আজকের পৃথিবী ছবি নির্ভর। একমুহূর্তের জন্য কি আমরা হাতের মোবাইলটা ছাড়া নিজেদের ভাবতে পারি !
বিভিন্ন প্রয়োজনে ছবির ভূমিকা এতটাই গুরুত্ব পূর্ণ হয়ে উঠেছে যে মাঝে মাঝে মনে হয়, ভাগ্যে হাতের মোবাইলে ক্যামেরা খানা আছে। নইলে এতো কিছু এতো কম সময়ে করে ফেলা সম্ভব হতো না।
মানুষের ছবির প্রতি দুর্নিবার আকর্ষণ ছিল বলেই এই মোবাইল-বিপ্লব এতো সার্থক হয়েছে ।
মানব সভ্যতার বিকাশের সময় থেকেই ছবির প্রতি মানুষের ঝোঁক ছিল। সর্ব কালেই, মানুষ চোখে দেখতে পাওয়া দৃশ্যকে স্থায়ী ভাবে ধরে রাখবার ইচ্ছেটা মনেমনে পোষণ করতো ! মানে ‘real to virtual’ দেখবার প্রবল ইচ্ছেটা মানুষের মনে বরাবরই ছিল,সেই ইচ্ছেকেই বাস্তবে রূপান্তর করতে গিয়ে ক্যামেরার জন্ম হয়।
১৮১৬ সালে আসে প্রথম ইমেজ ট্রেসিং ক্যামেরা। তারপর প্রযুক্তির হাত ধরে এগোতে এগোতে 1859 সালের 9ই জানুয়ারী ফোটোগ্রাফি প্রসেস বানাতে সক্ষম হন ফ্রান্সের Louis Dagurerre.ওই বছরেই ১৯ শে আগস্ট ফ্রান্সের সরকার বিনামুল্যে তার দেশের জনগণকে এই ফোটোগ্রাফি সার্ভিস দেওয়া শুরু করেন,সেই থেকেই আজকের দিনটিকে সারা পৃথিবীতে World photography day হিসেবে পালন করা হয়।
ধাপে ধাপে ক্যামেরার পরিবর্তিত রূপ আমরা দেখতে পাই। সেই কোডাক থেকে SLR (single lens reflect)
তারপর DSLR (Digital single lens reflect).,পয়েন্ট এন্ড শুট ক্যামেরা,মিররলেস ইন্টারচেঞ্জেবল লেন্স ক্যামেরা, ,হাইব্রিডক্যামেরা।
আর কোনো শিল্প মাধ্যমে প্রযুক্তির আশীর্বাদে এতো বড় বিপ্লব আসে নি,যতটা এসেছে ফটোগ্রাফীতে। ফটোগ্রাফী নিয়ে সারা বিশ্বই এখন মাতোয়ারা।
ছবি তোলা খুব সহজ মনে হলেও কাজটি আদৌ সহজ নয়,একটি ভালো ছবি বিচার করবার সময় কয়েকটি কথা মাথায় রাখা হয়ে থাকে,ছবির বিষয়বস্তু,মুহূর্ত (timing of expression),কম্পোজিশন বা ফ্রেমিং (একটাফ্রেমের ভেতরে কি ভাবে দৃশ্যটি সাজানো হয়েছে )ও আলো ( ঠিক জায়গায় ঠিক মতো আলো আছে কি না,অতিরিক্ত আলোর জন্য ফ্রেমের কোনো অংশ জ্বলে গেছে কি না)ইত্যাদি ,কারণ আমরা দুচোখে পৃথিবী দেখি,ক্যামেরা দেখে একচোখে। আমাদের দেখা পৃথিবী থেকে ক্যামেরার চোখ দিয়ে দেখা পৃথিবী এক্কেবারে আলাদা। অন্যান্য বিষয়ের মতোই এই বিষয়ে বিশেষ পড়াশুনার প্রয়োজন হয় এবং গুরুর প্রযোজন হয়।
আজ এই বিশেষ দিনে ফোটোগ্রাফির গুরু গৌতম রায়ের কাছ থেকে এই বিষয়ে ওনার অনুভব জেনে নি।
প্রশ্নোত্তরে গুরু গৌতম –
প্রশ্ন -আজ ওয়ার্ল্ড ফোটোগ্রাফি ডে। আপনি এই দিনটি কি ভাবে কাটান ? কিকি করে থাকেন ?
উত্তর – আমি সুযোগ পেলেই ছবি তুলি। কিন্তু আজকের দিনটি বিশেষ দিন। ফটোগ্রাফির জন্মদিন। তাই যেমন করেই হোক, আজকের দিনে আমি ক্যামেরায় হাত রাখি । নানা ধরণের ফটোশুট করি। যদি আজকের দিনটা সানডে হয়, তাহলে আমি আউটডোর ফোটোগ্রাফি করি।
২)প্রশ্ন – মোবাইল বিপ্লবের ফলস্বরূপ ফোটোগ্রাফি আজ অনেকটাই ‘ছেলেখেলা’ হয়ে দাঁড়িয়েছে, আপনার এই ব্যাপারে কি মতামত ?
উত্তর – হ্যা ! কথাটা ঠিক। ছবিতোলা বিষয়টা এক্কেবারেই ‘ছেলেখেলা’ বলে মনে হয় আজ। হাতে হাতে, হাই কোয়ালিটি ক্যামেরা যুক্ত মোবাইল এসে যাওয়াতে ছবি তোলা সহজ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফলে, সবাই ফটোগ্রাফার। আবার সবাই ভালো ছবি দেখতে চায়,তাই বিষয়টা যথেষ্ট মনোযোগ দিয়ে বোঝার চেষ্টা করে।
কিন্তু, আমার মনে হয়, মোবাইল ক্যামেরা কখনোই আসল ক্যামেরার বিকল্প হতে পারে না। যে স্পষ্টতা বা ডিটেইলিং এবং পিকচার কোয়ালিটি রিয়েল ক্যামেরা দিয়ে থাকে সেই সব মোবাইল ক্যামেরা দিতে পারে না।
৩) প্রশ্ন – মোবাইল ফোটোগ্রাফি আর ক্যামেরা ফটোগ্রাফির মধ্যে কি পার্থক্য ?
উত্তর – মোবাইল ফোটোগ্রাফি, ইনস্ট্যান্ট ছবি তুলে শেয়ার করার জন্য খুবই ভালো মাধ্যম। কিন্তু, যখনই আমরা ছবি প্রিন্টের কথা ভাবি, তখন ক্যামেরা ফটোগ্রাফির বিকল্প নেই। কারণ ছবির মানদণ্ড প্রিন্টের মাধ্যমে বোঝা যায়। স্ক্রিনে বোঝা যায় না।
৪) প্রশ্ন – আপনি কি ভাবে ফটোগ্রাফির দিকে আকৃষ্ট হলেন ?
উত্তর – ছবি তুলতে কে না ভালোবাসে। আমিও ছবি তুলতে ভালোবাসতাম। ছবির ম্যাগাজিন ঘাঁটাঘাঁটি করতাম। তখন সবসময় মনে হতো, এতো সুন্দর ছবি কি ভাবে তোলে ! এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে খুঁজতে আমি ছবি তোলার খুঁটিনাটি শিখতে শুরু করি এবং ধীরে ধীরে ফোটোগ্রাফিতে ঢুকে পড়ি।
৫)প্রশ্ন –ফটোগ্রাফির প্রাথমিক নিয়ম কি ? ছবি তোলার সময় কোন কথাগুলো মাথায় রাখা উচিত ?
উত্তর – ফোটোগ্রাফিতে মূল খেলাটা লাইট বা আলোর সাথে। তাই আলোর বিষয়টা ভালো করে বুঝতে হবে। ছবি তোলার প্রাথমিক নিয়মই হচ্ছে, আলোকে বুঝে নিয়ে ইমেজকে লেন্সে বন্দী করা।
৬) প্রশ্ন – লাইটের বিষয়টা আরেকটু ভালো করে বোঝাবেন ?
উত্তর -Light is the lifeline of photography.
এই বিষয়টা বোঝার জন্য প্রাকটিক্যাল ক্লাসের প্রয়োজন।
৭) প্রশ্ন – আপনি কি ফটোগ্রাফির ক্লাস নেন ?
উত্তর – আমার খুব ইচ্ছে নতুন প্রজন্মকে ফটোগ্রাফি শেখাবার। কিন্তু,এখন চাকরি বজায় রেখে এই শখ গুলো মেটাবার সময় পাই না। অদূর ভবিষ্যতে যদি সুযোগ ও সময় পাই, অবশ্যই শেখাবো। প্রতিটি শিল্পই একটি বেসিক ট্রেনিং ও কিছু পড়াশুনা দাবি করে। তারসাথে যে যত প্রাকটিস করবে, সে তত পারফেক্ট হবে।
৮) প্রশ্ন –কত রকমের ফোটোগ্রাফি হয়ে থাকে ?
উত্তর – নানা ধরণের ফোটোগ্রাফি হয়ে থাকে।
ওয়াইল্ড লাইফ,বার্ডিং,মেরিন, ল্যান্ডস্ক্যাপ, মাউন্টেইন স্ক্যাপ ,প্রোট্রেট, ফ্যাশন, ইভেন্ট, স্ট্রিট, ম্যারেজ ইত্যাদি।
৯) প্রশ্ন – আপনার ‘স্পেশালাইজেশান’ কোন ধরণের ফোটোগ্রাফিতে ?
উত্তর –আমার সব ধরণের ছবি তুলতে ভালো লাগে। তার মধ্যে ,বার্ডিং, পোর্ট্রেট, ইভেন্ট,ল্যান্ডস্ক্যাপ ইত্যাদির ছবি তুলে আমি বিশেষ আনন্দ পাই।
১০) প্রশ্ন –পেন ছাড়া যেমন লেখা যায় না, ক্যামেরা ছাড়া ফোটোগ্রাফি করা সম্ভব নয়। যারা বিগিনার্স বা ফটোগ্রাফি শিখতে চাইছে,তারা কোন ক্যামেরা দিয়ে শুরু করবে ?
উত্তর –কোন ক্যামেরা কিনবে সেটা সম্পূর্ণ ভাবে নির্ভর করে যে কিনছে তাঁর বাজেটের ওপর। আমার মতে,
‘পয়েন্ট এন্ড শুট ক্যামেরা’ দিয়ে বেসিকটা ভালো শেখা যায়।
১১)প্রশ্ন –আপনার এতো দিনের ফটোগ্রাফির অভিজ্ঞতায় কোন ধরণের ফটোগ্রাফি আপনার সবচেয়ে প্রিয় ?
উত্তর – আমার সবচেয়ে প্রিয় বার্ড ফোটোগ্রাফি। ফটোগ্রাফির দুনিয়াতে সবচেয়ে বেশি চ্যালেঞ্জিং বার্ড ফোটোগ্রাফি। এই ফোটোগ্রাফিতে একজন ফোটগ্রাফারের দক্ষতা,ধৈর্য্য,তাৎক্ষণিক বুধ্ধিমত্তা প্রকাশ পায়। তাই বলে এই নয় বাকি ঘরানা গুলো খুব সহজ। প্রতিটি ঘরানায় ফোটোগ্রাফারের প্রথম গুন্ হচ্ছে, ধৈর্য্য ও ঠান্ডা মস্তিষ্ক । এই দুটো না থাকলে কোনো ছবিই ভালো হবে না।
১২ )প্রশ্ন – ক্যামেরা সেটিংএর ব্যাপারে যদি একটু বোঝান ?
উত্তর – প্রাকটিক্যাল ক্লাস ছাড়া এভাবে এই বিষয়টা বোঝানো সম্ভব নয়। তাই আমি দুঃখিত।
১৩) প্রশ্ন – ফটোগ্রাফির সাথে এডিটিং কতটা জরুরি ? আপনি কি ভাবে ছবি এডিট করেন ?
উত্তর – আমার মতে এডিটিং বা পোস্ট প্রসেসিং যেকোনো ছবির প্রয়োজন কিন্তু অপরিহার্য নয়।
আমি ‘Adobe Lightroom ‘এবং ‘photoshop ‘ ব্যবহার করি।
১৪) প্রশ্ন –সম্প্রতি আপনি একটি ওয়াল্ডলাইফ ফটোগ্রাফির ওয়েবসাইট লঞ্চ করেছেন। সেই ওয়েবসাইটের ব্যাপারে কিছু বলুন। এই ওয়েবসাইট বানানোর উদ্দেশ্য কি ?
উত্তর –আমি ও আমার কাছের তিন বন্ধু মিলে ওয়েবসাইট লঞ্চ করেছি। যার নাম www.lensinwoods.com.
এই ওয়েবসাইট বানানোর উদ্দেশ্য হচ্ছে সাধারণ মানুষকে প্রকৃতির সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়া। পৃথিবীর জীবজগৎ সংকটাপন্ন। পাখি, প্রাণী, উদ্ভিদ সবই এখন মানুষের লোভের সামনে বিপন্ন ও অসহায়। আমরা কেউ বোঝার চেষ্টা করি না,পৃথিবী শুধু মাত্র আমাদের একার নয়। এখানে সবার নির্ভিগ্নে ও নির্ভয়ে বাস করবার অধিকার আছে।
মানুষের সচেতনতার ফলে এই সবই আজ শেষের দিকে এগিয়ে চলেছে। আমরা আমাদের তোলা ছবির মাধ্যমে আপ্রাণ চেষ্টা করছি মানুষকে বোঝানোর,প্রকৃতি খুব সুন্দর। একে বাঁচিয়ে রাখা দরকার।
আমাদের ওয়েবসাইটের মাধ্যমে এই বার্তাই সবার কাছে পৌঁছে দিতে চাই।
১৫) প্রশ্ন –ফোটোগ্রাফি নিয়ে আপনার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কি ?
উত্তর – এই মুহূর্তে বিশেষ কিছু ভাবি নি। তবে হ্যা, আমি ভালো ফটোগ্রাফারের লিস্টে নিজেকে দেখতে চাই।
১৬) প্রশ্ন – নতুন ফটোগ্রফারদের জন্য সাজেশন ?
উত্তর – হ্যা ! একটাই কথা বলবো,ভালোবেসে কাজটা করো। ফোটোগ্রাফি একটি বিশাল সাবজেক্ট। অন্যান্য বিষয়ের মতো এই বিষয়েও গ্রামার আছে। সেই গ্রামারটা একটু ভালো করে শেখা দরকার। তারসঙ্গে প্রচুর প্রাকটিস দরকার। আজকাল প্রতি নিয়ত টেকনোলজি ডেভেলপ হয়ে চলেছে। কাজেই একটু পড়াশুনা করে নতুন টেকনিক ও নতুন গিয়ারের ব্যাপারে ওয়াকিবহাল থাকা দরকার। যেকোনো বিষয়ে জানতে হলে একটা জীবন কম পরে। এক্ষেত্রেও তাই। রোজই কিছু না কিছু শেখার আছে। শেখার কোনো অন্ত নাই।
১৭) প্রশ্ন –আপনার স্বপ্ন কি ?
উত্তর – আমি লাইফে খুব বেশি প্ল্যান করে চলি না। কারণ জীবন বারেবারে সারপ্রাইজ করে। জীবনের পথের বাঁকে কোথায় কি আছে তা তো আমরা জানি না। তাও সবাই নিজেকে সফল দেখতে চায়। আমিও তাই ভাবি,To be among the top photographers of all time.
ধন্যবাদ গৌতম বাবু। আপনার সাক্ষাৎকার নিয়ে খুব ভালো লাগলো। ভালো থাকবেন। সুস্থ থাকবেন।
- আপনাকেও ধন্যবাদ।