ভারতের কৃষি, পরিবেশ ও সমাজ কর্মী অংশুমান দাশের সাথে একান্তে কথা বলেছেন কলমযোদ্ধা- অগ্নিমিতা দাস।

389
অংশুমান দাশের সাথে একান্তে কথা বলেছেন কলমযোদ্ধা- অগ্নিমিতা দাস।

অংশুমান দাশ একজন কৃষি, পরিবেশ ও সমাজ কর্মী
১)কৃষি নিয়ে আপনি ঠিক কী ধরণের কাজ করেন?
উঃ_ কৃষি নিয়ে আমার কাজ সম্পূর্ণ খাবারের যাত্রাপথ নিয়ে। প্রথম কাজ কৃষিকে প্রকৃতি নির্ভর করে তোলা। প্রথমেই দেখি প্রকৃতির নীতিগুলি মাথায় রেখে কী ভাবে চাষ করা যায়। উৎপাদনের পরে কীভাবে উৎপন্ন সামগ্রীগুলিকে বাজারজাত করা যায়। এই কাজে সবসময় খেয়াল রাখি যারা ক্ষুদ্র কৃষক এবং মধ্যবিত্ত ক্রেতা, তাদের। খাদ্য বিষয়টাকে সামগ্রিকভাবে দেখার চেষ্টা করা আর কী।
কয়েকটা মাত্র কোম্পানির ওপর নির্ভরশীল হ‌ওয়ার ফলে ভীষন ভাবে জাঙ্কফুড বা অস্বাস্থ্যকর খাবার খেতে অভ্যস্ত মানুষকে প্রকৃতি নির্ভর খাদ্য খেতে অভ্যস্ত করার জন্য চেষ্টা চালাচ্ছি। এই জায়গায় দাঁড়িয়ে মূলত প্রান্তিক কৃষকরা লাভবান হবেন, উপভোক্তারা তাদের পরিবেশ বান্ধব খাদ্যে ফিরে আসার জন্য স্বাস্থ্যগত ভাবে লাভবান হবেন। ছোট ব্যাবসায়ীরা নতুন উপভোক্তা পাবেন। এই সবকিছু নিয়ে প্রশিক্ষণ, সচেতনতা বাড়ানো, কথা বলা, লেখা – এই সবই করি।
২) বাজারে সাধারনভাবে যা পাওয়া যায় আর আপনি যে খাবারের কথা বলছেন তার পার্থক্য কী?

উঃ__ বাজারে স্বাভাবিকভাবে আমরা যে খাবার‌গুলো কিনে খাই, সেগুলোর উৎস সম্পর্কে আমাদের কোনও ধারণা নেই। এগুলোতে রাসায়নিক সার দিয়ে চাষ হয়েছে কিনা, সেগুলোতে কবে কত পরিমান কীটনাশক বিষ দেওয়া হয়েছে – তা নিয়ে যিনি বিক্রি করছেন এবং যিনি কিনছেন তার মাথাব্যথা আছে বলে মনে হয় না। এমনকি যেগুলো আমরা সব থেকে বড় দোকান থেকে কিনে সেই সব প্যাকেটজাত ফুড আসলে কত দূর থেকে এসেছে এবং খাবারের মান কী রকম সেই প্রশ্ন করা আমরা কোনদিনই শিখিনি। আসলে আমরা দেখেছি চকচকে জিনিস, সুন্দর জিনিস। আমি প্রথম যেটা কথা সকলকে অনুরোধ করি, যে প্রশ্ন করতে শেখা। আপনার স্বাস্থ্য কী রকম হবে, কী খাবার আপনি খাচ্ছেন, কীভাবে সেটা উৎপাদন হয়েছে – সেটা জানা খুব জরুরী । আমি সাধারণত যেটা মানুষকে মানুষদের বলার চেষ্টা করি যে অন্তত নিজের খাবারটা কোত্থেকে আসছে সেই প্রশ্নটা করতে শেখা। আপনার খাবার কত দূর থেকে আসছে তার উপরে নির্ভর করছে আপনার কার্বন ফুটপ্রিন্ট। শুধুমাত্র ‘প্রকৃতি ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে’, ‘ক্লাইমেট চেঞ্জ হচ্ছে’, ‘গ্লোবাল ওয়ার্মিং হচ্ছে’ – এগুলো বলে তো লাভ নেই। ভাবতে হবে যে আমরাই এগুলোর জন্য দায়ী এবং সেখানে খাবার একটা খুব বড় বিষয়।
৩) এই কৃষি নিয়ে বিরাট কর্মকান্ড করার ভাবনা কি শান্তিনিকেতনে পড়াশোনা করেছেন বলে?
উঃ শান্তিনিকেতন আমার জীবনে একটা মস্ত ছাপ ফেলেছে সে কথা ঠিক। মানে আমি এখন যা এবং আমি এখন যতটুকু, তার একটা প্রধান কৃতিত্ব শান্তিনিকেতন জায়গাটার এবং শান্তিনিকেতনে যত মানুষজনের সঙ্গে আমার মেলামেশার সুযোগ হয়েছে তার একটা প্রভাব আছে বৈকি। ছোটবেলায় কলেজে পড়ার সময় থেকেই আমার গ্রামে গ্রামে গিয়ে কাজ করার অভিজ্ঞতা ছিল। কিন্তু ঘটনাচক্রে পদার্থবিদ্যা পড়তে ঢুকে যাই, কৃষি পড়া হয়ে ওঠেনি। ছোটদের সঙ্গে কাজ করব, বিকল্প শিক্ষা দিয়ে কাজ করব, কাজ করব কৃষি নিয়ে – এই ভাবনাটা বোধহয় শান্তিনিকেতনের আশপাশে ঘুরে বেড়ানোর জন্যই হয়েছে।একটা জিনিস পড়াশোনা করে অন্য একটা জিনিস নিয়ে কাজ করা, একটা অন্য ডিসিপ্লিনে চলে যাওয়া সম্ভব হয়েছে, শান্তিনিকেতনে জীবন চর্চা ও পড়াশোনার মধ্যে ওই ফ্লুইডিটিটা ছিল বলে।

৪) সম্প্রতি জিন বদলানো খাবার আনার চেষ্টায় খাদ্য নিরাপত্তা ও সুরক্ষা দপ্তর (এফ এস এস এ আই) কি বলেছেন এই নিয়ে আপনি প্রতিবাদে সোচ্চার হয়েছিলেন, ব্যাপারটা আমাদের কাছে যদি একটু বিশদে ব্যাখা করেন?

উঃআমি চেষ্টা করছি যত সম্ভব সংক্ষেপে বলা যায়। দেখুন, আমাদের শরীরের যে আচার-আচরণ ব্যবহার সেগুলো নির্ভর করে জিনের উপরে। আমাদের শরীরে যদি জিনের গঠন বদলে দেওয়া যায় তাহলে আমাদের আচার-আচরণও বদলে যাবে এবং গায়ের রং, চুলের রং – সমস্ত কিছু বদলে যাবে। কৃষিতে যদি জিনগত পরিবর্তন করা হয় তাহলে ফসলের গুণও বদলে যাবে। সেটার বহুদিন ধরে চেষ্টা চলছে। সফল প্রচেষ্টা হয়েছে বেগুনের ক্ষেত্রে। আমরা বেগুনে ব্যাক্টেরিয়ার জিন ঢুকিয়ে দিয়েছি যাতে বেগুন নিজেই কিছু বিষ উৎপাদন করতে পারে যাতে আর পোকা না লাগে, পোকা ধরা কমবে। এইটা নিয়ে অনেক প্রশ্ন আছে, সেই প্রশ্নে আমি যাচ্ছি না। এই প্রযুক্তি নিয়েই অনেক বিতর্ক আছে। এই প্রযুক্তিগত পরিবর্তন করলে আমাদের শরীরের ক্ষতি হতে পারে সেটা নিয়েও নানা ভাবে আলোচনা হয়েছে। এই বিতর্কের কারণেই কিন্তু ভারতবর্ষে কোনও সরকার চাষে এই প্রযুক্তি চালু করতে পারেননি, চালু করা যাচ্ছে না। আমাদের যারা খাদ্য নিয়ন্ত্রণ করেন, তারা এখন চেষ্টা করছেন যে আমদানী করা খাবারে জিন বদলানো খাবার সংক্রান্ত নিয়মনীতি শিথিল করা যায় কিনা। মানে, চাষ করা যাচ্ছে না, তো খাবারে এই প্রযুক্তি নিয়ে আসি সরাসরি। মূলত এই ব্যাপারটার মধ্যা একটি অগণতান্ত্রিক ব্যাপার রয়েছে। সম্পূর্ণ ভাবে না জেনে, না জানিয়ে এই ব্যাপারটা চালু করা আসলে কর্পোরেটের প্রযুক্তি ও মুনাফার কাছে মাথা নত করা। আমরা চেষ্টা করছি প্রতিবাদ করা, প্রতিরোধ গড়ে তোলা এবং ঘটনাচক্রে কিন্তু সরকার এখনও সেটা আনতে পারেননি। কিন্তু আমাদের খাবারের পছন্দের উপরে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা ভবিষ্যাতে আরো জোরদার হবে। এ ব্যাপারে আমাদের সজাগ থাকতে হবে। প্রসঙ্গত, বাংলাদেসে কিন্তু জিন বদলানো বেগুন চাষ সরকারিভাবে স্বীকৃত।
৫) আপনি বা আপনার সংস্থা কিভাবে কৃষকদের বিষমুক্ত খাদ্যের উৎপাদন করা যায় এবং সেটা বাজারজাত করার কৌশলের উপর ট্রেনিং দেন? আপনি কোন কোন এলাকাকে ভিত্তি করে কৃষকদের সহযোগীতা করেন?

উঃ__আমি একটি আন্তর্জাতিক সংস্থায় কাজ করলেও আমি আসলে নানা উদ্যোগের সঙ্গে যুক্ত সেগুলো সরাসরি আমার চাকরির সঙ্গে যুক্ত না হলেও, বিকল্প কৃষি – বিকল্প খাদ্য – বিকল্প চিন্তা – বিকল্প উন্নয়ন, এগুলোর সঙ্গে জড়িয়ে আছে। আমার পেশাগত ক্ষেত্রে, আমরা চেষ্টা করি মূলত যারা ছোট কৃষকদের সঙ্গে কাজ করেন তাদের প্রশিক্ষণ দেওয়া, এবং তাদের কাছে কিছুটা আর্থিক অংশগ্রহণ যাতে তারা আরো ভালো ভাবে কাজ করতে পারেন। আমাদের কাজের ক্ষেত্রে রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ, পশ্চিমবঙ্গ, বিহার, ঝাড়খন্ড – প্রাকৃতিক ও সামাজিকভাবে যারা বিপদসংকুল হয়ে আছেন সেই সব জায়গায়। এই অঞ্চলের আদিবাসীরা আবং এই সব অঞ্চল ঐতিহাসিক ভাবেই বঞ্চিত। আমরা প্রায় পৃথিবীর ষাটটা দেশে কাজ করি – সেখানেও আমাদের মূল লক্ষ্য এটাই।

৬) বর্তমানে ভারতবর্ষে কৃষকদের অবস্থা কেমন?
উঃএটা খুব জটিল প্রশ্ন। কিন্তু এক কথায় বললে বলা যেতে পারে অবস্থা খুব একটা ভালো নয়। আমাদের দেশের ৮০% কৃষক ক্ষুদ্র কৃষক, মানে যাদের জমিতে ইনভেস্ট করার ক্ষমতা নেই অথচ সরকার মূলত বড় কৃষকদের কথা মাথা রেখেই সমস্ত কিছু স্কিম, সমস্ত কিছু ভর্তুকির কথা ভাবেন। এমন কি প্রকৃতি বান্ধব কৃষির কথা ভাবলেও, সরকার নাম কে ওয়াস্তে কিছু প্রকল্প সামনে সাজিয়ে রেখেছেন কিন্তু আসলে কোম্পানিমুখি কৃষিই চলছে। কৃষির অবস্থা ভাল না এবং ভবিষ্যতে আরো খারাপের দিকে যাচ্ছে বলেই মনে হয়।

৭) আপনি একাধারে প্রকৃতি সংরক্ষক, প্রকৃতিপ্রেমিক, কৃষিবিদ এবং লেখক ও কবি। এত কিছু হ‌ওয়া কি সম্ভব না প্রত্যেকটার সাথে প্রত্যেকের একটা বন্ধন আছে বলে সেটা সম্ভব?

উঃ( মৃদু হেসে) আরে, এটাতো কঠিন প্রশ্ন! আমি পড়াশোনা করার পর সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার হিসাবে চাকরিজীবন শুরু করি। বেশিদিন করতে পারিনি, কারণ আমার একদম ভালো লাগেনি। তারপর ছেড়েছুড়ে আমি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থায় কাজ করতে আসি। সেখানে চাকরি করতে গিয়ে আমার প্রধান শর্ত ছিল যে আমার লেখালেখি করবার আর নাটক করার সময় চাই। কিন্তু তারপর আসতে আসতে বেড়াগুলো ভেঙ্গে গেছে। গ্রামে গ্রামে মানুষের সঙ্গে থাকার অভিজ্ঞতা, প্রকৃতির কাছাকাছি থাকার অভিজ্ঞতা আমার লেখাতে, বিশেষত আমার কবিতায় অনেকটা বড় ভূমিকা নিয়েছে সেকথা অনেকেই বলেন। বন্ধন তো আছেই এবং বন্ধন না থাকলে খুব মুশকিল কারণ সত্যি বলতে কি, কাজ আর ভালো লাগার জায়গা যদি আলাদা হয় তাহলে সেটা ম্যানেজ করা খুব কঠিন হয়। আমার তো কোথাও এখন কোনও অসুবিধা হয় না।

৮) নিজের লেখা প্রিয় কবিতার ব‌ইয়ের নাম?
উঃ_ আমার কবিতার বইয়ের সংখ্যা এখন চারটে আর দুটো ছড়ার বই। একদম নতুন বই যেটা সেটা রুমি এবং কবির – এই দুজন পদকর্তার কবিতার অনুসরণে লেখা সেটাও আমার খুব প্রিয় বই। সবগুলো বইই আমার কাছে প্রিয়, তাই আলাদা করে কোনটা প্রিয় বলা খুব মুশকিল।
৯) নিজের লেখা প্রিয় কৃষিভিত্তিক প্রবন্ধের নাম?
উঃ_ উত্তর দেওয়া একটু মুস্কিল! আমি কৃষি নিয়ে কোনদিন প্রবন্ধ লিখতে পারব, সেই জায়গায় যাব কোনদিন ভাবিনি। আমার নতুন বই “চাষবাস প্রতিবেশ” – অনেকের পছন্দ হয়েছে, অনেকে কিনেছেন, আলোচনা করছেন, কথা বলছেন, তর্ক করছেন। আমি যেটা লিখেছি সেটা ঠিক কি বেঠিক সেটা বড় কথা নয়, এই যে একটা কথা বলার পরিসর তৈরি হয়েছে – এটা করতে চেয়েছিলাম, এটা করে বেশ ভালো লাগছে।
১০) শুনেছি ছাত্রজীবনে অসম্ভব সুন্দর নাটক করতেন? এই নাটক করার প্রেরনা কার কাছ থেকে পান?
উঃএইটা আমার একটা দূর্বলতা! ছোটবেলা থেকেই আমি যে পরিবেশে বড় হয়েছি সেখানে নাটকের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ জায়গা ছিল। নাটক আমার কাছে খোলা আকাশের মতো, যেখানে নিজেকে মেলে ধরা যায়। শিক্ষাসত্রে, মানে আমার স্কুল ঠেকেই এর শুরু। বহু নাটক করেছি। আমার ঘরেও নাটকের পরিবেশ ছিলো। আমার মামা নাটক করতেন, ছোটবেলা থেকেই ঘরে নাটকের মহড়া দেখতে পেতাম। ১৯৯৩ সালে বিখ্যাত নাট্যকার বাদল সরকার শান্তিনিকেতনে ভিজিটিং প্রফেসর হিসেবে আসেন। আমি ওঁর কাছে ওয়ার্কশপ করেছি, পরে কোলকাতায় আসি বাদল দা’র দলে নাটক করতেই। এখন ও নাটক আমাকে ছাড়েনি বা আমি কোনদিনই নাটককে ছাড়িনি। আমি তো কৃষি প্রশিক্ষক, প্রশিক্ষণেও আমি নাটকের কিছু কিছু খেলা করাই। আমি মনে করি যে আমার কথা বলায়, আমার চরিত্রে, প্রশিক্ষক হিসেবে আমার উপস্থাপনায় নাটকের একটা বিশাল প্রভাব আছে। আমি যদি নাটক ভালো না বাসতাম, তাহলে হয়ত আজকে যে আমি আছি সেটা অন্যরকম হত বলে আমার মনে হয়।

১১) গিরিশচন্দ্র না কাফকা? –

উঃদুটোই কম পড়েছি। কাউকেই একে ওপরের থেকে কম মনে হয়নি।
১২) প্রথম ক্রাশ?

উঃ ক্লাস ফোরের সহপাঠিনী, নাম বলব না। ছোটবেলার শিক্ষিকা, তাকে খুব পছন্দ করি – তারও নাম বলব না (হাসি)।
১৩) ইলিশ না গলদা?
উঃইলিশ। চিংড়িতে আমার এলার্জি। ১৩) রবীন্দ্রনাথ না শেক্সপিয়ার? উঃ_ কেউ কম না। প্রত্যেকে প্রত্যেকের জায়গায় সেরা। ১৪)) জীবনের সেরা উপহার? – এখনও পাইনি বোধহয়। তারই মধ্যে- একবার আমার শিক্ষিকা আমার লেখা এক বইয়ে আমার সই নিয়েছিলেন। সেই চাওয়াটা ভীষন মনে পড়ে। ১৫) কাজ করতে গিয়ে কাকে বেশি ভালো লাগে_ প্রতিযোগী না প্রতিদ্বন্দ্বী? উঃপ্রতিযোগী।
১৪) জীবনের আদর্শ মানুষ?
উঃ_ সময়ের সাথে বদলে যায়। কখনও মনে হয় গোপাল দা। যে ছোটবেলায় আমাদের সব সময় ধারে আইস্ক্রীম খাওয়াত। খাইয়েই আনন্দ ছিল। পয়সাও চাইত না, কত ধার যে রয়ে গেল। কখনও মনে হয় সুন্দরলাল বহুগুণা, আরও অনেকের কথাই মনে হয় সময় সময়।
১৫) আপনার “উড়ান” নামক সংস্থার সম্বন্ধে কিছু জানান? কারা যোগাযোগ করতে পারে এবং কিভাবে?
উঃ “উড়ানটা “আমার সংস্থা না বলে আমাদের সংস্থায় বলাই ভালো এবং আমার থেকেও ওটায় আমার রুমমেট কাম স্ত্রীই পরিচালনা করেন। এটা ঠিক সংস্থা নয়। আমরা রেজিস্টার্ড নই, আমরা একটা কমিউনিটি যেখানে মা-বাবা বাচ্চা সবাই একসঙ্গে আছেন। এই পরিবারের সাথে পঞ্চাশ-পঞ্চান্নজন যুক্ত আছেন।
এটা শুরু হয়েছিল আমার ছেলে যখন ছোট ছিল, সেই সময়। ছেলে কলকাতায়, বন্ধুবিহীন ভাবে একা একা কংক্রিটের জঙ্গলে বড় হচ্ছিল। আমরা যেভাবে শান্তিনিকেতনে বড় হয়েছি, ছেলেকে সেই পরিবেশ দেবো বলেই শুরু করেছিলাম “উড়ান”, যেখানে ছেলে তার সমবয়সীদের সাথে একসাথে খেলতে পারে।
আমরা বড়রা ও ছোটরা এখানে একে অপরের কাছ থেকে অনেক কিছু শিখি। এখানে উৎসব পালন করা হয়। বিভিন্ন কর্মশালা হয়। আমরা প্রতি বছর অন্তত একবার বাইরে গিয়ে কোথাও ক্যাম্প করি। একটু বড় বাচ্চাদের সঙ্গে। সেইটা তাদের একটা ভীষণ মজার জায়গা হয়ে যায়। অনেকেই জীবনে প্রথম তার বাবা-মাকে ছেড়ে থাকে বাইরে গ্রামে গিয়ে । “উড়ান” মূলত আমাদের একটা ছুটির জায়গা। নানা ব্যস্ততার মধ্যে থেকে আমরা ও আনন্দ পাই, বাচ্চারা আনন্দ পায়। ছেলে এখন বড় হয়ে গেছে, ও আর “উড়ানে” আসতে চায় না, কারণ এখানে সবাই ছোট ছোট। কিন্তু “উড়ান” রয়ে গেল। যে কোনও বয়সের বাচ্চারা এবং তাদের বাবা মা আমাদের সঙ্গী হতে পারেন।
১৬) আপনার জীবনসঙ্গীনী মালিনীর চোখে আপনার এইসব কর্মকান্ডের গুরত্ব কতটা?
উঃ_এইটা বোধহয় মালিনী কে জিজ্ঞেস করতে হবে। তবে আমরা পরস্পর থেকে অনেক কিছু শিখেছি। মালিনী বিকল্প শিক্ষা নিয়ে কাজ করে। সেখানে আমি যেরকম শিখেছি, মালিনী আমার কাছ থেকে বিকল্প জীবনযাপন, বিকল্প চাষ, পরিবেশ চিন্তা শিখছে। আমরা পরস্পর পরস্পরকে নানাভাবে সমৃদ্ধ করতে পারি। এই প্রশ্নটা বোধহয় মালিনীর জন্য তোলা থাকলে ভাল হতো।
পুরোটাই আমার চাওয়ার প্রথম সারিতে ছিল। আমি সেজন্যেই কোনওদিন কলকাতা ছেড়ে অন্য কোথাও চাকরি করতে যাব ভাবিনি। সেটা করতে গিয়ে যদি ছোট থেকে বড় হয়ে যাওয়াটা মিস হয়ে যায়, সেটা আমরা সবসময় ভয় ছিল। এই সমস্ত কর্মকান্ডের অনেক ওপরে আমার ছেলের জন্য সময় ও তার গুরুত্ব।
১৭) অজস্র ধন্যবাদ আর শুভেচ্ছা আপনার মূল্যবান সময় বাংলাদেশের “দৈনিক আলাপ” পত্রিকায় দেওয়ার জন্য। আপনি তো বাংলাদেশে কাজ করেছেন, ওখানকার কৃষিব্যাবস্থা সম্বন্ধে আপনার মতামত?

উঃ_বাংলাদেশ যাচ্ছি আমি প্রায় বছর দশ বছর হলো। নানা জায়গায় কাজ করার অভিজ্ঞতা হয়েছে। খাগড়াছড়িতে পার্বত্য অঞ্চল, হাওর অঞ্চল, সুন্দরবন – বাংলাদেশের কৃষকদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করেছি। বাংলাদেশের কৃষি এখন একটা সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে বলে আমার মনে হয়েছে এবং খুবই দুঃখজনক ভাবে যে ভুলগুলো ভারতবর্ষ করেছে সেই ভুলগুলোকেই অনুসরণ করতে দেখি। যেমন, প্রকৃতি থেকে দূরে সরে গিয়ে কোম্পানির কর্তৃত্বকে কৃষি এবং খাদ্যব্যবস্থায় প্রাধান্য দেওয়া। বাংলাদেশের কৃষি সম্পদ বেশ উচ্চমানের ছিল – সে জ্ঞান‌ই হোক বা বীজ হোক বা চাষ করার পদ্ধতিই হোক – কোন অংশে কম ছিল না। কিন্তু সেগুলো ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে‌ এবং কোম্পানির উচ্চ ফলনশীল চাষ, রাসায়নিক সারের চাষের দাপট বাড়ছে। সেইসঙ্গে সেরকমই ফাস্টফুড এবং ভোগবাদী সভ্যতা ধীরে ধীরে গ্রাস করছে বাংলাদেশেকে। তবে গত পাঁচ বছরে প্রচুর মানুষজনকে দেখছি যাঁরা এইটা বুঝতে পারছেন, শুধরানোর জন্য এটার বিরুদ্ধে দেওয়াল হয়ে দাঁড়াচ্ছেন।আমি সৌভাগ্যবান! তাদের অনেকের সঙ্গে আমার যোগাযোগ আছে এবং তাঁদের সঙ্গে নান ভাবে মত বিনিময়ের সুযোগ হয়েছে। তাঁদেরকে দেখে শেখার সুযোগ হয়েছে এইটা আমার কাছে বড় বিষয়। এইধরনের মানুষের সংখ্যা যত বাড়বে, আরো মানুষ যত যুক্ত হবেন ততই বাংলাদেশের মঙ্গল।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here