“স্পৃহা”গল্প টি লিখেছেন সাহিত্যের অন্যতম সারথি নাসরিন জাহান মাধুরী

605
“স্পৃহা”গল্প টি লিখেছেন সাহিত্যের অন্যতম সারথি নাসরিন জাহান মাধুরী

“স্পৃহা”  

নাসরিন জাহান মাধুরী

স্পৃহা একটা প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ায়, শিক্ষক হিসেবে বেশ নামডাক ওর।খুব সদালাপী বলে বন্ধুভাগ্য বেশ। ওর কর্মস্থলে ও সবার প্রিয়। স্কুল,কলেজ আর বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধুদের সাথেও বেশ যোগাযোগ।
পরিবারের প্রতি ওর অসম্ভব টান।শ্বশুরবাড়ি আর বাবার বাড়ি কোনটাকেই আলাদা দেখেনি সে।সবার সুখ দুঃখ আনন্দ বেদনায় পাশে থাকে সবসময়।সবাই যেনো সব কিছুতেই ওর ওপর নির্ভরশীল তা সে হোক বাবার বাড়ি বা শ্বশুরবাড়ি।
প্রতিদিন ক্লান্তিহীন সামাল দেয় ঘরে বাইরে। ভার্সিটি যাওয়ার আগে টেবিলে বরের জন্য হটবক্সে খাবার রেখে, ও ওর পোশাক বের করে সব গুছিয়ে হন্তদন্ত ছোটে কর্মক্ষেত্রে।ওর বর আড়ো পরে বের হয় বলে।তখনো ঘুমে থাকে।
স্পৃহার বর একটা বিদেশী ফার্মের কনসালটেন্ট। বেশ মানায় দুজনকে ভালোবেসে বিয়ে করেছিলো ওরা।এখন স্পৃহা ভাবে সেই সুন্দর দিন গুলো যেনো হারিয়ে গেছে।কিছুই ভালো লাগে না।।এই ব্যস্ততার কোন মানে খুঁজে পায়না।ভালোবাসা যেনো দূরাকাশের তারা।আছে যা তা শুধু দায়বদ্ধতা।
স্পৃহা ভাবে নিজের ছেলেবেলার কথা।কত সুন্দর ছিলো তার শৈশব।যদিও প্রায়ই ঠাণ্ডায় ভুগতো,তবুও প্রবল ইচ্ছা শক্তি আর জেদ নিয়ে সে লড়াই করেছে সব প্রতিকূলতায়।পড়ালেখায় তুখোড়, যে কোন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান,বিতর্ক প্রতিযোগিতা, উপস্থিত বক্তৃতা সব কিছুতে সবার আগে থাকতো সে।মা বাবা কত খুশি থাকতো তার এই অদম্য স্পৃহা দেখে। তার নামটা যেনো তার সাথে মিলিয়েই রাখা হয়েছিলো।
বন্ধুদের মধ্যমণি স্পৃহা। সবার সাথে কি ভালো সম্পর্ক।তবুওনো সবার থেকে যেনো আলাদা।অন্য বন্ধুরা যখন কৈশরেই উড়োউড়ো মন নিয়ে উড়োচিঠি আদান প্রদানে ব্যস্ত, স্পৃহা ব্যস্ত থাকতো ওর পড়াশোনা নিয়ে।গল্পের বইয়েরও ছিলো দারুণ ভক্ত।আর এখন! বই পড়ার সময় কই তার।
এখন ক্লাস শেষে ঘরে ফেরারও তাড়া থাকে না।নিজের ঘরটাকেই মনে হয় কোন অভিশপ্ত কারাগার।ঐ।কারাগারের প্রতিটা জিনিস স্পৃহা নিজের উপার্জনে একটা একটা করে কিনেছে,সাজিয়েছে আপন ভূবন।সেটাই যেনো এখন নরকসম।মন খারাপ করেই প্রতিদিন ঘরে ফেরে স্পৃহা।ক্লান্তিতে ওর শরীর ভেঙে আসে।
বাসায় ও একা। ওর বর এখনো ফেরেনি।এত ক্লান্তি সত্ত্বেও ঘুম আসেনা। চোখ দিয়ে কষ্টের নোনাজল ঝরে।
শুয়েশুয়ে স্পৃহা ভাবে অতীত নিয়ে।লেখাপড়া শেষ করেই জয়েন করে ভার্সিটিতে শিক্ষক হিসেবে।বাবা ছিলোনা, তাই ভেবেছিলো ওর উপার্জনে যদি ভাইদের একটু সহায়তা হয়! যদি ওর মাকে একটু সুখি করতে পারে! এই ভাবনায় বিয়েটাকে গুরুত্ব দেয়নি স্পৃহা।এর মাঝেই হঠাৎই একদিন ওর বর আরেফিনের সাথে পরিচয়।পরিচয় থেকে ভালোলাগা, তারপর ওরা বিয়ের ডিসিশন নেয়।
   ( ২)

বিয়ের পর বেশ হাসিখুশি কাটছিলো দিন।দুজনেই ব্যস্ত।ব্যস্ততার ফাঁকে ফাঁকে দুজনে ঘুরেফিরে। আত্মীয়স্বজনেরা পরামর্শ দেয়,”বাচ্চা নিচ্ছোনা যে! দেরী করছো কেনো? পরে সমস্যা দেখা দেবে।” স্পৃহা শুনে যেতো কথাগুলো চুপচাপ,সিরিয়াসলি নিতোনা।দিন যত যায় স্পৃহা বুঝতে পারে কোথাও সমস্যা হচ্ছে। ও কনসিভ করতে পারছেনা।
যতই সময় যায় স্পৃহা খুব অসহায় বোধ করতে থাকে,খুব কান্না পায় ওর।ওর বরও ব্যাপারটা স্বাভাবিক ভাবে নিতে পারছে না। ওর ভাবটা এমন, যেনো স্পৃহারই সব দোষ। বাচ্চা হয়না এর সমস্ত দায়ভার স্পৃহার একার।দিনদিন আরেফিনে চেহারাটা বদলে যেতে থাকলো।স্পৃহার প্রতি ওর আচরণ রূঢ় থেকে রূঢ় হতে থাকে।
সময়ের সাথে সাথে আরেফিনের আরো ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। কথা শোনায় স্পৃহাকে। যেন বাচ্চা না হওয়ার সব দায়ভার স্পৃহার। স্পৃহা ডাক্তারের সাথে পরামর্শের কথা বললে আরেফিন আরো দুর্ব্যবহার শুরু করে দেয়। যাচ্ছে তাই ভাষায় কথা শোনায়। স্পৃহা মুখ বুজে সয়ে যায়। সে চাইলে পারে আরেফিনকে কিছু উচিত জবাব দিতে, কিন্তু স্পৃহা অশান্তি চায় না, তাই চুপ করে থাকে। তার চোখ বেয়ে ঝরে বিষাদের। অশ্রু।
সে নিজেই ইনফার্টিলিটি ডাক্তারের সাথে যোগাযোগ করে, ডাক্তার বলেন এসব ক্ষেত্রে স্বামীস্ত্রী দুজনের একসাথে আসাটা জরুরী। দুজনকেই পরীক্ষা নিরীক্ষা করতে হবে। স্পৃহা অনেক অনুনয় করে, অনেক অপমান সহ্য করে আরেফিনকে রাজি করায় ডাক্তারের কাছে যেতে।
ডাক্তার দুজনকেই না না পরীক্ষা করে কিছুই পেলেন না। শুধু স্পৃহাকে কিছু ঔষধ প্রেসক্রাইব করলেন। ফার্টিলিটি হরমোনের। যা হয়তো দীর্ঘদিন ব্যবহারে স্পৃহার কোন জটিল অসুখ দেখা দিতে পারে।যদিও সন্তানের জন্য এত আক্ষেপ স্পৃহার নেই,সে মেনে নিয়েছে এই না পাওয়াটা। তবুও শুধু আরেফিনকে খুশি করার তাগিদে ওষুধগুলো সে নিয়মিত সেবন করতো,যদি কোন সন্তান আসে তার,আর আল্লাহর ওপর ভরসা করতো।
   (৩)

সময় যায় তিক্ততা বাড়ে আরেফিনের। স্পৃহার সাথে তার আচরণ এমন হয়ে আসে যেন বাচ্চা না হওয়ার সমস্ত দায়ভার স্পৃহার। স্পৃহার সাথে দুর্ব্যবহার বেড়েই চলে। স্পৃহা ভাবে একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে, সে আপন মনে ওর দায়িত্ব পালন করে। খুব মায়াবতী বলে সে সব কটু কথা মেনে নেয়। উত্তর দেয় না। স্পৃহার এই নিরুত্তর থাকাটাও যেন আরেফিনের সহ্যের বাইরে।
আজকাল অফিস থেকে দেরী করে আসে আরেফিন। স্পৃহা টেবিলে খাবার নিয়ে অপেক্ষায় থাকে।আরেফিন এসে বেল বাজালে স্পৃহা হাসিমুখে দরজা খুলে দেয়, আরেফিন কোন ভ্রুক্ষেপ কঅঅরে না। হনহনিয়ে ঢুকে যায় বেডরুমে। ফ্রেশ হয়ে এসে ল্যাপটপ নিয়ে ড্রয়িং রুমে বসে যায়।
স্পৃহা ডাকে, “ভাত খাবে এসো”
আরেফিন জবাব না দিয়ে একমনে ল্যাপটপে কাজ করে যায়।
স্পৃহা আবার ডাকে, “কি হলো খাবে না?”
এবার চেঁচিয়ে ওঠে আরেফিন, “আমার জন্য এত দরদ কিসের?”
নিজেরটা খাও আমি খেয়ে এসেছি।”
স্পৃহা অবাক তাকিয়ে থাকে, “আমাকে বলোনি যে বাইরে খাবে? আমি বসে আছি সেই কখন থেকে!”
আরেফিন আরো ক্ষেপে যায়, হ্যা মহারাণীকে বলিনি বাইরে খাবো, মাফ চাই মহারাণী! আমাকে মুক্তি দাও তোমার প্যাঁচাল থেকে।”
স্পৃহার চোখ বেয়ে নামে জলের ধারা। সে চুপচাপ খাবার গুলো ফ্রিজে রেখে বেডরুমে গিয়ে শুয়ে পড়ে। ভীষণ কষ্টে ওর চোখ ফেটে কান্না আসে, বাবার কথা মনে হয়। ভাবে বাবা যদি বেঁচে থাকতেন! এভাবে অপমানের জীবন হয়তো কাটাতো না সে। মা ভাইবোন কাউকে কিছুই জানায় না সে।
স্পৃহা জানে ওর মা খুব কষ্ট পাবেন এগুলা জেনে।
     (৪)

আজ স্পৃহার জন্মদিন। ওর ভাইবোন বন্ধুরা সবাই উইশ করছে। ওর কলিগরা ওকে সারপ্রাইজ দিয়ে ওর ডেস্কে বিশাল কেক, ফুল আর গিফট নিয়ে হাজির। ওর খুশিতে চোখে পানি চলে আসলো। ও ভাবছিলো আরেফিনের কথা। আরেফিন জানে আজ তার জন্মদিন, কই একবারওতো বলেনি! বিয়ের পর কতো আবেগ! দুজনে মিলে বাইরে সেলিব্রেট করলো। সুন্দর একটা আংটি গিফট করলো কখন কিনলো না জানিয়ে স্পৃহা সারপ্রাইজড। আর আজ একটা গোলাপও না! তবুও স্পৃহা প্ল্যান করে আজ দুজন বাইরে ঘুরবে, খাবে পারলে সিনেপ্লেক্সে কোন মুভি দেখবে। এই ভেবেই আরেফিনকে ফোন করে সে।আরেফিন ফোন ধরেই বলে, “কেন ফোন করেছো? জানোনা আমি ব্যস্ত থাকি এই সময়ে?”
আহত স্বরে স্পৃহে বলে, “তুমি ভুলে গেলে আজ আমার জন্মদিন? ভেবেছিলাম তোমাকে নিয়ে আজ বাইরে কাটাবো, ঘুরবো, খাবো আজ একটু তাড়াতাড়ি এসো।”
তেলেবেগুনে জ্বলে ওঠে আরেফিন, রাখ তোর জন্মদিন! একটা বাচ্চা জন্ম দেয়ার মুরোদ নেই আবার জন্মদিন পালন করে। আহ্লাদ দেখলে গা জ্বলে যায়।তুই কর তোর জন্মদিন তোর চৌদ্দগোষ্ঠি নিয়ে। আমাকে আর এসবে ডাকবি না। আর তুই জানিস না আমি বাইরের খাবার খাই না? আমাকে মারতে চাস না?”
হতবাক স্পৃহা দাঁড়িয়ে থাকে মোবাইল হাতে। সেদিনও বললো বাইরে থেকেখেয়ে এসেছে,অথচ আআজ! এ কেমন ব্যবহার। এই মানুষটিকে স্পৃহা ভালোবেসে ছিলো! ঘৃণায় অপমানে তার বুকভেংগে কান্না আসে।ওর ইচ্ছে হলো এখনই বাসা ছেড়ে বের হয়ে যায়। কিন্তু পারে না।বিবেক,সমাজ, আপনজনদের কষ্ট সব ভেবে স্পৃহা থেমে যায়।
সে ভাবে মানুষের চেহারা এভাবে বদলায়! অথচ ওর সাথে যেদিন পরিচয় হয় সদ্য বিদেশ ফেরত আরেফিন তখন ওদের দুজনেরই একজন কমন ফ্রেন্ডের সাথে স্পৃহার ভার্সিটিতে যায়। আরেফিন মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে থাকে।স্পৃহার কেমন অস্বস্তি হয় আবার ভালোও লাগে।স্পৃহার মোবাইল নম্বরটা চেয়ে নেয় আরেফিন। পাশে থাকা বন্ধুটি হাসে আর বলে তোদের দুই ব্যাচেলরকে পরিচয় করিয়ে দিলাম। বাকিটা তোদের হাতে। দেখি কি হয়।                                               (৫)

স্পৃহা ভাবেনি আরেফিন ফোন করবে। ভুলেই গিয়েছিলো। ভার্সিটি থেকে ফিরে ফ্রেশ হলো। লাঞ্চ শেষে দিলো ঘুম। বিকেলে মা ডাকলেন চা খেতে।মা আর বোনদের সাথে চা খাচ্ছিল। এমন সময় অপরিচিত একটা নম্বর থেকে কল এলো। স্পৃহা রিসিভ করে জানতে চাইলো, “কে বলছেন প্লিজ”?অপর প্রান্ত থেকে উত্তর এলো, “আমি”।
স্পৃহা বললো “আমি কে?” উত্তর এলো, “চিনতে পারেন নি বুঝি? আমি আরেফিন বলছি,আজ দুপুরে পরিচয় হলো আপনার ভার্সিটিতে”।
স্পৃহা অপ্রস্তুত। বললো, “দুঃখিত আমি চিনতে পারিনি, কেমন আছেন আপনি?’
এইতো আছি, আপনি ভালো”?।
এভাবেই শুরু কথোপকথন। দুজনের বাকবাকম থামে না। রাত জেগে কথা চলে, কখন আপনি থেকে তুমিতে নেমে এলো কারো মনে নেই।
আরেফিন তখন দেশের বাইরে থেকে এসেছে, সিদ্ধান্ত নিয়েছে দেশেই ব্যবসা শুরু করার চেষ্টায় আছে। আর বিদেশ যাওয়ার প্ল্যান নেই। কথায় কথায় ওদের সম্পর্কটা আরো গাঢ় হয়। দুজনে মিলে সিদ্ধান্ত নেয় ওরা বিয়ে করবে। স্পৃহা মাকে জানায় সব। মাও অমত করেন নি।
শুরু হয় বিয়ের প্রস্তুতি। দুজনে মিলে ঘুরে ঘুরে বিয়ের শপিং করলো। দিন গুলি কতো সুন্দর ঝর্ণাধারার মতো বয়ে যাচ্ছিল।
অনাড়ম্বর অনুষ্ঠানে শুধু কিছু নিকটাত্মীয়ের উপস্থিতিতে ওদের বিয়ে হয়ে গেলো।বিদেশ ফেরত আরেফিন সে দিন থেকে স্পৃদের বাসাতেই রয়ে গেলো।
দিন গুলো সুন্দর কাটছিলো দুজনের। আরেফিন ব্যবসার চেষ্টা করছে, আর স্পৃহাও যথেষ্ট সহয়ায়তা করছে তাকে এ ব্যপারে। দিন গড়িয়ে যাচ্ছিলো।
আরেফিন ঘুমেই থাকে,পৃথু চলে যায় ওর কর্মক্ষেত্রে। স্পৃহার মা নাস্তা রেডি করে টেবিলে রাখেন। আরেফিন নিঃশব্দে নাস্তা সেরে ওর রুমে ঢুকে দরোজা বন্ধ করে দেয়। প্রচুর সিগারেট টানে। কারো সাথে সৌজন্যের ধার ধারে না। এগূলো স্পৃহা লক্ষ্য করে, ওর অস্বস্তি হয় তবুও কিছু বলে না।
বাসায় ফিরে সবার মুখ দেখেই স্পৃহা বুঝে নিতে পারে, আরেফিনের ওপর কেউ সন্তুষ্ট নয়।আরেফিন তার ব্যবসায়ও সফল হতেপারেনি। তাই কেমন ক্ষ্যাপাটে হয়ে ওঠছে দিনদিন।পরিবারের কাছে স্পৃহা আরেফিনের এই রূপ দেখাতে চায় না। তাই সে আলাদা বাসা নেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়।
সেই ভেবে ও একটা বাসাও খুঁজে নেয়। আরেফিন আপত্তি করে। স্পৃহা বলে তুমি চিন্তা করো না। আমার আয়েই চলে যাবে।আরেফিন রেগে ওঠে, “বউয়ের কামাই খাবো বসে বসে!”
স্পৃহা মনে মনে বলে,”এতোদিন তো তাই করছিলে!” মুখে কিছু বলে না।
আলাদা বাসায় এসে স্পৃহার কষ্ট হয়, মা ভাইবোনকে মিস করে,,তবুও স্বস্তি পায় অন্তত আরেফিনের রূঢ় চেহারাটা ওর আপনজনেরা দেখবে না।
আরেফিন এখন সারাদিন ঘুমায়,টেবিলে স্পৃহা সব খাবার রেখে কর্মক্ষেত্রে যায় আর আরেফিন সময়মতো আয়েশ করে খেয়েদেয়ে বিকেল হলেই বের হয়ে যায়, বন্ধুদের সাথে আড্ডায় মেতে থাকে।
স্পৃহা বাসায় ফিরে আরেফিনকে আর পায় না। সময়গুলো দীর্ঘ মনে হয়। একা একা গা ছমছম করে।স্পৃহা ফোন করে “কোথায় তুমি?”
আরেফিন উত্তর দেয়, “ব্যস্ত আছি বারবার ফোন করবে না।”
স্পৃহা চুপচাপ শুয়ে থাকে, প্রিয় গান শুনে কিংবা বই পড়ে। ফোনে সবার খোঁজ নেয় তবুও ওর সময় কাটে না।কিছুই ভালো লাগে না তার। প্রচন্ড মন খারাপ।নিয়ে বসে থাকে।
আরেফিন যেনো স্পৃহাকে উপেক্ষা করেই আনন্দ পায়।
আর স্পৃহা ওকে খুশি।রাখার জন্য কি না করে!
ওর পছন্দের খাবারটা রান্না করে, ওর জন্য সুন্দর পোশাকটা কিনে আনে, সিগারেট স্পৃহার পছন্দ না তবুও নিয়ে আসে বাসায় ফিরার সময়। কোন কিছুতেই কমতি নেই। নেই ভালোবাসায়ও।কমতি। তবে কেন এমন হচ্ছে?
খুব কান্না পায়।স্পৃহার। একা একাই কান্না করে। কেউ দেখেনা ওর কান্না।
    (৬)
ঈদ এলো, প্রতি ঈদেই স্পৃহা শ্বশুর বাড়ি যায়। সবার জন্য শপিং করে নিজের ভাইবোন মা, শ্বশুরবাড়ির লোকজন কেউ বাদ যায় না। এসব ব্যপারে আরেফিন খুব উদাসীন তবে ওর পরিবারের জন্য সব নেয়া হয়েছে কিনা খোঁজ নেয় ঠিকই কিন্তু টাকা পয়সা কোত্থেকে আসে তার খবর নেয় না মোটেও।
এবারে আরেফিন গো ধরলো বাড়িতে যাবে না।
স্পৃহা বলে,”কেন যাবে না?”
খুব কটাক্ষ করে জবাব দিলো,” আরেফিন, জানো না কেন যাবো না।? অই এতো ভান করো কেন? যেন কিছুই জানোনা? তুমি জানোনা বাড়িতে গেলে প্রশ্ন করবে সববাই,বাচ্চা কই তোমাদের? বাচ্চা হয় না কেন? কি জবাব দিবা তখন? ”
স্পৃহা জবাব দেয় কান্না সামলে, “বাচ্চা না হওয়াটা কি আমার অপরাধ।এতে আমার কোন হাত আরেফিন ধমক দেয়, “একদম চুপ কোন কথা বলবে না।”
স্পৃহা চুপ থাকে না,বলে যায়, “আমাকে দোষারোপ করছো কেন, এ দায়ভার দুজনের, অনেক ট্রিটমেন্ট কঅঅরালা দেশে বিদেশে।কিছু হলো না। টেস্টটিউব বেবি নিতে চাইলাম তাতেও রাজি না তুমি। আমার সাথে এত রাগ দেখাচ্ছ কেন?”
“ওহ,মহারাণী আসছেন ওনি কোন রাগ দেখানো।যাবে না”আরেফিন জবাব দেয়।
“আমার খুব কষ্ট হয় আমার কোন বাচ্চা হয় না বলে, মা হওয়ার ইচ্ছা পৃথিবীর কোন মেয়ের হয় না বলতে পারো? তুমি আমার কষ্টটা দেখলে না! লোকে কি বলবে তাই নিয়ে এতো ভাবনা।”স্পৃহা বলেই কান্নায় ভেঙে পড়ে, আরেফিন কোন ভ্রুক্ষেপ না করেই পাশের রুমে চলে যায়, ব্যস্ত হয়ে পরে ল্যাপটপে, চয়াটিং এ।
বেশ সময় পরে স্পৃহা একটু শান্ত হয়, আবার আরেফিনের কাছে যায়, বলে “এভাবে তো চলে না। চলো আমরা বরং একটা বাচ্চা এডপ্ট করি।” শুনে আরেফিন তেলেবেগুনে জ্বলে ওঠে। কি? পরের বাচ্চা,রাস্তার বেজন্মা বাচ্চা আমার ঘরে আনবে? সাহসতো কম না তোমার?”
স্পৃহা বলে, “রাস্তার কেন হবে,কোন ভালো গরীব পরিবার থেকেই আণোবো।”
আরেফিন বলে, “দরকার নাই আমার এমন।বাচ্চার,ওর শরীরে কি আমার রক্ত বইবে,ও কি আমার বংশ আলো করবে?”
স্পৃহার খুব ঘৃণা আসে ভাবতে এই লোকটাকেই সে ভালোবেসে বিয়ে করেছিলো?ওরতো আমার জন্য কোন ভালোবাসাই ছিললো না।লোভ ছিলো।আমার চাকুরী আর আমার সামাজিক অবস্থানের প্রতি।নইলে এমন অমানুষের মতো কথা বলতে পারতো না।
স্পৃহা বলে, “ঠিক আছে তাহলে,তোমার বাচ্চার এতো শখ হলে যাও আবার বিয়ে করো,তোমার ঘর আলো।করে অনেক বাচ্চা আসুক। আমি খুশিই হবো।”
আরেফিন আবার চেচায়, “এই বয়সে আর কিসের বাচ্চা, এক পা কবরে।”
স্পৃহা বলে,”তুমি বেঁচো থাকো, আবার বিয়ে কর। আমি মরলেই বাঁচি।”
এভাবে কথার পিঠে কথা চলতেই থাকে। স্পৃহা শান্তি পায় না। কথার আঘাতে পরতিনিয়ত ক্ষত বিক্ষত হতেই থাকে।
ওরা পরের দিন ঠিকই বাড়ির উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেয়।সবার সাথে ঈদ করবে তাই। বাড়িতে পপৌছানোর কিছুক্ষণের মধ্যেই আরেফিন বের হয়ে যায় বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিতে আর স্পৃহা অনভ্যস্ত পরিবেশে সবার মন যোগাতে ব্যস্ত।
স্পৃহা এক এক।করে সবার হাতে ঈদের গিফট তুলে দেয়। সবাই ভাবে আরেফিন কিনেছে সব। সবাই আরেফিনের প্রশংসায় পঞ্চমুখ। স্পৃহা নীরবে হাসে। সে জানে এগুলো কিনতে তাকে কতটা ছাড় দিতে হয়েছে।
স্পৃহার শাশুড়ি বেশ মুখ ভার করে আছেন স্পৃহার সাথে তেমন কথা বলছেন না।সস্পৃহা বুঝতে পারছে না কারণ। জিজ্ঞেস করে, “মা শাড়ি পছন্দ হয়নি?” শাশুড়ি নিরুত্তর চলে যান। স্পৃহার মন খারাপ হয়। সে পাত্তা দেয়না। ও জানে সব কিছুকে এত পাত্তা দিতে নেই।
স্পৃহা ওর জায়ের সাথে ঈদের রান্নাবাড়া, ঘর গোছানোতে সাহায্য করে।
খুব মিস করে আগের দিন গুলো, মা বাবা ভাইবোনদের সাথে কাটান ঈদগুলোকে।

ঈদের দিন বিকেলে আসেন আত্মীয় স্বজনেরা। ঈদের সোজন্য বিনিময় করতে। স্পৃহা জায়ের সাথে গিয়ে সবাইকে সালাম জানায়। আরেফিন ওর মা, বড়ভাই সবাই ছিলো তখন।একজন আত্মীয় স্পৃহাকে জিজ্ঞেস করলো, তোমার ছেলে না মেয়ে? কই দেখলামনাতো কাউকে?”
স্পৃহা অপ্রস্তুত ছিলো এমন প্রশ্নের জন্য, কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে আমার কোন ছেলে বা মেয়ে কিছুই হয়নি।মহিলা যেন আকাশ থেকে পড়লেন, হায় হায় একি কথা বিয়ে হয়েছে এতবছর এখনো ছেলেমেয়ে হয়নি? কেন? চিকিৎসা করাও নি।আমাদের আরেফিনের ঘরে বাতি জ্বালবে কে? ওর কবরে মাটি দেওয়ারো কেউ থাকবেনা! ও বুবু একি কথা শুনলাম।
স্পৃহার শাশুড়ি বলে, “আমি আর কি বলবো, ওরা আধুনিক মানুষ।, ওরা বাচ্চা নিলে ওদের শরীর স্বাস্থ্য নষ্ট হয়ে যাবে।” বলেই তিনি ওঠে গেলেন।আরেফিনও স্পৃহার দিকে অগ্নি দৃষ্টি হেনে বের হয়ে গেলো। ওর জায়ের ব্যঙ্গ হাসি স্পৃহার চোখ এড়ালো না।
স্পৃহা চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলো, ওর চোখ বেয়ে নামলো অশ্রুধারা। কেউ দেখলো না।
#পর্ব -৭
স্পৃহারা ফিরে আসে ঢাকা ঈদের পরদিন। আগের রাতেও আরেফিন স্পৃহার সাথে কোন কথা বিলে নি।পথে দুজনই চুপচাপ। বাসায় ঢুকেই আরেফিন চেঞ্জ করে ফ্রেশ হয়ে শুয়ে পড়লো। স্পৃহা তড়িঘড়ি খাবার রেডি করে আরেফিনকেনল খেতে ডাকলো।আরেফিন ওঠে চুপচাপ খেয়ে ওঠে গেল। স্পৃহার উপস্থিতিতে যেন তার কিছু যায় আসে না।
স্পৃহা কিছুই বললো না। চুপচাপ কাজ শেষ করে ঘুমাতে গেলো।আরেফিন সাথে ওঠে গেলো। স্পৃহা বললো, “কই যাও”?
আরেফিনের জবাব” আমি পাশের রুমে থাকবো কোন অসুবিধা”?
স্পৃহা বলে, “কেন পাশের রুমে থাকবে তুমি?”
আরেফিন ক্ষেপে ওঠে বলে বলেছিলাম বাড়িতে না যেতে! আহ্লাদ দেখাতে গেছেন ওনি।লজ্জাও লাগে না বাচ্চা হয় না, আবার ঢ্যাং ঢ্যাং করে বাড়িতে যাওয়া হয়। আমাকে ছোট দেখাইতে খুব মজা তাই না?”
থাকো তুমি তোমার মতো, আমাকে আমার মতো থাকতে দাও, আমাকে আর জ্বালাবে না”
স্পৃহা বলে, “আমি তোমাকে জ্বালাই?
বাদ দাও না এসব পুরোনো কথা! পৃথিবীতে কি শুধু আমরাই নিঃসন্তান? চারিদিকে তাকিয়ে দেখ কত আছে এমন। এমন চিৎকার করলে কি বাচ্চা চলে আসবে?” কষ্টতো আমারো আছে”।
আরেফিন চিৎকার করে বলে তুমি কোন কষ্টে নাই, তোমার ভাইবোন নিয়ে আনন্দে আছো, মহা আনন্দে।থাকো আনন্দে। আমাকে শুধু আমার মতো থাকতে দাও।”
স্পৃহাও চিৎকার করে বলে, “হ্যা আমি আমার মা ভাইবোন ফেলে দেবো নাকি? তুমি আবার বিয়ে কর, বাচ্চা হওয়াও যতটা পার, আমাকে মুক্তি দাও”।
      (৭) 
স্পৃহারা ফিরে আসে ঢাকা ঈদের পরদিন। আগের রাতেও আরেফিন স্পৃহার সাথে কোন কথা বিলে নি। পথে দুজনই চুপচাপ। বাসায় ঢুকেই আরেফিন চেঞ্জ করে ফ্রেশ হয়ে শুয়ে পড়লো। স্পৃহা তড়িঘড়ি খাবার রেডি করে আরেফিনকেনল খেতে ডাকলো।আরেফিন ওঠে চুপচাপ খেয়ে ওঠে গেল। স্পৃহার উপস্থিতিতে যেন তার কিছু যায় আসে না।
স্পৃহা কিছুই বললো না। চুপচাপ কাজ শেষ করে ঘুমাতে গেলো।আরেফিন সাথে ওঠে গেলো। স্পৃহা বললো, “কই যাও”?
আরেফিনের জবাব” আমি পাশের রুমে থাকবো কোন অসুবিধা”?
স্পৃহা বলে, “কেন পাশের রুমে থাকবে তুমি?”
আরেফিন ক্ষেপে ওঠে বলে বলেছিলাম বাড়িতে না যেতে! আহ্লাদ দেখাতে গেছেন ওনি।লজ্জাও লাগে না বাচ্চা হয় না, আবার ঢ্যাং ঢ্যাং করে বাড়িতে যাওয়া হয়। আমাকে ছোট দেখাইতে খুব মজা তাই না?”
থাকো তুমি তোমার মতো, আমাকে আমার মতো থাকতে দাও, আমাকে আর জ্বালাবে না”
স্পৃহা বলে, “আমি তোমাকে জ্বালাই?
বাদ দাও না এসব পুরোনো কথা! পৃথিবীতে কি শুধু আমরাই নিঃসন্তান? চারিদিকে তাকিয়ে দেখ কত আছে এমন। এমন চিৎকার করলে কি বাচ্চা চলে আসবে?” কষ্টতো আমারো আছে”।
আরেফিন চিৎকার করে বলে তুমি কোন কষ্টে নাই, তোমার ভাইবোন নিয়ে আনন্দে আছো, মহা আনন্দে।থাকো আনন্দে। আমাকে শুধু আমার মতো থাকতে দাও।”
স্পৃহাও চিৎকার করে বলে, “হ্যা আমি আমার মা ভাইবোন ফেলে দেবো নাকি? তুমি আবার বিয়ে কর, বাচ্চা হওয়াও যতটা পার, আমাকে মুক্তি দাও”।
স্পৃহার ভাই এসে কখন দাঁড়িয়েছে ওরা জানতে পারেনি।স্পৃহার ভাই সব শুনেছে, সব শুনে খুব কষ্ট পেল।
বোনকে বললো, “তুই এই নির্যাতন একা একা ভোগ করছিস আমাদের একবারও জানালি না”!
খুব আহত দেখায় তাকে। স্পৃহা তখন কান্নায় ভেংগে পড়ে।
ভাই বলে, “কান্না কোন সমাধান না, তোর জন্য কোন ভালোবাসা থাকলে সে এমন করতো না। সে তোমার মাথায় কাঁঠাল ভেংগে খাচ্ছে আবার তোকেই শাসিয়ে দুর্বল করে রাখছে। তুই শিক্ষিত, স্বাবলম্বী, তুই এ ঘর থেকে বের হ, বাঁচতে চাইলে। সব বাদ দিয়ে একবার নিজের মতো করে বাঁচ।
স্পৃহা বলে,”আমার মন খুব দুর্বল, এতো কঠিন ডিসিশন নিতে পারিনা।”
স্পৃহার ভাই হেসে বলে, জীবনটা তোর, ডিসিশনটা তোকেই নিতে হবে”।
স্পৃহা চিন্তায় ডুবে থাকে, কি করবে ভাবে। হতাশা তাকে গ্রাস করে।
ওরা একসাথে আগে কত বন্ধুদের আড্ডায় যেতো, এখন যাওয়া হয়না। আরেফিন ওকে নিয়ে কোথাও যেতে চায় না।
স্পৃহা নিজেকে শক্ত করে, আর কান্না নয়।সে একাই যায় বন্ধুদের সাথে আড্ডায়।
আরেফিন নিজের মতো থাকে, অফিসে যায়— যে চাকুরীটা স্পৃহাই ম্যানেজ করে দিয়েছিলো।
স্পৃহার একটা স্কলারশিপের অফার আসে হঠাৎ করেই। স্পৃহা ডিসিশন নেয় সে স্কলারশিপ নিয়ে বাইরে চলে যাবে। আরেফিনকে কিছুই জানায় না।
ভিসা, কাগজপত্র রেডি, স্পৃহা নিজের কিছু পরিধেয় একটা লাগেজে নেয়।
সব রেডি করে উবারে কল দেয়, আরেফিনের গাড়ি আছে যাতে স্পৃহার খুব কমই হয়েছে ওঠার।
স্পৃহা ঘরের চাবি আরেফিনের হাতে দিয়ে বলে, চাবিটা রাখো।
নিজেকে খুব কষ্টে সামাল দিয়ে বলে, এঘর, প্রতিটা জিনিস তোমার, তুমি আবার বিয়ে কর তোমার পছন্দ মতো। আমি তোমায় কোন সুখ দিতে পারিনি।
আশা করি তুমি সুখি হবে। সন্তানেরা তোমার ঘর আলোকিত করবে।
আরেফিন বলে,” তুমি কোথায় যাচ্ছো? আমাকে বলোনিতো আগে”!
স্পৃহা বলে, “তুমি তো বলেছো আমাকে আমার মতো থাকতে! তুমিও তোমার মতো থাকো।তোমার লাইফে আমি আর আসবোনা। আজ দুইটায় ফ্লাইট। কানাডা চলে যাচ্ছি।
আরেফিন স্তম্ভিত দাঁড়িয়ে থাকে।
স্পৃহা ওর লাগেজ নিয়ে বেড়িয়ে পরে।একবারও পিছনে ফিরে না।
স্পৃহার উবার এয়ারপোর্টের দিকে ছুটে চলে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here