আজ শিক্ষক ও প্রকৃতি প্রেমী মসিউর রহমান জন্মদিন । জন্মদিনের নিবেদন ‘’করোনা কালে সনাতন শিক্ষা পদ্ধতির পরিবর্তিত রূপ‘’গল্পে ও আড্ডায় শিক্ষক ও প্রকৃতি প্রেমী মসিউর রহমান ও কলমযোদ্ধা-অজন্তা প্রবাহিতা

454
গল্পে ও আড্ডায় শিক্ষক ও প্রকৃতি প্রেমী মসিউর রহমান ও কলমযোদ্ধা- অজন্তা প্রবাহিতা

করোনা কালে সনাতন শিক্ষা পদ্ধতির পরিবর্তিত রূপ

গল্পে ও আড্ডায় শিক্ষক ও প্রকৃতি প্রেমী মসিউর রহমান ও কলমযোদ্ধা- অজন্তা প্রবাহিতা


খুব উৎসাহের সাথে আমরা বরণ করেছিলাম বিগত কুড়ি সালটিকে । জানুয়ারী মাস কাটতে না কাটতেই বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে আমরা জানতে পেরেছিলাম চীনের উহান শহরের বহু মানুষ করোনা নামের একটি অদ্ভুত রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যাচ্ছে। এই রোগ থেকে বাঁচতে হলে মাস্ক পরে থাকতে হবে।
সেই সময় মনে হয়েছিল,চীন? সেতো বহুদূরে।
কিন্তু, ফেব্রুয়ারী মাস শেষ হয়ে মার্চ ঢুকতে না ঢুকতেই সেই করোনার থাবা পড়লো সমগ্র পৃথিবীতে।আচমকাই চেনা পৃথিবীর চেহারাটা পাল্টে গেলো।
মাস্ক ,সেনিটাইজার, সোশ্যাল ডিস্টেন্সিঙ ইত্যাদি অনেক নতুন শব্দের সাথে পরিচিত ও অভ্যস্ত হলাম আমরা সবাই।
মোক্ষম শব্দ -“লকডাউন” ( লক-আউট,ট্যাগ আউট )। শব্দটা উচ্চারণ করতেই বন্ধ হয়ে গেল স্কুল ,কলেজ,অফিস সব কিছু। অচল হলো জনজীবন। স্তব্ধ হলো পৃথিবী।
বাচ্চারা স্কুলে যাবার রাস্তা ভুলে বসলো মোবাইলের সামনে -অনলাইন ক্লাসে।প্রথম দিকে ব্যাপারটা নতুন বলে ভালো লাগলেও ধীরে ধীরে এর কুফল গুলো বোঝা যেতে গেলো।
বন্ধুদেরকে মোবাইলে বা ল্যাপটপ স্ক্রিনে দেখতে পেলেও টিচারের চোখ এড়িয়ে তাদের সঙ্গে কথা বলা,টিফিন শেয়ার করা,কোনো প্রশ্নের উত্তর জানা থাকলে হাত তুলে সবার আগে সেই উত্তর দিয়ে টিচারের বাহবা পাওয়া এসব যেন কোথায় হারিয়ে গেলো। স্কুলের ক্যাম্পাসে বাচ্চাদের ছুটে বেড়ানো, বন্ধুদের সাথে খুনসুঁটি, খেলা ধুলা সবই যেন আজ স্বপ্নের মতো,ধরা ছোঁয়ার বাইরে।
তাও মনে হয়েছিল,একটা বছরের ব্যাপার তো,একটু ধৈর্য্য ধরে থাকলে, সব আবার আগের মতো হয়ে যাবে।
এই ভেবে দাঁতে দাঁত চিপে কুড়ি সাল পার করে অধীর আগ্রহে একুশকে বরণ করে নিলাম আমরা।
কিন্তু করোনা পিছা ছাড়লো না। ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি হলো আরো ভয়ঙ্কর ভাবে। হলাম আবার গৃহবন্দী।
এই বার ধৈর্য্যের বাঁধ ভাঙতে শুরু করেছে সবার।
একটাই প্রশ্ন, আর কত দিন ?

এবছরে আমরা হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছি দ্রুত নগরায়ণের ফলাফল। এটা আছে, তো ওটা নেই। বাঁচার জন্য যে অক্সিজেন দরকার তার অভাব চূড়ান্ত । পরিস্থিতি এতটাই প্রতিকূল যে অনিচ্ছা সত্বেও সব মেনে নিতে হচ্ছে আমাদের।
ধীরে ধীরে সব আবার আগের মতো হলেও স্কুলের দরজা ছাত্রদের জন্য খোলে নি। সবাই আজও অন লাইন ক্লাসেই পড়াশুনা করছে। সনাতন শিক্ষার এই পরিবর্তিত রূপ ছাত্রদের কিভাবে প্রভাবিত করছে সেটা জানবার জন্যই মুখোমুখি হয়েছিলাম ছাত্রদের প্রিয় মসিউর রহমান স্যারের সাথে। ইনি কলকাতায় একটি স্বনাম ধন্য স্কুলে দীর্ঘ দিন ধরে শিক্ষকতা করছেন। ছবি তোলা ও প্রকৃতির রহস্য উন্মোচন ওঁনার হবি। বহু পত্র পত্রিকায় ওঁনার তোলা ছবি আমরা দেখতে পাই। উনি নিয়মিত সোশ্যাল মিডিয়াতে ও ম্যাগাজিনে বিভিন্ন ধরণের পাখী ও জীব জন্তু নিয়ে লেখালেখি করেন।
বেশি কথা না বাড়িয়ে স্যারের সঙ্গে সরাসরি আলোচনায় চলে যাই।
-নমস্কার স্যার।

  • নমস্কার।
    ১) করোনার আগমনে সনাতন শিক্ষা পদ্ধতি পরিবর্তিত হয়ে আজ ‘অন লাইন ক্লাস’।
    কুড়ি সালে আচমকাই আমরা ফিজিক্যাল ক্লাস থেকে ভার্চুয়াল ক্লাসে জাম্প করেছি। এবছরও একই ভাবে ক্লাস চলছে।
    প্রচলিত শিক্ষা পদ্ধতির এই পরিবর্তন বাচ্চাদের ওপর মানসিক ভাবে কি প্রভাব ফেলেছে? ওদের প্রতিক্রিয়া কি দেখতে পান
    ?
    উত্তর-প্রথমেই বলি,ফিজিক্যাল ক্লাস ও ভার্চুয়াল ক্লাসের কোনো তুলনা হয় না।
    ক্লাসে দাঁড়িয়ে ছাত্রদের চোখে চোখ রেখে পড়ানো আর মোবাইল স্ক্রীনে পড়ানোর মধ্যে আকাশ পাতাল তফাৎ। শিক্ষক ও ছাত্রের ‘ইউনিক বন্ডিং’ ভার্চুয়াল ক্লাসে কোনো ভাবেই সম্ভব নয়। টিচার প্রাণ ঢেলে পড়াতে চাইলেও কোথাও যেন একটা অতৃপ্তির অনুভব হয়। পুরো ক্লাসের সেশনটা ডিপেন্ড করে নেট কানেকশনের ওপর। কানেক্টিভিটি দুর্বল হলেই লিংক কেটে যায়।
    ক্লাস নেবার আগে আমাদের মাথায় এটা থাকে কিভাবে খুব কম সময়ে পুরো বিষয়টাকে ছাত্রদের বোঝানো যায়।
    তাই আমাদের নিজেদের বিশেষ ভাবে হোমওয়ার্ক করতে হয়। বোর্ড ওয়ার্কের বিশেষ সুযোগ না থাকলে পাওয়ারপয়েন্টপ্রেজেন্টেশন বানিয়ে সহজ ভাবে ছাত্রদের বোঝানোর চেষ্টা করা হয়।
    তবে ,যেহেতু সবটাই ভার্চুয়াল, তাই, ক্লাসে পড়িয়ে যে আনন্দ পেতাম সেই অনুভূতিটা এখন ঠিক হয় না। বাচ্চারাও নিরুপায়।ওরাও শিক্ষার এই নতুন পদ্ধতিকে মেনে নিয়েছে। তবে অবশ্যই বন্ধুদের সান্নিধ্য ওরা খুব মিস করে।
    ২ )একসময় বাচ্চাদেরকে আমরা গ্যাজেট থেকে দূরে রাখার চেষ্টা করতাম।
    সেই গ্যাজেটই এখন ওদের জন্য স্কুল ও পড়াশুনার মাধ্যম।
    এতে বাচ্চাদের মানসিকতার কোনো প্রভাব কি লক্ষ্য করেছেন? ওরা কি পুরো ব্যাপারটার সাথে খাপ খাওয়াতে পেরেছে ?

উত্তর – এই প্রশ্নের এর উত্তর দেওয়া খুব কঠিন। ।পরিস্থিতির দাবী অনুযায়ী অন লাইন ক্লাসের জন্য মোবাইল বা ল্যাপটপ ব্যবহার করতেই হবে।অতএব, এই পরিবর্তনকে যত তাড়াতাড়ি মেনে নেয়া যায় ততই বিষয়টা সহজ হবে । বাচ্চারা সহজাত ভাবেই পরিবর্তনের সাথে ‘কেমোফ্লেজ’ হতে পারে। তাই ওরা খুব সহজ ভাবেই অন লাইন ক্লাসের সাথে নিজেদের মানিয়ে নিয়েছে। আজকাল এই ‘অন লাইন’ পড়াশোনা করতে করতে বাচ্চারা , এর মধ্যেই তাদের আনন্দ খুঁজে নিয়েছে। জুম মীটিং মোডে , জন্ম দিনের আড্ডা , গল্প , বন্ধুদের মধ্যে খুঁনসুটি এগুলো সবই ভার্চুয়াল মোডে করছে।বন্ধুদের সঙ্গে খেলার জায়গা নিয়েছে ইন্টারনেট গেম পোর্টালে , অনেকে মিলে বিভিন্ন গেম খেলা। এইটাই হয়ত ঠিক যে , প্রয়োজনীয়তা মানুষকে নতুন দিক খুঁজে নেবার দিশা দেখায়।
৩)কুড়ির কোভিড পরিস্থিতি ওএকুশের কোভিড পরিস্থিতি অনেকটাই আলাদা।আজ অক্সিজেনের জন্য হাহাকার চারিদিকে।
এই সমস্ত পরিস্থিতি দেখে আপনার কি মনে হয়,আমাদের সবার কী করা উচিত?

উত্তর – আপনার প্রশ্নের উত্তর দু ভাগে দিচ্ছি।
ক) সবার আগে নিজেকে সুস্থ ও সেফ রাখা উচিত। আমরা সবাই জানি কোভিড আক্রমণে ফুসফুস দুর্বল হয়ে পড়ে। ফুসফুসকে সতেজ রাখতে গেলে নিয়ম করে প্রত্যেককে প্রাণায়াম ও ব্রিদিং এক্সারসাইজ করা উচিত ।
খ ) প্রকৃতি ও মানুষ একে অপরের পরিপূরক। আমরা সবাই জানি,গাছ অক্সিজেন ছাড়ে মানুষ অক্সিজেন গ্রহণ করে। আবার মানুষ কার্বন ডাই অক্সাইড ছাড়ে ও গাছ সেটা নেয়। কাজেই গাছ কাটার আগে একটু ভাবনা চিন্তা করা দরকার। অনুপাতে মানুষের সংখ্যা, গাছের সংখ্যা থেকে বেড়ে যাওয়াতে নানান ধরণের সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। অতএব,অবশ্যই নিয়ম করে গাছ লাগানো উচিত। যেকোন উৎসবের সূচনা গাছ লাগিয়ে করা যেতে পারে।বাচ্চাদের জন্মদিনে রিটার্ন গিফট হিসেবে গাছ দিলে বেশ ভালো হয়। একটি গাছ একটি প্রাণ।তাদের যত্ন নিয়ে বড়ো করতে পারলে আমাদেরই লাভ।এই সাধারণ কথাটা ছোট থেকে বোঝাতে পারলে বেশি ভালো ফলাফল পাওয়া যাবে।

৪ ) বন সংরক্ষণ ও জীব সংরক্ষণের জন্য আমাদের কী ভাবা উচিত? এর জন্য আমাদের কিভাবে এগোনো প্রয়োজন ?

উত্তর – charity begins at home.
বাড়িতে বাগান তৈরী করার অভ্যেস করা উচিত। বাচ্চারা বাড়িতে গাছের যত্ন নিতে শিখলে ভবিষ্যতে বন সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা বুঝতে শিখবে।

৫ ) স্কুলের সিলেবাসে প্রকৃতি সংরক্ষণের ব্যাপারে কিভাবে শেখানো হয় ?


উত্তর -সিলেবাসে সংরক্ষণের ব্যাপারে চ্যাপ্টার আছে ও প্রতিটি স্কুলে সেই বিষয়ে পড়ানো হয়ে থাকে। প্রকৃতি নিয়ে সকলেই এখন বেশ সচেতন।আশা করি, অদূর ভবিষ্যতে পৃথিবীর চেহারাটা আরো সুন্দর হবে।

৬)আপনি নিজে কিভাবে এই প্রকৃতি সংরক্ষণের কাজ করতে চান?

উত্তর – শিক্ষক হিসেবে আমার সুবিধে এই যে, ছাত্রের সাথে সাথে অভিভাবকরাও আমার কথা শোনেন ও বোঝার চেষ্টা করেন।
নিজের আশেপাশের মানুষকে প্রকৃতির বিষয়ে সচেতন করা আমার বিশেষ হবি।বাড়ির আশেপাশে গাছ লাগিয়ে তার দেখা শোনা করার চেষ্টা করি।এই কাজের সাথে যারা যুক্ত তাদের বিভিন্ন ভাবে সাপোর্ট দেবার চেষ্টা করি।

৭) আপনি একজন প্রকৃতি প্রেমী সে কথা আমরা সবাই জানি। ছবি তোলা আপনার শখ। বছরে অনেক বার আপনি ছবি তুলতে বনে জঙ্গলে পাহাড়ে যান। ফিল্ডে ,কোভিডের আগে ও পরে কোনো তফাৎ চোখে পড়েছে কী?

উত্তর – ছবি তোলাটা আমার শখ ,এক কথায় এটা বললে বোধহয় ব্যাপারটা অসম্পূর্ণ বলা হবে । একটু গুছিয়ে বলি ব্যাপারটা।
ধরুন ,আমি বাড়ির যত্ন নেবো। আমার বাড়ির কোথায় কি রাখা আছে,কতটা রাখা আছে, সেই ব্যাপারগুলো জানা না থাকলে আমি বাড়ির খেয়াল রাখবো কি করে ? ঠিক সেই ভাবেই , আমার আশেপাশের বনজঙ্গলে কোথায় কী আছে জানবার জন্য যখনই সময় পাই ক্যামেরা কাঁধে বেড়িয়ে পড়ি। ছবি তুলি। যাঁরা এইসব জায়গায় পৌঁছাবার ইচ্ছা থাকলেও যেতে পারেন না আমার তোলা ছবি দেখে সেই জায়গার সাথে পরিচিত হন।সেই জায়গার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য ও জীব জন্তুদের ব্যাপারে সজাগ হন।
গত বছর কোভিডের সংক্রমণ একটু কমে আসার পরে আমি বেশ কয়েক বার ফিল্ডে গেছি। তখন দেখেছি,স্থানীয়রা প্ৰকৃতি সংরক্ষণের ব্যাপারে আরো বেশি সচেতন হয়েছে। স্বচ্ছতা ও হাইজিনের ওপরেও বিশেষ নজর রাখছেন।
ফলে আমার মনে হয় আগামী দিনে মানুষ আরও সচেতন হবে ও প্রকৃতি ও বনজ সম্পদকে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করবে।
আপনার কথা শুনে খুব ভালো লাগলো স্যার। শেষ করার আগে একটি বিশেষ প্রশ্ন-
একটা শব্দ আমরা প্রায়ই শুনছি,মেন্টাল হেলথ। এই ব্যাপারে আপনার মতামত জানতে চাই।
-Mental health is the state of Mental condition of the person. Mental health is as important as physical health. Both r connected to each other.
শরীরকে সুস্থ রাখার জন্য যেমন নিয়মিত ব্যায়াম প্রয়োজন ঠিক তেমনি,মনকে ভালো রাখতে গেলে ভালো ও সুস্থ চিন্তার প্রয়োজন। শুধু কোভিড পরিস্থিতি বলে নয়,সব পরিস্থিতিতেই মনকে ভালো রাখা দরকার।Calmness and peace of mind are human phenomena. There are people who are calm and people who are restless all over the world.
অতএব ,মনকে স্থির রাখতে হলে ভালো গান,সৃষ্টি মূলক চিন্তা,ভালো বই পড়া,কাছের বন্ধুর সাথে মন খুলে কথা বলা, আর অন্ততঃ পনেরো মিনিট মেডিটেশন করলে মনে হয় মনের স্বাস্থ্যও ভালো থাকবে।
ধন্যবাদ স্যার।
আপনার সাথে আলোচনা করে ভীষণ ভালো লাগলো ।সুস্থ থাকবেন।ভালো থাকবেন।
-আপনিও ভালো থাকবেন।
ধন্যবাদ।

অজন্তা প্রবাহিতা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here