প্রণব মুখার্জি : শিক্ষক থেকে ভারতের প্রেসিডেন্ট
হাসানুজ্জামান
একজন সাধারণ ঘরে জন্মনিয়ে অসাধারণ হয়ে উঠেছিলেন প্রণব মুখার্জি। তিনি শুধুমাত্র নিজ রাজনৈতিক দল কংগ্রেসের মধ্যে নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখেননি। প্রতিটি রাজনৈতিক দল , কর্মী এবং ভারতের জনতার কাছে তিনি হয়ে উঠেছিলেন মহীরুহ। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের পক্ষে ভারতীয় লোকসভায় তার বলিষ্ঠ ভ’মিকার কারণে বাঙালি জাতির কাছে তিনি চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন। গেল ৩১ শে আগষ্ঠ মৃত্যুর পর বাংলাদেশ সরকার একদিনের এবং ভারতের মোদী সরকার এই গুণির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে সাত দিনের রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণা করেছেন। তিনি ছিলেন পৃথিবীর জনবহুল অন্যতম গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ভারতের নির্বাচিত ত্রয়োদশ প্রেসিডেন্ট।
পশ্চিমবঙ্গের বীরভ’ম জেলার কীর্ণাহার শহরের নিকটস্থ সিরাতি শহরের একটি সাধারণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করা এই গুণি ব্যক্তির বাবা ছিলেন বৃটিশবিরোধী আন্দোলনের একজন অকুতোভয় সৈনিক এবং বৃটিশদের রোষানলে পড়ে দশ বছর জেল খেঠেছেন। কংগ্রেসনেতা বাবার উৎসাহে প্রণব মুখার্জি গ্রামের স্কুলে পড়াশোনা শুরু করে কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাস,রাষ্ট্রবিজ্ঞান এবং আইন বিষয়ে মাস্টার্স করেছেন। পড়াশোনার ইতিটেনে তিনি প্রথমে হাওড়া জেলার বাঁকড়ায় অবস্থিত বাঁকড়া ইসলামিক হাইস্কুল এবং পরবর্তীতে চব্বিশপরগণা জেলার আমতলার নিকটস্থ বিদ্যাসাগর কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক হয়েছিলেন। কিছুদিনের জন্য তিনি ‘ দেশের ডাক’ নামের স্থানীয় একটি পত্রিকায় সাংবাদিকতা করেছেন। সভাপতি ছিলেন বাঙলা ভাষা ভাষিদের প্রাণের প্রিয় সাহিত্য সংগঠন ‘ নিখিল ভারত বঙ্গ সাহিত্য সম্মেলন পরিষদের।’
রাজনৈতিক পরিবারের এই ছেলে এ সব কিছুকেই পিছনে ফেলে ভারতের অতি পুরাতন সংগঠন বাবার অনুসারি হয়ে কংগ্রেসে যোগদান করেন। ১৯৬৯ সালে প্রথমবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়ে অল্পদিনের মধ্যে প্রতিভাবান এই ব্যক্তি ভারতের জনপ্রিয় কংগ্রেস নেত্রী ইন্দিরা গান্ধির আস্থাভাজন হয়ে উঠতে সক্ষম হলে দলের মধ্যে প্রভাবশালী ব্যক্তিতে পরিণত হোন। তার প্রজ্ঞা,মেধা এবং ধৈর্যের কারণে কংগ্রেস সরকারের বিভিন্ন মেয়াদে স্বরাষ্ট্র, পররাষ্ট্র ,অর্থ এবং সর্বশেষ ২০১২ সালের ২৫ শে জুলাই সর্বভারতের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়ে দেশ ও দেশের বাইরে ভারতের ভাবমূর্তিকে তুলে ধরতে ব্যাপক ভ’মিকা রেখেছেন। অর্থমন্ত্রী থাকাকালে সরকারের বিভিন্ন আর্থিক খাতের ব্যাপক সংস্কার করে তিনি রাজনীতিতে বেশ আলোচিত হয়ে ওঠেন। ১৯৮৪ সালে যুক্তরাজ্যের ‘ইউরোমানি,পত্রিকার এক সমীক্ষায় দেখা গেছে সেই সময়ে সারা দুনিয়ায় শ্রেষ্ঠ অর্থমন্ত্রী হিসাবে খ্যাতি অর্জন করেন প্রণব মুখার্জি। কংগ্রেস নেতা রাজীবগান্ধীর সাথে দেশ শাসনের নীতি নিয়ে মনোমালিন্য হলে তাকে দল থেকে বহিঃস্কার করা হয়। এই সময়ে এই নেতা ‘ রাষ্ট্রীয় সমাজবাদী কংগ্রেস’ নামের নতুন একটি রাজনৈতিক দল গঠন করেন। কিন্তু এই দল নিয়ে তাকে বেশি দিন এগুতো হয়নি। রাজীবগান্ধীর পক্ষ থেকে আহবান এলে মান-অভিমান ভুলে তিনি তার গঠিত নতুন দল নিয়ে পুনরায় কংগ্রেসে যোগদান করেন।
সততা,প্রজ্ঞা এবং উদারনৈতিক কারণে প্রণবমুখার্জির জনপ্রিয়তা শুধুমাত্র দলের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেনি। ভারতের প্রতিটি রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীদের কাছেও তিনি একজন শ্রদ্ধার পাত্র হয়ে ওঠেন। ভারতের রাজনীতিতে সত্যিই ইহা একটি বিরল ঘটনা। বহুবিধ প্রতিভার অধিকারী অসাম্প্রদায়িক চেতনার এই গুণি মানুষটিকে ভারত সরকার দেশের সর্বোচ্চ সন্মানীয় পুরস্কার ভারতরত্ন ও পদ্মভ’ষণে ভ’ষিত করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রণব মুখার্জিকে ‘ডক্টররেট অব ল’ডিগ্রী প্রদান করে বআঙালি প্রিয় এই আলোকিত মানুষটিকে সন্মানিত করেছেন।
তিনি এ পর্যন্ত নিজের লেখা আটটি বই প্রকাশ করেছেন। তার মধ্যে ২০১৭ সালে প্রকাশিত একটি বইতে বাংলাদেশের রাজনীতির কিছু অংশ তুলে ধরতে গিয়ে সামরিক শাসনামলে গ্রেফতারকৃত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তিতে তার কুটনৈতিক ভ’মিকার কথা উল্লেখ করেছেন। ভারতের প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী ইন্ধিরা গান্ধীর সাথে সুস্পর্কের কারণেই এই বাঙালি কংগ্রেস নেতা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে দেশ এবং দেশের বাইরে ব্যাপক ভ’মিকা রাখতে সক্ষম হয়েছিলেন। ফলে বাংলাদেশের এই অকৃত্তিম বন্ধুর মৃত’্যতে দেশের মানুষের মধ্যে শোকের ছায়া নেমে আসে।
প্রণবমুখার্জির মৃত্যুতে তার একমাত্র ছেলে সাবেক সাংসদ কংগ্রেসনেতা অভিজিৎ টুইট বার্তায় জানান, গেল ১০ আগষ্ঠ বাবা নয়াদিল্লীর রাজাজি মার্গের সরকারী বাসভবনে কলঘরে পড়ে গিয়ে মাথায় আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে সেনা হাসপাতালে ভর্তি হয়। সেখানে তার করোনাভাইরাস ধরা পড়ে। জীবনের সাথে যুদ্ধ করে অবশেষে গেল ৩১ আগষ্ঠ তিনি ইহ জগত ছেড়ে পরলোকে চলে যান।’ তার মৃত্যুতে ভারত, বাংলাদেশের মানুষের মাঝে শোকের ছায়া নেমে আসে।
লেখক ঃ সাংবাদিক ও গবেষক। ০১৭১১-১০৮৭৩৬