মসিউর রহমান ( শিক্ষক,ওয়াইল্ড লাইফ ফটোগ্রাফার,স্পোর্টসম্যান ,যুব আইকন )
——————
আমাদের চারিপাশে এমন অনেক মানুষ আছে, যাঁদের দ্বারা আমরা প্রতিদিন অনুপ্রাণিত হই। তাঁরা কখনোই নিজের ঢাকঢোল পিটিয়ে লাইম লাইটে আসার চেষ্টা করেন না। নিজেকে গুটিয়ে রাখেন। আমাদেরই মাঝে থেকে নীরবে জীবনের হার না মানা যোদ্ধার মতো কাজ করেন,চেষ্টা করেন, এক সুস্থ সমাজ গড়ে তোলার।সব থেকে বড় ব্যাপার,ওনারা সময়ের সদ্ব্যবহার করেন খুব কুশল ভাবে।
ঠিক এমনি একজন মানুষ, মসিউর রহমান।পেশায় শিক্ষক। সম্প্রতি কলকাতার একটি স্কুলে উনি পড়ান। ছাত্রদের প্রিয় রহমান স্যার। নেশা, বন্য প্রাণীর ছবি তোলা ও বই পড়া ও ক্রিকেট খেলা।
জন্ম ও বড় হয়ে ওঠা ওনার শান্তিনিকেতনে | শান্তিনিকেতনের ‘শিক্ষাসত্র’ থেকে উনি স্কুলের পড়াশোনা করেছেন এবং বিশ্বভারতী থেকে physical education নিয়ে মাস্টার্স করেছেন |
ওঁনার তোলা ছবি ও খেলার মাঠে ওঁনার অফুরন্ত এনার্জি যুব সমাজকে বিশেষ ভাবে আকর্ষিত করে।
উনি স্বয়ং Lionel Messi ও সৌরভ গাঙ্গুলীর ভক্ত। কিন্তু ছাত্র সম্প্রদায় ওঁনার ভক্ত।দিনে দিনে ওঁনার ভক্তের সংখ্যা বেড়েই চলেছে বই কমছে না।
আমাদেরই মাঝে থাকা এক অসাধারণ মানুষের সাক্ষাৎকার নেবার সুযোগ হয়েছিল কিছুদিন আগে। কিছু প্রশ্নোত্তর ও কিছু আড্ডার মাধ্যমে ওঁনার জীবন দর্শন জানার ও বোঝার চেষ্টা করেছিলাম আমার মতো করে। যা জানতে পেরেছি,বিস্তারিত ভাবে সবাইকে জানাবার চেষ্টা করছি। আশা করি সবার ভালো লাগবে। বিশেষ করে যুব সমাজ মনের মতো রোল মডেল পাবে।
১)প্রশ্ন – ছবি তোলার ঝোঁকটা আসে কোথা থেকে ?
উত্তর -দেখুন ফটোগ্রাফি আমার এক বিশেষ শখ । সত্যি কথা বলতে গেলে এই শখটা আমার বাবার কাছ থেকেই আসে । ওনার অনেকগুলো ক্যামেরা ছিল তখনকার আমলের, আর ছিল খুব ঘোরার শখ। তাই বলতে পারেন ওই শখ টা উত্তরাধিকার সূত্রে আমি পেয়েছি।
২)প্রশ্ন – আচ্ছা ফটোগ্রাফির ব্যাপারে আপনি কোথাও নিয়মমাফিক প্রশিক্ষণ বা ফরমাল ট্রেনিং নিয়েছেন কি?
উত্তর- না ,এই ব্যাপারে আমার বেশিরভাগই ট্রায়াল অ্যান্ড এরর পদ্ধতিতে শেখা, কিছুটা আলোচনার মাধ্যমে, বাকিটা ব্লগ থেকে।
৩)প্রশ্ন – আপনার ফোটোগ্রাফি লাইফের শুরুটা যদি একটু বিশ্লেষণ করে বলেন।
উত্তর -বাড়িতে Yashika ও Fuji ক্যামেরা নিয়ে নাড়াঘাঁটা করবার সুযোগ পাই, ফলে স্কুলে পড়া কালীন অবস্থায় ক্যামেরার ব্যাপারে একটু আইডিয়া তৈরী হয়ে গেছিলো। ছোটবেলার ছোট্ট ছোট্ট চেষ্টা ও ইচ্ছে গুলো বড় হবার সাথে সাথে ডানা মেলে ধরে।
নিজের খরচে Sony cyber shot প্রথম ক্যামেরা কিনি। এই ক্যামেরা দিয়ে প্রথমদিকের ছবি গুলো তুলতে শুরু করি। ধীরে ধীরে ঝোঁকটা নেশায় পরিণত হতে শুরু করে | আরেকটু উন্নত মানের ক্যামেরা কিনি Nikkon Cool Pix |
তারপর কিনি, একটি Canon DSLR 700D। তার সাথে দুটো kit lens ছিলো,একটি 18/55,আরেকটি 55/250।
Canon80D with Tamron 150-600mm g2 VC lens.Nikon D500 with 200-500 Vr lens।
সম্প্রতি Nikon D500with 200-500 mm vr lens ব্যবহার করছি। এর পারফরমেন্স যেকোন গিয়ার্ থেকে বেশ ভালো।
৪) প্রশ্ন – প্রথম থেকেই আপনার কি Wildlife Photographer হবার ইচ্ছে ছিল ?
উত্তর – না।
আমি প্রথম দিকে ল্যান্ডস্ক্যাপ ছবিই বেশি তুলতাম। পাহাড় আমায় ভীষণ ভাবে আকর্ষণ করে। স্কুলের দুটো বড় ছুটি পড়লেই আমি পাহাড়ে ছুটে যাই। ‘বিপুলা এ পৃথিবীর কতটুকু বা জানি বলুন’,প্রকৃতির রহস্যের পেছনে দৌড়োতে দৌড়োতে আমার wildlife photography র প্রতি আকর্ষণ জন্মায়। bird photography সবচেয়ে বেশি চ্যালেঞ্জিং সাবজেক্ট। এতে ধৈর্য্য ও দক্ষতা দুইয়েরই সমান ভাবে প্রয়োজন। চিরকালই চ্যালেঞ্জ নিতে ভালোবাসি, তাই ধীরে ধীরে এই সাবজেক্টের ওপর ফোকাস করা আরম্ভ করি।
৫)প্রশ্ন -wildlife photography তে ফটোগ্রাফারের কি কি সাবধনতা বজায় রাখতে হয় ?
উত্তর – wildlife photography করবার সময় সবার আগে একটা কথা মাথায় রাখা উচিত, প্রাণীরা আমাদের বাড়িতে আসে নি,আমরা ওদের বাড়িতে এসেছি। তাই ওদের কায়দা কানুন মেনে চলতে হবে। নিজের স্বার্থের জন্য কোনো প্রাণীকে আঘাত করে ছবি তোলা উচিত নয়। ওদেরকে বিরক্ত ও বিব্রত না করে ক্যামেরা বন্দি করা উচিত।
৬) প্রশ্ন – কাঙ্খিত ছবি তোলার জন্য আপনি নিজেকে কিভাবে তৈরি করেছেন?
উত্তর- বিভিন্ন বই পড়ে এবং হাতে কলমে প্রয়োগ বিদ্যার মাধ্যমে।
৭) প্রশ্ন -আপনি পাখির ছবি তোলার জন্য কোথায় কোথায় যান ? আপনার ক্যামেরা সেটিং কিভাবে করে থাকেন ?
উত্তর -উত্তরবঙ্গের ওপরে কাজ করতেই আমার বিশেষ ভালো লাগে,লান্ডস্কেপ ও বন্যপ্রাণী সমৃদ্ধ উত্তরবঙ্গের সমস্ত এলাকা আমি আবিষ্কার করতে চাই। ওখানে আমার কয়েকজন বন্ধু আছে, ওদের সাথে বেরোলে অনেক কিছু শেখা যায়, প্রত্যেকেই নিজের নিজের হিসেব মত ইকুইপমেন্ট নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে। এছাড়াও গত একবছরে আমি Garbhanga Reserved Forest,Assam,Manglajodi-Odisha,Sattal &Pangot,Uttarakhand এই কয়েকটা জায়গা ভিসিট করেছি। এবছরেও মে মাসে উত্তরবঙ্গে যাবো বলে রেসারভেশন করেছিলাম। কিন্তু সবাই জানে কি হলো,পুরো পৃথিবী গৃহবন্দী হয়ে গেলো।
ক্যামেরা সেটিংএর ব্যাপারটা পুরোটাই নির্ভর করে সাবজেক্ট ও ডে লাইটের ওপর। আমি আসলে ম্যানুয়্যাল মোডে ছবি তুলি, তাই দরকার মতো সেটা পাল্টাতে পারি, আমি raw তে তুলতে পছন্দ করি,তাতে ন্যাচারাল কালার বা স্বাভাবিক রঙ ফুটে ওঠে।
৮)প্রশ্ন – পোস্ট প্রসেসিং এ আপনি কি ধরনের যন্ত্রপাতি ব্যবহার করেন? দয়া করে আপনার ধারাটি ব্যাখ্যা করুন।
উত্তর- প্রধানত দুটো সফটওয়্যার ব্যবহার করি, Picasa আর first stone image viewer.
৯)প্রশ্ন – আপনার কাজগুলোর মধ্যে এ পর্যন্ত আপনার মনের মত কাজ কোনটি বলে আপনি বিবেচনা করেন?
উত্তর-সমুদ্র শ্যাওলার (Sea Weeds) ওপর একটা কাজ করেছিলাম, ওটাই এখন পর্যন্ত যত গুলো কাজ করেছি তার মধ্যে সেরা। সেটা সল্টলেক স্থিত টেকনো ইন্ডিয়া কলেজের সামুদ্রিক বিভাগের সমুদ্র উদ্ভিদের ওপর একটি প্রজেক্ট ছিল।
১০)প্রশ্ন – আপনার বর্তমান প্রজেক্ট সম্পর্কে কিছু বলুন?
উত্তর- বন্য প্রাণীদের জৈবিক বৈচিত্র্য অথবা বায়ো ডাইভারসিটি অফ এনিম্যালস। প্রাণী সংরক্ষণের জন্য আমি ও আরো তিনজন বন্ধু মিলে একটি ওয়েবসাইট লঞ্চ করেছি। www.lensinwoods.com
প্রকৃতি কত সুন্দর। সেই সৌন্দর্য্যকে আমাদের তোলা ছবি সেখানে শেয়ার করে সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে দেবার চেষ্টা করি। মানুষ সচেতন হলে প্রকৃতির প্রতি সদয় হবে, এটাই আমার বিশ্বাস।
১১) প্রশ্ন -এই কোভিড পরিস্থিতিতে যখন পুরো পৃথিবী বাড়িতে বন্দি,তখন আপনি কি করে এই সময়টা কাজে লাগলেন ?
উত্তর – আর বলবেন না, হটাৎ করে বাড়িতে বন্দি হয়ে যাওয়াতে খুব মন খারাপ হয়ে গেছিলো। আমাদের তো অনলাইন ক্লাস নিতে হয়েছে। তার সাথে যতটুকু সময় ফাঁকা পেয়েছি সেই সময়ে আমি হাতের কাছে ফোটোগ্রাফি সংক্রান্ত যত বই পেয়েছি, পড়েছি। এডিটিংয়ের স্কিলটা আরো ভালো করার চেষ্টা করেছি। আমার পুরোনো ছবি গুলোকে ঘাঁটাঘাঁটি করে নিজের ভুল গুলো চিহ্নিত করার চেষ্টা করেছি। ও সেগুলো শুধরে নিয়েছি। নতুন নতুন ক্যামেরা সেটিঙে হাত পাকিয়েছি। জুন মাস থেকে লকডাউনের কড়াকড়ি একটি কমলে, কলকতার আসে পাশে গেছি, ছবি তুলতে। তবে সর্বদাই সুরক্ষার সব রকম প্রোটোকল মেনে আমি ছবি তুলতে গেছি।
১২ ) প্রশ্ন -ফোটোগ্রাফি সম্পর্কে আপনার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী ?
উত্তর- আফ্রিকান সাফারির ওপর কাজ করা।
১৩) প্রশ্ন -আপনার বেশি সময় নেবো না, ফটোগ্রাফি ছাড়াও কি আপনার কোন স্বপ্ন আছে?
উত্তর – আমার বাবার ইচ্ছাটাই আমার ইচ্ছে। ওনার খুব ইচ্ছে একটা ‘ওল্ড এজ হোম’ তৈরি করার। তার সাথে আমার ইচ্ছে আমার গ্রামের গরিব ছেলেদের শিক্ষিত করার। আমি অর্থনৈতিক ভাবে এতটাই স্বাবলম্বী হতে চাই যাতে আমার বন্ধু বা রিলেটিভদের বিপদের সময় ওদের পাশে দাঁড়াতে পারি। একজন ভালো মানুষ হবার খুব ইচ্ছে। যার জন্য আমার বাবা-মা আর যারা আমাকে ভালোবাসে তারা যেন গর্ব অনুভব করে। ফটোগ্রাফার হিসেবে পৃথিবীতে নাম করতে চাই। সব ফেমাস ম্যাগাজিনে যেন আমার ছবি পাবলিশ হয়, আমার কাজই আমার পরিচয়।
-যাবার আগে শেষ প্রশ্ন
১৪) প্রশ্ন -আপনার ছাত্র ও উঠতি ফটোগ্রাফারদের উদ্দেশ্যে আপনি কোন মেসেজ দেবেন কি?
উত্তর- আমার ছাত্রদের আমি একটাই কথা বলবো, জীবনের কোনো সংগ্রামেই যেন ভয় না পায়। হার আছে, তাই জিতবার আনন্দও আছে। ওদের যেকোন সমস্যায় আমি ওদের পাশে সবসময় আছি। সময়কে যেন সবাই মূল্য দেয়। টাকা খরচ করলে টাকা আবার কমিয়ে নেয়া যায় কিন্তু সময়ের অপচয় করলে সেই সময় আর ফিরে আসে না।
নতুন ফটোগ্রাফাররা অনুপ্রাণিত হোক, ফটোগ্রাফি সম্বন্ধে নতুন নতুন জ্ঞান লাভ করুক, প্রকৃতিকে বাঁচিয়ে পাখি বা ল্যান্ডস্কেপের ছবি তুলুক।
অনেক ধন্যবাদ রহমান স্যার। আপনার যে কাজগুলো আমি দেখেছি তাতে একটা কথা প্রমাণিত হয় যে আপনার মধ্যে এক শিল্পীসত্তা আছে, তাই আপনি চর্মচক্ষে না দেখে মনের চোখ দিয়ে বিষয়বস্তুর অন্তর্নিহিত সৌন্দর্য দেখতে পান। রবীন্দ্রনাথের কথায় “রূপসাগরে ডুব দিয়েছি অরূপ রতন আশা করি।
আপনিও রূপসাগরে ডুব দিয়েছেন এবং আমার বিশ্বাস আপনার অনবদ্য সৃষ্টির মাধ্যমে আপনি একদিন অরূপরতন খুঁজে পাবেন ও আপনার সব স্বপ্ন পূরণ হবে”।
_ খুব ভালো বলেছেন ম্যাডাম,ধন্যবাদ ।