থাবা
নাসরীন জামান
সুরমা আর সিহাবের সংসারটায় হঠাৎ করেই যেন অভাবটা জেঁকে বসেছে। করোনা ভাইরাসের বৈশ্বিক মহামারীর দাপট কেড়ে নিয়েছে তাদের ক্ষুদ্র আয়ের পথ। সুরমা পুরাতন বইয়ের ব্যবসা করতো। বড় বড় লাইব্রেরী থেকে, বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্র থেকে আর বাংলা একাডেমি থেকে অনেক দিনের পড়ে থাকা পুরোনো বইগুলো খুব অল্প দামে কিনে আনতো সে। তারপর সেগুলো ভ্যানগাড়িতে সাজিয়ে নিয়ে বাজার এলাকার গলির মোড়ে বসে বিক্রী করতো। বইতে যে নির্ধারিত মূল্য দেয়া থাকতো কখনও তার অর্ধেক মূল্যে আবার কখনও তারও চেয়ে কম মূল্যে বিক্রী করতো সে। দিন শেষের গুনতি হিসাবে ভালোই টাকা আসতো তার হাতে। আজ কঠিন সময়ের এই দিনে সে বই আর কেউ কেনে না। কিনবে কি করে? জীবনঘাতী মহামারী করোনার থাবায় সবার আয়েরই যে একই অবস্থা। আগে তো পেটের ভাত চাই, তারপর মনের খোরাক।
সিহাবের ছিলো ফুল বিক্রীর ব্যবসা। রাতের ট্রাকের মাথায় চড়ে যশোর থেকে ফুল কিনে আনতো সে। সেই ফুল বিক্রী করতো শাহবাগ মোড়ে বসে। আজ সেই করোনার কারনেই বিভিন্ন সভা সমিতি আর কলেজ ইউনিভার্সিটিও বন্ধ। তাই সিহাবের ফুল ব্যবসাও বন্ধ। এখন ফুল কেনার ক্যাশ ভেঙে ভেঙেই কোনও রকমে পেটে ভাতের জোগাড় চলে তাদের। দুদিন আগে সে টাকাও খরচের খাঁতে চলে গেছে। এখন জীবন বাঁচানো মহা দায়।
সুরমা সিদ্ধান্ত নেয় সে ব্যবসা পাল্টাবে। করোনার ভয়াল থাবার মুখেও যে ব্যবসা চলে, সেই ব্যবসাই সে করবে। সংসারটাকে তো আগে বাঁচাতে হবে। সুরমা তাই তার শেষ সম্বল বিয়ের গয়নার কানের দুল জোড়া বিক্রী করে দেয়। সেই টাকায় কাঁচা সবজি কিনে দোকান সাজায় সে। প্রতিদিন ভোররাতে উঠে সিহাব আর সুরমা কারওয়ান বাজারের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়। সবজির পাইকারী বাজার থেকে সবজি কিনে আনে আর দিনের বেলা ভ্যান সাজিয়ে বই বিক্রী করার মতো করেই সেই সবজি বিক্রী করে ওরা। তাতে ভাতের খরচ বাদ দিয়েও বস্তির টিনসেডের ঘরের ভাড়াটাও উঠে আসে।
কোনও এক ভোররাত। সিহাব ভ্যান চালায় আর সুরমা ভ্যানে বসে পা দুলিয়ে দুলিয়ে গুনগুন করে গান গায়। ওদের ভ্যানগাড়ি তখনও কারওয়ান বাজারে পৌছেনি। ঠিক সেই মুহূর্তেই ওদের পথ আটকে দাঁড়ায় তিন চারজন মাতাল বখাটে ছেলে। ওদের নজর পরে সুরমার চাঁদপনা মুখ আর আঁটসাট যৌবনবতী দেহের উপর। ওরা মুহূর্তেই সিহাবের হাত পা বেঁধে সিহাবকে রাস্তার উপর ফেলে রেখে সুরমার দিকে এগিয়ে আসে। সুরমা ছিলো অসীম সাহসী মেয়ে। তাই সে ততক্ষণে কোমরে শাড়ির আঁচল পেঁচিয়ে সবজি কাটা ধারালো চাকুটা নিয়েই নিজের বিপদ ঠেকাতে দাঁড়িয়ে যায়। মাতালরা তারপরও কাছে আসার চেষ্টা করলে সুরমা এলোপাথারি চাকুটা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে নিজেকে রক্ষা করার চেষ্টা করে।
এরই মধ্যে পুলিশের জোরালো বাঁশির আওয়াজ পেয়ে আক্রমণকারীরা সুরমাকে ফেলে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। কিন্তু তারপরও সুরমার নিয়তি সুরমাকে নিয়ে খেলতে বসে অন্য খেলা।
আজ সুরমার পোস্টমর্টেম রিপোর্ট থানায় জমা করা হয়।সেখানে লেখা আছে সুরমাকে গণধর্ষণ করে গলায় শক্ত দড়ি পেঁচিয়ে শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হয়।
সেদিন পুলিশের বাঁশির আওয়াজে আক্রমণকারীরা পালিয়ে গেলেও সুরমা নিজে পালাতে পারেনি সেই নৈশ প্রহরী পুলিশ নামের হায়েনাদের কঠিন থাবা থেকে। অর্থাৎ সেদিন হাত পা বাঁধা সিহাবের সামনেই সেই রক্ষকরাই ভক্ষক হয়ে গিলে খেয়েছে সুরমার সম্ভ্রম আর প্রাণের স্পন্দন।
সিহাব আজ তাই থানার সামনেই দাঁড়িয়ে পাগলের মতোই গলা ফাটিয়ে চিৎকার করছে
‘বিচার চাই, বিচার চাই।‘
সে চিৎকার মিশে যাচ্ছে শব্দবহুল ঢাকা শহরের হাজার শব্দের মাঝে। সিহাব জানে না, সে কি আসলেও বিচার পাবে? নাকি তার বিচারের এ দাবী তলিয়ে যাবে প্রবাহমান সময়ের শত সহস্র কোটি শব্দের তলায়।