কবি অনিকেত মহাপাত্রের সাক্ষাৎকার

835
Doinik-Alap-অনিকেত-মহাপাত্র-সাক্ষাৎকার
কবি অনিকেত মহাপাত্র

কথামুখ: কবির আবার দেশ হয় নাকি? জন্মাতে পারেন কোনো একটি ভৌগোলিক খণ্ডে কিন্তু তিনি সবার। আর আজকে যাঁর সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়েছে তাঁর ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট সীমায় বাঁধতে না পারার ব্যাপারটি আরও বেশি করে খাটে। তিনি অনিকেত অর্থাৎ কবি অনিকেত মহাপাত্র। যিনি নিজের নামের মানে করেন বৃহৎ আশ্রয়ের প্রেক্ষিত দিয়ে। সব খানে তাঁর ঘর। আজ কবির মুখোমুখি পত্রিকার পক্ষে আরাফাত বিন আশিক। শুরু করা যাক কবির একটি বহু প্রশংসিত কবিতার কিছুটা অংশ দিয়ে।

‘‘মিশেল আপনাকে’ কবিতাটি অনেকেই পড়ে থাকবেন। তারই নির্বাচিত কিয়ৎ —–

“কালো রঙে সবাই চমকে উঠত

নিরন্ধ্র অন্ধকার

কফি বাগিচায় জন্ম, কাটিমোর করেছে পালন

কাউভেরি সামনামী হতেই পারত

বর্ণ আগুন জ্বেলে দিয়ে…….

কফিখেত থেকে সাদাবাড়ি

মূর্ছা গেছে

মিনমিনে হয়ে  নিগার নিগার

দুবেলা সেধে তোলা গলাগুলো

শতাব্দীর  প্রথম যামে

তরতরিয়ে ওঠা কালো কালো ঢেউ

স্পর্শদোষে

শ্বেত বেলাভূমি কালোর অভিজ্ঞান

নীল চোখ ঝাপসা হয়ে

ভরাট সূর্যতীর্থ গড়ার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে

রঙের গিমিক সাম্রাজ্য

ভেঙে দিয়ে

অযাচিত পোষক আবিষ্কার করে

নিজের ঋদ্ধির প্লাবন তখন।”

প্রশ্ন: আপনার কবিতার পাঠক এখন প্রায় সারা বিশ্ব জুড়ে। কারণ এই অন্তর্জাল নির্ভর যোগাযোগের যুগে একজন কানাডা বা অস্ট্রেলিয়া কিংবা প্যারিসে থাকা বাংলাভাষী পাঠক খুব সহজে ঢাকা বা কলকাতাতে বাংলা কবিতার সৃষ্টির খোঁজ পাচ্ছেন। আমাদের কাছে আপনার সম্পর্কে অনেকেই যোগাযোগ করে জানতে চাইছেন। আর ব্যক্তিগতভাবে দেখেছি আপনার কবিতা আমাদের মুগ্ধ করে এবং ঋদ্ধ করে। আবার আপনার সম্পর্কে আমরা যতটুকু জেনেছি কবিতা বাদ দিয়ে, প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার জগতেও আপনার খ্যাতি আছে। আপনি একজন নামী অধ্যাপকও। অধ্যাপক নিয়োগের চূড়ান্ত পর্যায়ে আপনি প্রথম হয়েছিলেন সমস্ত পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের মধ্যে। আর ভারতে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য চর্চার পীঠস্থান পশ্চিমবঙ্গ। তাই সেই পরীক্ষা ছিল প্রায় সর্বভারতীয়। তাতে প্রথম…….. সেক্ষেত্রে কোন পরিচয়টি বেশী ভালো লাগে? কবি অনিকেত মহাপাত্র নাকি অধ্যাপক অনিকেত মহাপাত্র?

উত্তর: বেশ কঠিন প্রশ্ন। তবে এইক্ষেত্রে আমার উত্তর বেশ পরিষ্কার আমি পছন্দ করব কবি অনিকেত মহাপাত্র—-এই পরিচিতটিকে। কবিতা লিখছি আড়াই দশক ধরে। খুব সিরিয়াসলি লিখছি অন্তত দুই দশক। ফলে অবচেতনে এই পরিচিতির ছাপ খুবই স্পষ্ট। আর অধ্যাপনা করছি বছর ছয়েক। প্রথমে অতিথি অধ্যাপক হিসেবে তারপর এই 2020 খ্রিস্টাব্দের ফেব্রুয়ারিতে পূর্ণ সময়ের অধ্যাপক রূপে কাজ শুরু করেছি। কবিতা আমার একান্ত পরিচয়কে প্রকাশ করে। তাই অবশ্যই কবি অনিকেত মহাপাত্র।

প্রশ্ন: আপনার শৈশবকাল কেমন ছিল?

উত্তর: আমি আমার শৈশবটাকে অতিবাহিত করেছি খুব ডাকাবুকো ভাবে। ভয়ডর বরাবরের মত তখনও কম ছিল। আশেপাশের বেশ কয়েকটা গ্রামে হঠাৎ হঠাৎ ঘুরতে চলে যাওয়া ছিল আমার প্রায় প্রাত্যহিক কাজ। তবে বড় হয়ে শুনেছি আমি অনেকের কাছে যে বাবাই, (আমার ডাক নাম) দুরন্ত ছিল কিন্তু অসভ্য ছিল না। আমি মামাবাড়িতে বড় হয়েছি; দিদা সুভাষিণী দেবী সহ মামা মামীদের যত্নে ও ভরপুর আদরে। হয়তো এটি আমার একটি কষ্টের জায়গা, আজ সর্জন-ক্ষেত্রে অর্থাৎ লেখালিখির জগতে পরিচিতি তৈরি হয়েছে এবং প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার চর্চাক্ষেত্রে হয়তো জায়গা তৈরি করা গেছে। তা কিন্তু আর দেখে যেতে পারলেন না দিদা।

প্রশ্ন: কিশোর বয়সে কি কখন প্রেমে পড়েছিলেন?

উত্তর: ওই রকম প্রেমে পড়া হয়ে ওঠেনি। তবে কৈশোরের স্বাভাবিক চাঞ্চল্য ছিল।  কৈশোর থেকে প্রেম বা নারী সম্পর্কে এইরকম একটি মানস-রূপাবয়ব গড়ে উঠেছিল যে এমন কাউকে চাই যাকে দেখে মরে যেতে ইচ্ছে করবে। কিংবা যাকে দেখে মনে হবে তাকে ছাড়া বাঁচবো না। তবে এই প্রসঙ্গে একটু বলে রাখা ভালো কবিতা আমার প্রথম প্রেম। আর দ্বিতীয় হল আকাশ দেখা।

প্রশ্ন: আপনার ছাত্রজীবন কেমন ছিলো? সে সময় শিক্ষক ছাত্র সম্পর্ক কেমন ছিল?

উত্তর: এই একটি ক্ষেত্র যে কারণে আমি খুব ভাগ্যবান। আমার ছাত্রজীবন খুব আনন্দের সঙ্গে কেটেছে। শিক্ষা ব্যাপারটিকে আমি বরাবর ভালোবাসি। আমার ব্যক্তিগত জীবন ঋদ্ধ হয়েছে এই পর্যায় দিয়ে। বরাবর ভালো ছাত্র বলে পরিচিত ছিলাম। স্কুল স্তর থেকে শুরু করে ইউনিভার্সিটি স্তর পর্যন্ত। আমি এখনও সারাদিনে ঘন্টা বারো কাটাই পড়া ও লেখালিখি  নিয়ে। অনেক সময় আমার প্রতিবেশী এবং আত্মীয়রা প্রশ্ন করেছেন কী এমন করি বই-পেন  নিয়ে সারাদিন। এখন অবশ্য ওঁরা নিজেদের বাড়ির ছোটদের আমার দৃষ্টান্ত দেন।

আমার শিক্ষক ভাগ্য বরাবরের জন্য বেশ ভালো। আমার সঙ্গে হাই স্কুল, কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয় স্তরের শিক্ষক ও অধ্যাপকদের সম্পর্ক আজও অটুট। আসলে শিক্ষকদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিলাম সবসময়। তাই হয়তো নিজের শিক্ষক জীবনে প্রভূত সম্মান পাই ছাত্রদের থেকে। সময় অনুযায়ী কিছু বদল ঘটেছে কিন্তু আজও কোনো শিক্ষক যদি নিজেকে ঠিকভাবে প্রস্তুত করতে পারেন ও ছাত্রদের প্রতি স্নেহপরায়ণ হন তাহলে সম্পর্কে কোনো ঘাটতি থাকে না। আমার ব্যক্তিগত জীবনে বন্ধু সংখ্যা খুব সীমিত। সেটি ভরাট হয়ে গেছে প্রিয় শিক্ষকদের দিয়ে।

প্রশ্ন: আপনার কবিতা বা অন্যান্য লেখালেখি করতে ইচ্ছে হলো কেন?

উত্তর: এর সুনির্দিষ্ট উত্তর আমার কাছে নেই। কিংবা ভালো করে মনে নেই। কবিতা পড়া এবং সেই ছোটবেলায়  ওইরকম কিছু লেখার চেষ্টা করা। এইভাবেই বোধহয় হয়েছিল। কবিতা এমনভাবে মিশে গেছে আমার সত্তার সঙ্গে, তার থেকে বিচ্ছিন্নতা তৈরি করে তাকে নিয়ে চিন্তন বোধহয় পীড়া দেয়। তবে বেশ মনে পড়ে শরতের প্রকৃতি ও  সঙ্গে পুজোর আবহাওয়া আমার মনকে উদাস করত। তখন লিখতে ইচ্ছে করত কবিতা। বিভিন্ন শারদীয় পত্রিকাগুলি পড়ে প্রেরণা পেতাম নিজে লেখার। আবার মনে পড়ে হাই স্কুলে পড়ার সময় ক্ষুদিরাম বসু ও নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর জন্মদিন উপলক্ষে কবিতা লিখছি। আর আমার মামা তা দেখে দিচ্ছেন কোনো বানান ভুল হল কিনা। বন্ধুকে নিজের কবিতা দিচ্ছি যাতে সেও দেওয়াল পত্রিকার জন্য লেখা জমা দিতে পারে। তবে প্রথম গল্প লেখার কথা মনে আছে ওটা দুহাজার সাল, কলকাতায় মামারবাড়িতে  থাকছি তখন। মামা অর্থাৎ কথাকার স্বপন পান্ডা নিজের লেখালিখি সারতেন রাত জেগে। মামার লেখার ঘরে আমি চলে এসেছি মামার মত গল্প লিখব বলে। লিখে ছিলাম। মামা কিছু কিছু পরামর্শ দিয়েছিলেন সেগুলি আজও মনে আছে। কিন্তু গল্পটির খোঁজ আর নেই। নামটাও মনে নেই। আর প্রবন্ধ লেখার শুরু হঠাৎ করে। কলেজের ফার্স্ট ইয়ারে পড়ার সময় ‘উপকূল বার্তা’ নামে কাঁথির একটি দৈনিক পত্রিকায়। আর সিরিয়াস প্রবন্ধ লেখার শুরু 2010 এর পরে পরে। ’তথ্যসূত্র’, ‘পরিচয়’, ‘দেশকাল ভাবনা’, ‘প্রমা’, ‘একালের রক্তকরবী’, ‘পূর্বাশা এখন’, ‘বৃত্তের বাইরে’, ‘আলাপপর্ব’, ‘অভিযাত্রী ফেরি ‘‘সৃজন’, ‘তবু একলব্য’, ‘এবং সংস্কৃতি’ প্রভৃতি পত্রিকায় নিয়মিতভাবে প্রবন্ধ লিখে গেছি l তবে নিভৃতে চলছিল কবিতা চর্চা।

প্রশ্ন: প্রেম ও ভালবাসা এই দুটি বিষয়ে আপনার মন্তব্য জানতে চাই?

উত্তর: প্রেম ও ভালোবাসা, অনন্য দুটি অনুভূতি l মানুষের আমূল রূপান্তর হয় এই অনুভূতিগুলির সংযোগে বা বিয়োগে l তবে আমি বিষয়দুটিকে ব্যক্তি সম্পর্কের সীমা ছাড়িয়ে আরও বড় প্রেক্ষিতে দেখতে চেয়েছি l নিজের শেকড়কে ভালোবাসা নিজের ভিত্তিভূমির প্রতি প্রেম l বিশ্বপ্রেমের আধারে প্রত্যয়ী হয়েও আমি কিন্তু দেশ নামক বিশিষ্ট অনুভূতির ব্যাপারে যথেষ্ট সংবেদনশীল l এই দেশ নামক অনুভূতি অনেক কাপুরুষকেও বীর করে তোলে l স্বার্থপরও পরার্থপর হয়ে যায় l দেশ নামক চিন্তনের ব্যাপারে অনেকেরই এলার্জি আছে কারণ তাঁরা বেশ আধুনিক l তাঁরা বিশ্ব ভ্রাতৃত্বের কথা বলেন l তাঁরাই আবার বাবা মা-কে প্রায় অকারণেই বৃদ্ধাশ্রমে ফেলে আসেন, দেখতে যান না, খরচ বাবদ এমন চেক দেন যা বাউন্স করে l মা-বাবার মৃত্যুর পর অবশ্য বেশ বড় করে স্মরণসভা করেন l তাঁরা আবার মূল্যবোধ নিয়ে বেশ বড় বড় লেখা লেখেন l তবে এই প্রসঙ্গে আর একটি কথা বলতে চাই l আমি নর-নারীর সাধারণ প্রেম সম্পর্কের ক্ষেত্রে কোনোরকম ট্যাবুতে আস্থাবান নই l শর্তহীন হোক সেই সম্পর্ক l সামাজিক দায়ের নামে নারীর ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যকে খাটো করার যে প্রবণতা আছে তারও  বিরোধী l

প্রশ্ন: আপনার লেখালেখির প্রেরণা কি বিশেষ কেউ বা কিছু?

উত্তর: অহৈতুকী প্রেরণা বলা যেতে পারে l বই এবং পারিবারিক পরিবেশ হয়তো কিছুটা কাজ করেছে l তবে কবিতা নিজেই প্রেরণা হয়ে দাঁড়ায় নিজেকে নতুন নতুন রূপে দেখতে l তা-ই বোধহয় জন্ম দেয় কবির l তবে কবি শঙ্খ ঘোষ,নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী  মৃদুল দাশগুপ্ত,কালীকৃষ্ণ গুহ, শ্যামলকান্তি দাশ, অন্যদিকে কবি সুবোধ সরকার, বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়, শ্রীজাত কিংবা আবার  আর এক ধারার কবি জয়দীপ ষড়ঙ্গীদের কবিতা প্রেরণা দিয়েছে যখন আমি কবিতা লিখতে শুরু করি কিংবা লিখছি l

প্রশ্ন: আপনার প্রিয় মানুষ সম্পর্কে জানতে চাই?

উত্তর: আমার দুই মামা যাঁদের কারণে আমি নিশ্চিন্ত শৈশব ও কৈশোর পেয়েছি l আমার বড় মামা শ্রীকালিপদ পণ্ডা, যিনি তিনমাসের ক্ষুধার্ত শিশুটির মুখে খাবার তুলে দিয়েছিলেন আর দায়িত্ব নিয়েছিলেন l নাহলে হয়তো আমি প্রাণেই বাঁচতাম না l আর ছোটোমামা শ্রীস্বপন পান্ডা, যিনি  শিক্ষার দায়িত্ব সহ আমার মানস-নির্মাণের কাজটি করে দিয়েছিলেন l আমার সর্জন কর্মের ধাঁচাটা তাঁর অনুরূপে নির্মিত l কাকতালীয়ভাবে আমাদের জীবনের অনেকগুলি ঘটনা প্রায় একই রকম l

বামে: কালিপদ পান্ডা | ডানে: স্বপন পান্ডা

প্রশ্ন: আপনাকে যদি কোন কবিতা বা উপন্যাসের চরিত্র হতে সুযোগ দেওয়া হয়..কোন চরিত্রটি ধারণ করতে চাইবেন?

উত্তর: কবিতায় ওইভাবে চরিত্র নির্মাণ করা একটু সমস্যার l তারপর তো আসে চরিত্রকে ভালো লাগা বা সেই চরিত্র হতে চাওয়া l তবুও কবিতার ক্ষেত্রে চরিত্র বলতে গেলে আমার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘দুইবিঘা জমি’ কবিতার উপেনকে বেশ ভালো লাগে l ‘তাই লিখি দিল বিশ্বনিখিল দু বিঘার পরিবর্তে’— এই স্পিরিটটি আমার বেশ ভালো লাগে l হয়তো হতেও ইচ্ছে করে l যা আমার মেজাজের সঙ্গে খাপ খায় বেশ l তবে উপেনের বেশ কিছুদিন বাইরে থেকে আবার ফিরে আসার ব্যাপারটা মেলে না l আর যদি উপন্যাসের কথা বলা যায় তবে অবশ্যই হাওয়ার্ড ফাস্ট-এর ‘স্পার্টাকাস’ উপন্যাসের নাম চরিত্র l যে চরিত্র আমাকে জাগায়, আমার প্রতিরূপ হয়ে ওঠে l আমার নিজের জীবনের লড়াইয়ের সময় নিজেকে স্পার্টাকাস মনে হত ; যাকে প্রায় অসম্ভবকে সম্ভব করার লড়াইয়ে নামতে হয় l আজও l জয় ?  সে আর কোনো লুপ্ত হয়ে যাওয়া শব্দ l তবুও লড়তে হয় l স্পার্টাকাস আমার স্বপ্নের চরিত্র l বোধহয় এই পছন্দ থেকে আমার সর্জন-বৈশিষ্ট্যও নির্মিত হয় l নিছক ভাবালুতা, প্যানপ্যানানি একেবারেই পছন্দের নয় l

প্রশ্ন: আপনার শিক্ষা ও কর্মজীবন সম্পর্কে জানতে চাই?

উত্তর: আমার শিক্ষা কিছুটা অংশ মেদিনীপুর, কিছুটা বঙ্কিমচন্দ্রের জন্মস্থান নৈহাটি ও রামপ্রসাদ সেনের হালিশহরের মাঝের একটা ছবির মত জায়গা বালিভাড়াতে, আর বেশ কিছুটা কলকাতায় সম্পূর্ণ হয়েছে l কর্মজীবন অতিবাহিত হয়েছে আমার যেখানে জন্ম, সেই এগরাতে l বিভূতিভূষণের প্রিয় স্থান  ঘাটশিলাতে l তারপর কলকাতাতে l এখনও l

প্রশ্ন: আপনার লেখালেখির অন্দরের কথা বলুন l

উত্তর: আপনাদের আগেই বলেছি আমাদের পরিবারে ক্রিয়েটিভ লেখালিখির একটি ধারা ছিল l তাই সেই ঘরানার প্রেরণা ও চিন্তন আমার ওপর প্রভাব ফেলেছিল l যার মূল কথা,  লেখা নিয়ে সময় ধারাবাহিকভাবে দিতে হবে l আর বিশেষ কিছু প্রিয় অংশ নিয়ে বিশেষ যত্ন নিতে হবে l তাকে নীরবে চর্চা করে যেতে হবে দীর্ঘ দিন ধরে l চেষ্টা করতে হবে সেই প্রিয় বিষয়কে একটি বিশেষ সময় পর্যন্ত প্রকাশের চেষ্টা না করতে  l কারণ প্রকাশ যেমন উৎসাহিত করে তেমনি আবার নিরাশও করতে পারে l প্রকাশ হলেও অনেক বিড়ম্বনা l অভিনন্দন সামনে, পেছনে ঈর্ষা l মনের ওপর বিভিন্ন রঙের ছায়াপাত নিভৃত সাধনার  প্রতিকূল l যদি সৃষ্টির ভিত্তিভূমি না তৈরি করা যায় ঠিকভাবে, তাহলে পরে খ্যাতি এলে, ব্যর্থতা এলে কোনোটিকেই পরিপূর্ণভাবে গ্রহণ করে শিক্ষা নেওয়া যাবে না l যেমন আমার কবিতা যাপনের সিরিয়াস প্রায় দুই দশকে প্রথম দশক কিছু কবিতা নামী অনামী পত্রিকায় প্রকাশ করলেও  দ্বিতীয় দশকে আমি নিয়মিত লিখে গেছি  কিন্তু একটিও কোথাও ছাপতে দেওয়া তো দূরের কথা,  যে সম্পাদকদের সঙ্গে আগে কাজ করেছি বা তাঁদের পত্রিকায় কবিতা লিখেছি, তাঁরা কবিতা চাইলে বলেছি —– আমি কবিতা লেখা ছেড়ে দিয়েছি l নিতে চাইলে প্রবন্ধ দিতে পারি l  কিন্তু কবিতার চর্চা করে গেছি নিয়মিতভাবে l আমার কবিতার এক দশকের অজ্ঞাতবাস শেষে নতুন দশকে কবিতা নিয়ে নতুন চিন্তন বিন্যস্ত হল, তখন ঠিক করলাম এইবার কবিতাকে আবার লোক চক্ষুর সামনে আনা যেতে পারে  l তবে সেই সঙ্গে এটিও বলে রাখা ভালো অজ্ঞাতবাসের এক দশকে লেখা  কোনো কবিতা কিন্তু এখনও প্রকাশিত হয় নি l সদ্য লেখা কবিতাই পাঠক পড়ছেন l শুধু একটি কবিতার সিরিজ যেটি প্রায় পাঁচ বছর ধরে লিখেছি, সেটি গ্রন্থ আকারে প্রকাশ পাবে খুব তাড়াতাড়ি l কী নিয়ে সিরিজ তা আজ জানাবো না l একটু রহস্য থাক l আর একটি গ্রন্থ প্রকাশ পাবে ওরই কাছাকাছি সময়ে l তার নামটি বলেই দি, ‘বিষাদ গোধূলি’ l এই নামটিকে আমি বহন করছি আমার মননে প্রায় বছর কুড়ি l

প্রশ্ন: আপনার লেখালিখির ভবিষৎ পরিকল্পনা নিয়ে যদি আলোকপাত করেন l

উত্তর: ক্রমাগত কবিতাকে  লালন করে যাব l আর একটি সাহিত্য সংরূপের ব্যাপারে আমার বেশ আগ্রহ রয়েছে তা হল উপন্যাস l আমার দুটি উপন্যাসের  ইতোমধ্যে পাণ্ডুলিপি প্রস্তুত কিন্তু কমপক্ষে এক থেকে দেড় বছরের আগে প্রকাশের কথা ভাবতে চাইছি না l অন্তত এক বছর বাদে আবার পাণ্ডুলিপি পড়ব l প্রয়োজনীয় সংশোধন করব l তারপর l হয়তো ওই পর্যায়ে সংশোধন করতে গিয়ে পুরো লেখাটাই নতুন করে লিখতে হতে পারে l আমি দেখেছি কবিতা ও উপন্যাস এই দুই সংরূপ আমার জন্য l গল্প লেখা নিয়ে সিরিয়াসলি কিছু ভাবিনি, যদিও আমার লেখা দু’তিনটি গল্প পাণ্ডুলিপি আকারে  পড়ে কিছু বোদ্ধা  মুগ্ধ হয়েছেন আর প্রকাশের জন্যও পরামর্শ দিয়েছেন l তাঁদের মধ্যে রয়েছেন  দুই সম্পাদক l কিন্তু আমি তাঁদের শুভাকাঙ্খার মূল্য দিতে অপারগ  l গোটা আটেক  গল্প লেখা থাকলেও আমি ওই সংরূপ নিয়ে কিছু ভাবছি না l আর নিয়মিত চর্চায় নেই l তবে  আমাকে প্রবন্ধ লিখতেই হবে l কারণ কখনও কখনও এমন কিছু বলার থাকে বা এমন ভঙ্গিতে বলার দরকার হয় যা প্রবন্ধের ক্ষেত্রে অমৃত হলেও কবিতার ক্ষেত্রে বিষবৎ l তাছাড়া যেহেতু অধ্যাপনার ক্ষেত্রে রয়েছি তাই কিছু প্রবন্ধ লিখতেই হয় l হয় নিজের বক্তব্য পেশের  প্রয়োজনে কিংবা অনুরোধে !

প্রশ্ন: শেষ প্রসঙ্গ, তরুণ কবি ও লেখকদের উদ্দেশে কিছু বলবেন?

উত্তর: তরুণ শব্দটি বেশ আপেক্ষিক l বাংলা সাহিত্যের ক্ষেত্রে  এখনও অনেক স্রষ্টা  লিখে চলেছেন যাঁদের কাছে হয়তো আমরা  অনেকটাই তরুণ l তবে আবার যাঁরা লেখা শুরু করেছেন l আমার ছাত্ররাও অনেকে l তাদের একটি কথা বলার,  সর্জনের জন্য সময় ও অজ্ঞাতবাস দরকার l এই ভিত্তিভূমি  তৈরি হয়ে গেলে খ্যাতি পেছনে দৌড়োবে, তার পেছনে দৌড়োনোর দরকার নেই l আর ধৈর্য ধরে লিখে যাওয়ার মানসিক প্রস্তুতি l নিজের সঙ্গে বোঝাপড়া করে নিতে হবে আমি কোন সংরূপের জন্য l  এইটুকু হলেই হবে l

প্রশ্ন :আপনার প্রিয় আপনারই কবিতার লাইন l

উত্তর: “এই আকাশে আমার মুক্তি” কবিতার লাইনগুলি

আকাশ, ভালো করে মরতে চাওয়ার সঙ্গে /আকাশ জড়িয়ে /আত্ম হত্যাও বলতে পারেন /স্বপ্নটা একটু অন্যরকম /একটু পয়সাকড়ি হলে /ভালো করে একটা মরতে, /মহাকাশে গিয়ে টুক করে যান থেকে বেরিয়ে যান /প্রযুক্তিকে সেই ভাবে সাজান /দেহ আপনার ক্রমাগত ঘুরতে থাকবে/পচবে না, নষ্ট হবে না /অনবদ্য প্রাণহীন বেঁচে থাকা দেহের /যদি ছেঁড়ে টুকরো টুকরো হয়ে /আকাশগঙ্গা জুড়ে, মহাকাল ছুঁয়ে /পয়সাকড়ি হলে অমৃতের স্বপ্ন /মৃত্যু তখনও প্রতিরূপ /মৃত্যুবাসা, আকাঙ্ক্ষার চাষ /আকাশ দেখতে দেখতে, মরে গিয়ে /তারা হয়ে যাওয়া /কার্নিশ কখনও মহাকাশ যান /শারাদ হয়ে যায় দিব্য রজ্জু l”

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here