ফেরারি
মাসুমা সুইটি
খালা, আইজকা রাইতে তুমি আমার লাইগ্যা বইয়া থাইকো না ,নাইট ডিউটি আছে- বলে গোগ্রাসে একের পর এক মুখে খাবার পুরতে থাকে জবা।
একটা প্রাইভেট হাসপাতালে আয়ার কাজ করে সে । কাজে একেবারে নতুন বলে তার বেতন অনেক কম । ছ’মাসের আগে আর বাড়ার সম্ভবনা নাই । তাই জবা ঠিক করেছে মাঝে মাঝে দুই শিফট কাজ করবে।এখন বেতন যা পায় তার প্রায় সবটাই রোকেয়া খালার হাতে তুলে দিতে হয় থাকা খাওয়া বাবদ । আবার সে টাকা থেকেই ধার হিসেবে খালার কাছ থেকে নিয়ে বাড়িতে পাঠাতে হয় ।যেখানে তার মুখ চেয়ে বসে আছে প্যারালাইজড বাবা ,মা ও তিন ভাই-বোন।
ইলেকট্রিক মিস্ত্রী ছিল তার বাবা । একদিন থামের উপরে উঠে কাজ করতে গিয়ে বিদ্যুৎপৃষ্ঠ হয়ে পড়ে যান । এরপর তার দুটো পা’ই প্যারাইজড হয়ে যায়। সঠিক চিকিৎসার অভাবে দিন দিন তা আরো খারাপের দিকে যাচ্ছে । অভাবের সাথে লড়াই করে আর পারছিলো না তারা । টাকার অভাবে এস.এস.সি পরীক্ষার আগেই পড়ালেখা স্থগিত । নিরুপায় পরিবারটি গ্রামের শফিক মৃধা কে ধরে শহরে পাঠালো জবাকে । তারপর এই হাসপাতালে জুটলো আয়ার কাজ । হাসপাতালটি যদিও অনেক বড় তবুও আয়ার কাজ তো । নিজেকে মানিয়ে নিতে কষ্টই হচ্ছে । জবা তাই ঠিক করে পড়াশোনাটা যেভাবেই হোক চালিয়ে নিতে হবে।
নাইট ডিউটির কথা শুনে রোকেয়া খালার মুখ ভার হয়। অল্পবয়সী অবিবাহিত মেয়ের এরকম রাতের বেলা বাইরে কাজ করাটা উনি ঠিক মেনে নিতে পারছেন না । বয়স তো তার কম হয়নি , দুনিয়া দেখেছেন ঢের বেশী ।শহরে কত রকম লোকজনের বাস তা গ্রামের এই নিরীহ মেয়েটা জানবে কি করে। জীবিকার প্রয়োজনে তাকে কাজ করতে হয় একটা কারখানায় । স্বামী সন্তান থাকার পরও আজ অবহেলিত জীবন তার ।এই শহর কেড়ে নিয়েছে তার ঘরসংসার। স্বামী হয়েছে অন্যের।ছেলেও বউ নিয়ে আলাদা। একা ঘর ভাড়া দিয়ে কুলানো যাচ্ছিল না বোনের ছেলে শফিক তা জানতো । তাইতো জবাকে এনে তুলেছে এখানে।জবাকে বিদায় করে দরজায় তালা লাগিয়ে বিরসমুখে রওয়ানা হয় কারখানার অভিমূখে ।পথে দেখা হয় শাফায়াতের সাথে।শাফায়াত রোকেয়ার সাথে একই কারখানায় কাজ করে। জবাকে সে দেখেছে রোকেয়ার বস্তিঘরে।
“কি রে কিছু কইবি ?”- বলে দ্রুত পা চালাতে থাকে রোকেয়া ।
শফিক আমতা আমতা করে শেষে বলেই ফেলে। -বলছিলাম কি জবা মাইয়াডারে আমার বহুত মনে ধরছে । তুমি যদি আমার লগে তার বিয়াটা করাইয়া দাও খালা তাইলে তোমার আর ভবিষ্যৎ নিয়া ভাবা লাগবো না । মনে করো যে আমি তোমারে পেটের পোলার লাহান পালমু ।
রোকেয়া থমকে যায় ।- কি কইলি ? যারে পেটে ধইরা এতো বড়ডা করলাম হ্যা অই ফালাইয়া থুইয়া চইলা গেলো আর তুই আমারে খাওয়াইবি । তাও এই অল্প বয়সী মাইয়াটারে বিয়া করার লাইগ্যা ? তর বয়সের কথা না হয় না ই কইলাম তর আগের দুইটা বউও গেছে তর অত্যাচারে বাড়ীর থেইক্যা বাইরাইয়া । আর অহন এই কচি মাইয়ার দিকে তর নজর গেছে ? শাফায়াত তাও পিছু ছাড়ে না । কারখানা পর্যন্ত রোকেয়ার সাথে সাথে ঘ্যানঘ্যান করেই চলে। রোকেয়া আর কথা না বাড়িয়ে কারখানায় ঢুকে পড়ে । কিন্তু মনটা ভীষণ কূ- ডাক ডাকতে থাকে । এই কদিনেই মেয়েটার উপর মায়া পড়ে গেছে। এখন শাফায়াত যদি মেয়েটার কোন ক্ষতি করে বসে ?
শাফায়াতের আনাগোনা বেড়ে যায় রোকেয়ার বস্তিতে। একদিন রোকেয়া ভীষণ রেগে দুর্ব্যবহার করে শাফায়াতের সাথে। জবাও ক্ষেপে যায়। বলে আর কোনদিন যেন এ পাড়ায় না আসে সে। তারপর থেকে আর কোনদিন শাফায়াতকে দেখা যায় না। নিশ্চিন্ত হয় রোকেয়া খালা।জবাও নতুন করে স্বপ্ন দেখে পড়াশোনা শুরু করার। স্বপ্ন পূরনে বেশি বেশি কাজ করতে হবে এটাই শুধু তার মাথায় ঘোরে।
সেদিন নাইট ডিউটি করে খুব ভোরের দিকে দ্রুত বস্তি অভিমূখে রওয়ানা হয় জবা।আজ অফ ডে কিছু খেয়ে শুয়ে পরবে। খুব ক্লান্ত লাগছে তার। মাঝরাতে এক গর্ভবতী মহিলা ভর্তি হয়েছিলো। খুবই ক্রিটিকাল অবস্থায় ছিলো। অন্যান্য রোগীর পাশাপাশি সেই রোগীর পাশেও দীর্ঘ সময় তাকে থাকতে হয়েছে। বিশ্রাম পায়নি একটুও। তার উপর এখনো এসব কাজে অভ্যস্ত হতে পারেনি সে । ক্লান্তিতে রাস্তাতেই শুয়ে পড়তে ইচ্ছে হচ্ছে। আর দুটো ব্লক পার হলেই বস্তির গলি চলে আসবে। হঠাৎ মনে হলো পেছন থেকে কেউ তার নাক-মুখে চেপে ধরেছে। তারপর আর কিছু মনে নেই। শুধু পত্রিকার শিরোনাম হয় -ডোবায় এক কিশোরীর লাশ ভেসে উঠেছে। তার শরীরে ধর্ষনের আলামত পাওয়া গেছে।
এভাবেই কতো জবা হারিয়ে যায় জীবন যুদ্ধে পরাজিত হয়ে।