ভারত থেকে আধুনিক বাংলা সাহিত্যের জনপ্রিয় লেখিকা অগ্নিমিতা দাসের জীবন ধর্মী গল্প“নীলা আসমানে সোনালী চাঁদ”

423
অগ্নিমিতা দাস এর জীবন ধর্মী গল্প“নীলা আসমানে সোনালী চাঁদ”

নীলা আসমানে সোনালী চাঁদ ________________
অগ্নিমিতা দাস

নিঝুম রাত! গালিচা পাতা মেঝেতে এক নারী গালে হাত দিয়ে চুপ করে বসে আছে।পাশে নীলাভ স্ফটিক পাত্রে কতগুলো আপেল, নাসপাতি আর আঙুরের গুচ্ছ সযত্নে রাখা আছে। ঘরের ভেতর থেকে অপূর্ব ধূপের গন্ধ মনকে মাদকাসক্ত করে তুলছে। লাস্যময়ী আসমানী রঙের পায়জামাপরিহিতা নারীটি মেঝেতে চুপ করে বসে থাকা মেয়েটির থুতনি নাড়িয়ে বলে উঠলো_ আমি চললাম! তুই এখন আমি সেজে থাক! মেয়েটি ভয়ের ভঙ্গিতে বলল মহতরমা! গুস্তাকি মাফ করনা! কিন্তু এইভাবে কতদিন চুরিচুপে চলবে।
কেও দেখে ফেললে কি হবে!
আসমানী পায়জামা তার গ্রীবা বাঁকিয়ে হেসে উঠলো
এই রাতে তুই দিল্লীর রাজিয়া সুলতান! এই মউকা কে পায় বল। তুই এই সুযোগ পেয়ে ভয়ে মরছিস! মেঝেয় বসে থাকা দাসী এবার আস্তে আস্তে উঠে বললো_ মুঝে ঝুটমুট কা দিলাসা দে কে ক্যায়া ফায়দা! আমার মা এখানের খাসমহলের দাসী ছিল আমি এখন আপনার। কিন্তু ভয় হয় আপনাকে নিয়ে। চারিদিকে ষড়যন্ত্র চলছে। সময় ভালো না! সুলতানা দ্রুত হাতে বোরখা পরে নিল। গোপন অভিসারের জন্য তার এই বেশ, না হলে তিনি পর্দানসীন নন। দরবারে তিনি মুখ খুলেই আসেন। এই নিয়ে আমীর ওমরাহদের অনেক কটাক্ষ তাকে শুনতে হয়েছে। কটিতে বাঁধলেন বাঁকা ছুরি তারপর ঘর থেকে বেরিয়ে মার্বেলের ফোয়ারার পাশে রাখা ঘোড়ার পিঠে লাফিয়ে চড়ে বেরিয়ে গেলেন। সামালকার যা না!
লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ!
দাসী দুহাত বুকের মাঝে ভাঁজ করে আল্লাতালার কাছে তার মালকিনের জন্য দোয়া পড়তে লাগলো।একটু পরে অন্ধকারে আর একজন ঘোড়সওয়ার তাকে অনুসরণ করলো।
ঘোড়াটাকে মিনারের কাছে রেখে পা টিপে টিপে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে লাগলো।
” চাঁদ কা মিজাজ ভী তেরে য্যায়সা হে
ফরজ জব দেখনে কি তামান্না হোতী হে

নজর নেহী আতা”
গমগমে গলায় পুরুষ কন্ঠে শায়রি শোনা গেল।


অন্ধকারে একটা ছায়ামূর্তি সুলতানা কে দেখে এগিয়ে এলো।
বলিষ্ঠ চেহারার যুবকটি উদ্বিগ্ন স্বরে বলে উঠলো_ তোমায় কেও দেখে নি তো! রাজিয়া বোরখা খুলে দিয়ে ধীরে স্বরে বলল দেখলে দেখুক! মুঝে কিসিসে ডর নেহী। ম্যায়নে কুছ গলত তো নেহী কিয়া। সিরিফ তুমসে মোহাব্বত করনে কা গুসতাকি কিয়া ! বলেই মুখটা যুবকের কাছে নিয়ে এল। যুবক বলে উঠলো
দিল্লি কা হলত ঠিক নেহি হ্যা! হরতরফ রঞ্জিস কি রঞ্জিস ! আমার রাজনৈতিক সব ব্যাপারে মতামত দেওয়াটা বোধহয় আমীররা পছন্দ করছে না। তাছাড়া একজন অউরত কে সুলতান হিসাবে মানতে সবাই নারাজ।সবাই বলছে তুমি ইসলাম মানো না। তুমি বেপর্দা। লা হোল মিলাকুল! আমাকে আমার আব্বাজান ইলতুৎমিস আমাকে যোগ্য বলে মনে করছেন তাই পুত্রসন্তান থাকা সত্ত্বেও আমাকে দিল্লীর সলতনতে বসিয়েছেন। আব্বার যোগ্য উত্তরসূরি হিসেবে আমি কাজ করেছি। তুমি বলো ইয়াকুদ আমি রাজকার্যের জন্য অনুপযুক্ত। হ্যাঁ আমি পর্দা মানি না। আমি দিল্লীর সুলতানা নয়ই সুলতান। একজন সুলতানের মতোই প্রজাদের সুখ সুবিধা দেওয়ার চেষ্টা করি, আমি তো খোলা দরবার পর্যন্ত রেখেছি যাতে সবাই আমার কাছে তাদের তকলিফ নিয়ে আসে। আমার কাছে সব ধর্মের বান্দাই এক। আমি আল্লাহ কে নারাজ করার মতো কোন কাজই করিনি। আল্লাহ কোনদিন চাইবে না মেয়েরা পুরুষের পায়ের নীচে থাকুক। এই সবই মানুষের বানানো কায়দা কানুন। জামালাউদ্দিন ইয়াকুদ তাকে কাছে টেনে বললো সুলতানা তুমি এতটাই ভালো কাজ করছো বলেই সবাই হিংসা করছে। তোমার বাবার আমল থেকে চল্লিশ জন ওমরাহর তদারকি চলে আসছে। তারা সবাই তোমার বিরুদ্ধে। তোমার ভাই বেহরাম তোমার ছেলেবেলার প্রেমিক ইকতারউদ্দিন আলতুনিয়া আর লাহোরের কবীর খান এদের মধ্যে সবার আগে।
সোনালী জরির দোপাট্টা আঙুলে পাকাতে পাকাতে

বলল আমার ছেলেবেলার আশীক ও নয়। আমি
কোনদিন সেই চোখে দেখিনি। যদি ও আমায় ভালোবাসে তো আমার কসুর কোথায়!
মাসাআল্লাহ! যার সৌন্দর্যের খুসবু সারা সলতন কে মাতিয়ে রাখে, তার মহব্বতে তো সবাই পড়বে মহতারমা! হঠাৎ রিণেরিণে গলায় রাজিয়া হেসে উঠলো। মনে হলো ঝর্ণার মতো শব্দতরঙ্গ ছড়িয়ে পড়লো চারিদিকে। আমি শুধু তোমার ঈশকে দিওয়ানা!
যখন দরবারে থাকি তখন সবাই ভাবে রাজিয়া সুলতানা কি গম্ভীর। কি প্রতাপ! কিন্তু দিলের কাছে আমি বাঁধা। এখানে একটাই নাম” ইয়াকুদ” ” ইয়াকুদ”
আমি শুনতে চাই জিন্দেগি ভর! বলেই ইয়াকুদ রাজিয়ার বুকে মাথা রাখলো। ” বেশরম! এই গুস্তাকির জন্য তোমার কি হবে জানো! বলেই রাজিয়া ওকে আরো জোরে চেপে ধরলো। _ বান্দা সাজেএ মৎ ভি কবুল করতে রাজি!
আকাশে আজ মেঘ আর চাঁদের লুকোচুরি খেলা চলছে। কালো ফিনফিনে শিফনের ওড়না দিয়ে মেঘ কখনো চাঁদের মাখনের মতো হলুদ হয়ে যাওয়া ত্বককে ঢেকে দিচ্ছে। কখনো ওড়না সরিয়ে দিয়ে চাঁদের চুঁইয়ে চুঁইয়ে পড়া লাবন্যময় জোৎস্নায় ভরিয়ে দিচ্ছে।
হঠাৎ ইয়াকুদ রাজিয়ার মুখ চেপে ধরলো।
কার পায়ের শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। সিঁড়ি দিয়ে ক্রমশ শব্দটা উঠে আসছে। চারিদিক চুপচাপ। মেঘ সময় বুঝে চাঁদের যৌবনকে আবার ওড়না দিয়ে ঢেকে দিল। ঘোর অন্ধকার। কেবল দুজনের নিঃশ্বাসের শব্দ শোনা গেল।আওয়াজটা যেমন এসেছিল তেমনি আস্তে আস্তে নীচে মিলিয়ে গেল।


ইশক ম্যা লোগ পাগল হো যাতে হে তো ইয়ে কামিনা আলতুনিয়া কা ক্যায়া কসুর।
পর উয়ো তো শের নেহী লমড়ি কি তরাহ পিছে সে খঞ্জর দেনে কে লিয়ে তৈয়ার হে! ওর কোন চেলা আমাদের দেখতে এসেছিল।
হাত মুঠো করে রাজিয়া বলে উঠলো _ তুমি যদি আমার পাশে থাকো এদের সবাইকে আমি দেখে নেব। চোখ জ্বলজ্বল করে উঠলো দিল্লীর সুলতানার চোখ। ইয়াকুদ তার চওড়া বুকে রাজিয়াকে টেনে বললো
লেকিন এই ইন্তকামে যদি দুজনের মধ্যে কার ও আগে মৎ হয় তখন কি হবে!
রাজিয়া বললো_ ইন্তেজার করেগেঙ্গে! হর পল! হর লমহা! তুমি তো দিল্লীর সুলতানা তোমার কবরের পাশে তো আমি থাকবো না।তোমার সেনাবাহিনীর যত বড় পদেই থাকি না কেন তোমার পাশে আমার জায়গা না মুমকিন!
রাজিয়া দৃঢ় গলায় বললো
কবরের মধ্যে তো জিসিম কে দফন করা হয়, মগর রুহ তো আজাদ হে ! রুহ কি কবরে বন্দী থাকে। রুহ আজাদ পন্ছির মতো তার সাচ্চা আশিকের কাছে ঠিক চলে আসে।
আমরা না থাকি, আমাদের রুহ এখানে ঠিক মোহাব্বত করতে আসবে।
_ তুমহারে লিয়ে তো মৎ কো ভি হাসতে হাসতে গালে লগায়েঙ্গে! বলেই রাজিয়ার ওষ্ঠে দীর্ঘ চুম্বন করলো। রাজিয়া ও পরম আবেশে সেই চুম্বনের আস্বাদ নিল। ” আল্লাহ হো আকবর আল্লাহ” পাশের মসজিদ থেকে ফজরের নামাজের আজান শোনা যাচ্ছে। রাজিয়া ইয়াকুদের বাহুলগ্না হয়ে গভীর ঘুমে মগ্ন। ইয়াকুদ সারা রাত জেগে ছিল। রাজিয়া কে উঠিয়ে দিল, কেও দেখার আগেই সুলতানা কে মহলে ফিরতে হবে। ঘরময় পায়চারী করছে আলতুনিয়া। এক্ষুনি তার চর খবর দিল তার মেহেবুবা ইয়াকুদের সাথে রাতের অন্ধকারে মস্তি করছে। ছিঃ ছিঃ! আল্লাহ এই মেয়েটার বাড় আর সহ্য করা যাচ্ছে না। এর হেস্তনেস্ত করতেই হবে। লাহোরের শাসক কবীর খান রাজিয়ার ভাই বেহরমকে নিয়ে দল পাকাতে লাগলো। এরপরের ইতিহাস সবার জানা। যুদ্ধে ইয়াকুব খুন হয়, রাজিয়া কে লাহোরের কারাগারে বন্দী করা হয়। দিল্লীর গদিতে বসে বেহরম। রাজনৈতিক চুক্তিতে রাজিয়া বিয়ে করতে বাধ্য হয় আলতুনিয়াকে। দিল্লীর সালতানদ পাওয়ার জন্য আলতুনিয়ার সাহায্যের দরকার ছিল। কিন্তু ভাগ্যের পরিহাসে বেহরামের চক্রান্তে রাজিয়া আর আলতুনিয়ার মৃত্যু হয়। গদীর লোভে অনববরত চলে এসেছে হত্যা, কুচক্রান্ত আর স্বার্থের লড়াই। একজন স্বাধীন সুশাসক নারী হওয়ার অপরাধে গদিচ্যুত হলেন। দিল্লীর মসনদে একজন নারী যোগ্য হওয়া সত্বেও পুরুষতান্ত্রিক সমাজ তাকে মসনদে বসতে দিল না। রাত এক থাকে, চাঁদ ও এক, আকাশ ও! মাঝে হয়েছে কিছুদিনের ছাড়াছাড়ি! চলে আকাশে মেঘ আর চাঁদের লুকোচুরি। এখনো কুতুব মিনারে শোনা যায় দিল্লীর সুলতানার রিণেরিণে গলায় হাসি। ওড়নার খসখসে শব্দ। মিষ্টি মিষ্টি আতরের গন্ধে ভরে যায় চারিদিক। ইয়াকুদের ভরাট গলায় শায়রি! _ হম লোগো কো অভি কোই আলাগ নেহী কর সকতা! রুহ তো হমেসা আজাদ হে।
আ গলে লগ যা ! অব তো একপল কা জুদাই ভি বরদাস্ত নেহী হোতা!
নীল আসমানে চাঁদ মেঘের নৌকায় পাড়ি দেয় আর প্রেমের সাগরে গা ভাসিয়ে দেয় দুই দিওয়ানা!
ভোরের আজানের আগে অব্দি চলে প্রেমলীলা।
এই রাজকীয় শহরের পুরনো স্থাপত্যের সাথে জুড়ে থাকে অনেক রহস্য, জমে থাকে পরিণতি না পাওয়া প্রেমের ইতিহাস।
আত্মা অবিনশ্বর! আত্মার মৃত্যু হয় না!
” আজো নিত্য শাশ্বতোং পুরাণো না হন্যতে হন্যমানে শরীরে”

” ঈশক অধুরা রহে যায়ে তো
খুদ পর নাজ করনা
কহেতা হে সচ্চী মোহাব্বত
মুকাবল নেহী হোতা!!”


# মিতার কলমে অগ্নি
ছবি _ নার্গিস রেহানা

2 COMMENTS

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here