ধ , একটি শিশু ও তার মা। বাঘের থাবায় সঙ্গে সঙ্গেই বৃদ্ধের মৃত্যু হয়। মা ও শিশুটি আঘাতপ্রাপ্ত হয়েও প্রাণে মারা যায় নি।
সেইপথেই রাতে ফিরছিলো মনোহর ও তার সঙ্গীরা। পথ মধ্যে এমন তিনটি মানুষ দেখতে পেয়ে তারা থমকে গেছিলো।
ক্ষতবিক্ষত মা ও শিশুকে মনোহর বাড়িতে নিয়ে গেলো। চিকিৎসা ও শুশ্রুষার পরে শিশুটি প্রাণে বেঁচে গেলেও মা-কে বাঁচানো যায় নি। এদিকে ছোটোছেলেটি আত্মপরিচয় কিছুই বলতে পারলো না। ফলে সে মনোহরের সাথে ওর বাড়িতেই রয়ে গেলো। ধীরে ধীরে মনোহরের আপনজন হয়ে উঠলো। স্নেহের অপূর্ব পরশে মনোহরের মন বদলাতে লাগলো। চুরি ডাকাতিতে আর মন লাগতো না। সময়ের সাথে মনোহর ও সেই শিশুর মধ্যে পিতা-পুত্রের সম্পর্ক স্থাপন হলো।
ডাকাত হলেও মনোহর শিক্ষার প্ৰয়োজনীয়তার বিষয়ে অনুভব করতো। তাই সেইসময় ভবানীপুর অঞ্চলে এক খ্রিস্টান পাদ্রীর স্কুলে ছেলেকে ভর্তি করে দিলো। স্কুলের খাতায় নাম হলো বাবা মনোহর বিশ্বাসের ছেলে হারাধন বিশ্বাস।
হারাধন ছোটবেলা থেকেই খুব মেধাবী ছিল। পাদ্রী সাহেবের কাছে খুব যত্ন নিয়ে লেখাপড়া করে বড় হলো। এদিকে মনোহরের বয়স বাড়তে লাগলো। কর্মক্ষমতা ধীরে ধীরে কমে আসতে লাগলো।
কোম্পানি আমল শুরু হলো। চুরি, ডাকাতি, রাহাজানি কমে আসতে লাগলো। বিভিন্ন জায়গায় ফাঁড়ি বা থানার সৃষ্টি হলো , সেখান থেকে পুলিশরা চারিদিকে কড়া নজর রাখতো। প্রশাসনিক ব্যবস্থার কড়াকড়িতে মনোহর ডাকাতের দলও ছিন্নভিন্ন হয়ে গেলেও ছেলেকে ছেড়ে এক মুহূর্ত থাকতে পারতো না। হারাধনের কাছে পূর্ব জীবনের কথা গোপন করে মনোহর চাষবাস শুরু করে।
শেষ জীবনে মনোহর ডাকাত হয়ে যায় মনোহর চাষী। হারাধনও অত্যন্ত প্রফুল্ল মনে বাবাকে সাহায্য করতো।
মৃত্যুর কিছুদিন আগে মনোহর লুঠ করা সব সম্পদ মানব কল্যাণের জন্য হারাধনের হাতে তুলে দেয়। আজ্ঞাকারী পুত্র হারাধন পিতার সব ইচ্ছা অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছিল। গ্রীষ্মকালে জলকষ্ট দূর করবার জন্য বাবার নামে বড় বড় দীঘি ও পুকুর খনন
করেছিল। আজও দক্ষিণ কলকাতা ঘুরে দেখলে সংস্কারবিহীন সেইসব দীঘি ও পুকুর দেখা যায়। মনোহর ও হারাধন কেউই আজ নেই। কিন্তু , মনোহরের স্মৃতিকে অমর করে রেখেছে দক্ষিণ কোলকাতার মনোহর পুকুর রোড ও এই ডাকাত কালীবাড়ি।
অপ্র – ওঁনাদের মৃত্যুর পরে কে এই মন্দিরের দেখাশোনা করতো ?
কভ – হারাধন বিশ্বাসের মৃত্যুর পরে এই জায়গার দেখাশোনা করবার কেউ ছিল না। পরবর্তী কালে ঠাকুর বংশের লোকেরা এই পুরো অঞ্চল কিনে নিয়েছিল। তাঁরাই বীরভূমের স্থাপত্য অনুসরণ করে মাটির মন্দিরকে নতুনভাবে গড়ে তোলেন। ওনারাই স্থানীয় লোকেদের সাহায্য নিয়ে মন্দিরের সেবাযত্ন করবার জন্য আমার ঠাকুরদাদা কালিভূষণ ভট্টাচার্যকে এখানে নিয়ে আসেন। মূলত আমরা হরিনাভি রাজপুরের বাসিন্দা। আমার বাবা কান্তিভূষণ ভট্টাচার্যের মৃত্যুর পরে আমি এখন মন্দিরের সেবা করি।
অপ্র – একটা মন্দির চালাতে গেলে অর্থের প্রয়োজন হয়। সেই অর্থ এখন কি ভাবে জোগাড় হয় ?
কভ –ভক্তদের অনুদান ও শুভকার্য্যে যেমন বিবাহ, অন্নপ্রাশন ,পৈতা, গৃহপ্রবেশ ইত্যাদির মাধ্যমে রোজগার হয়।
অপ্র – আপনি কোথায় থাকেন ?
কভ- মন্দিরের সঙ্গেই আমার কোয়ার্টার।
অপ্র –অন্যান্য মন্দিরের মতো আপনাদেরও কি রিটায়ারমেন্ট আছে ?
কভ – না,আমাদের মন্দিরে কোনো রিটায়ারমেন্ট নেই। যতদিন শরীর চলে আমি কাজ করবো। এই মন্দির ট্রাস্টের অধীনে নয়। পুরোটাই বংশ পরম্পরায় চলছে।
অপ্র – এখনো কি ঠাকুরবাড়ির সঙ্গে এই মন্দিরের যোগাযোগ আছে ?
কভ – নাহ ! কোর্টের আদেশে আমরাই যা করবার করে থাকি।
অপ্র -তারমানে আপনারাই এখানকার ব্রাহ্মণ রাজা !
কভ- তা বলতে পারেন।
অপ্র – ইতিহাসের ব্যাপারে তো জানলাম। এইবার ভবিষ্যতের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করি। কিভাবে এই মন্দিরকে আগামী দিনেও চালিয়ে নিয়ে যেতে চান ?
কভ – এই মন্দিরের প্রকৃত প্রচার হোক সেই দিকে লক্ষ্য রেখে ভক্তদের স্পন্সরশিপে সর্বপ্রথম আমরা মন্দিরের ওয়েবসাইট তৈরী করি। www.dakatkalibari.in সেখানে এই মন্দিরের ইতিহাস ও মহিমা সবই লেখা আছে।
অপ্র – দুই বাংলার ইতিহাসে এমন কত জানা-অজানা মানুষ আর তাদের ভক্তির নিদর্শন ছড়িয়ে আছে। মায়ের কাজ মা-ই করিয়ে নেবেন। মায়ের আশীর্বাদ যদি থাকে আমারও খুব ইচ্ছা যে আমার লেখায় সবাই এই মন্দিরের ব্যাপারে জানুক ও এখানে এসে মায়ের দর্শন করে ওঁনার আশীর্বাদ নিয়ে যাক।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here