শান্তিনিকেতন এর ঘোষদার দোকান
অজন্তাপ্রবাহিতা
শান্তিনিকেতন চত্বরে ‘ঘোষদার দোকান’ প্রসিদ্ধ, আইকনিক ল্যান্ডমার্ক। দোকানের প্রতিষ্ঠাতা শ্রীহরিপদ ঘোষ গত হয়েছেন। এখন তাাঁর ছেলে হারুদা দোকানের মালিক। হারুদা ও সাধনা বৌদির অক্লান্ত পরিশ্রমে দোকানটি আজও আবাসিক ও আশ্রমিকদের প্রিয় ঠিকানা। সেই ছাত্রজীবন থেকেই ঘোষদার দোকানের সঙ্গে আমার সম্পর্ক। মাঝে মাঝেই ফোনে একে ওপরের খবর নিয়ে থাকি। এমনি একদিন কথায় কথায় ঘোষদার দোকান সম্পর্কে হারুদাকে কয়েকটা প্রশ্ন করেছিলাম :
- হারুদা এই করোনাকালে সব কেমন চলছে?
- সব কেমন ঝিমিয়ে পড়েছে গো। আশ্রম প্রায় ফাঁকাই বলতে গেলে। কি দিন ছিল আর কি দিন এলো।
- ঠিক বলেছো হারুদা। ছাত্রজীবনে তো শুধু তোমার দোকানে খাবারই খাইনি, বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডাও দিয়েছি। আজ ভাটার দিনে সেইসব আনন্দমুখর মুহূর্ত রোমন্থন করতে ভালোই লাগে, বলো? একটু তোমার দোকানের ইতিহাসটা বলো না ?
- বাবার জন্ম পূর্ববঙ্গে। দাদুর মশলার দোকান ছিল শ্যামবাজার পাঁচমাথার মোড়ে। ব্রিটিশ শাসনকালে, বাবা প্রথমে কাশিপুর গানফ্যাক্টরি এবং পরে ইছাপুর গানফ্যাক্টরি চাকরী করেন। তারপর বাবা মিলিটারীতে যোগ দেন। বাবার সাথে সাহেবদের বনিবনা না হওয়াতে চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে পৈতৃক বাড়ী নৈহাটিতে ফিরে বাবা প্রথমে দইয়ের ব্যবসা আরম্ভ করেন। দইয়ের ব্যবসা করতে করতেই বাবার এক বন্ধু বাবাকে বোলপুরে নিয়ে আসেন। বাবা প্রথম জীবনে শান্তিকেতনে ঘরে ঘরে গিয়ে দই বিক্রি করতেন। বাবার বানানো ‘খাট্টা-মিঠা’ দই সবার বিশেষ পছন্দের ছিল। তখন, বোলপুরে আসাযাওয়া করবার জন্য মাত্র দুখানা ট্রেন ছিল। একটা বারোটার লিংক ,আরেকটা রাতে গয়া প্যাসেঞ্জার। সারাদিন দই বিক্রি করে বাবা রাতের ট্রেন ধরে ফিরে যেতেন নৈহাটী। রাত দুটোর সময় বোলপুর থেকে দুটো বগি নিয়ে গয়া পেসেঞ্জার ছাড়তো, ওই বগিতেই বাবা ঘুমোতেন, ভোরবেলা নৈহাটী পৌঁছে যেতেন।
১৯৭৪ সালে সেবাপল্লীর এই জমি কেনা হয়। সামনের দিকে দরমার বেড়া আর খড়ের চাল দিয়ে ঘর বানিয়ে দোকান শুরু হয়।
সামনের দিকটা তখন প্রচুর তেঁতুল , জাম , আম,তাল গাছ দিয়ে ঘেরা ছিল। ধীরে ধীরে সেখানে ঘরবাড়ি হয়ে যাওয়াতে আমরা
পেছনের জমি কিনে সেখানে নতুন করে দোকান শুরু করি । - নৈহাটী ছেড়ে শান্তিনিকেতনে এই দোকান কেন ?
বাবা, রোদ-জলের তোয়াক্কা না করে বাঁকে করে ঘরে ঘরে দই মিষ্টি বিক্রি করে বেড়াতেন। অনেকদিন ধরেই নিজের ও ছেলের জন্য একটি স্থায়ী মিষ্টির দোকানের কথা ভাবছিলেন। বোলপুরের মানুষের সঙ্গে অসম্ভব ঘনিষ্ঠতা হওয়াতে উনি বোলপুরেই দোকান করার সিদ্ধান্ত নেন। প্রথমে, সিনেমা তলাতে দোকান ভাড়া নেন। কিছুদিন পরে শান্তিনিকেতনের নিয়মিত খদ্দেরদের আগ্রহে ও পরামর্শে বাবা সিনেমাতলার দোকান ছেড়ে শান্তিনিকেতন চত্বরে দোকান খোলার সিদ্ধান্ত নেন। যখন এই দোকান শুরু হয় তখন আমার বয়স ষোলো কি সতেরো, মোটামুটি কাজকর্ম দেখাশোনা করতে পারিI ছাত্রছাত্রী ছাড়াও আমাদের আশেপাশে রতনপল্লী , পূর্বপল্লী , শ্রীপল্লী ,শ্যামবাটি সব অঞ্চল থেকেই খদ্দেররা আমাদের দোকানের দই মিষ্টি ও সিঙ্গারা,কচুরি, নিতে আসতেন এবং আমিও সাইকেলে করে বহু অর্ডার বাড়ি পৌঁছে দিয়েছি।
- তোমার জন্ম কি শান্তিনিকেতনে ?
- হ্যাঁ। আমাদের সব ভাইবোনদের জন্ম বোলপুরে। আমাদের আট বোন তিন ভাই। আমি সাত নম্বর। আমার আগে সব দিদি।
- সেইসময়কার দোকানের পরিবেশ কেমন ছিল ?
- আশ্রমে দোকান করার পর বাবা একটা জিনিস লক্ষ্য করেছিলেন, ছাত্রছাত্রীদের হাতে টাকা থাকলেও খাবারের ব্যবস্থা ছিল না
। তাই বাবা ছাত্রছাত্রীদের জন্য সকালের জলখাবারের ব্যবস্থা করেন । মেনু ছিল , ডিম্ টোস্ট ,মালাই টেস্ট , ফ্রেঞ্চ টেস্ট ,
কচুরি ঘুগনি ও মিষ্টি । এই ব্যবস্থা শুরু করার পর থেকে ছাত্রছাত্রীদের আমাদের দোকানে আসা যাওয়া বেড়ে যায় ও দোকানের
প্রতি ভালোবাসা জন্মে যায় । সেন্ট্রাল লাইব্রেরি ,সেন্ট্রাল অফিসের বিশ্বভারতীর অন্যান্য ডিপার্টমেন্টের কর্মচারীরাও আমাদের
দোকানে জলখাবার খেয়ে যেত ।
বিশ্বভারতীতে পরীক্ষা দিতে আসা ছেলেমেয়েরা গার্জেন সহ আমাদের এখানেই খাবার খেয়ে পরীক্ষা দিতো । সেই সময় একসঙ্গে
পঞ্চাশ ষাট জনকে একসঙ্গে খাবার খাওয়ানোর ব্যবস্থা বিশ্বভারতীতে বিশেষ ছিল না । দোকানের সামনে বড়বড় তেঁতুল গাছ ছিল সেই গাছ তলায় ছেলেমেয়েরা বেঞ্চির তোয়াক্কা না করে মাটিতে চিনির বস্তা পেতে বসে খাওয়া দাওয়া করে যেত। ।
আমরা তাদের পরিবেশন করতে না পারলে নিজেরাই এসে খাবার নিয়ে খেয়ে আমাদের ঠিকঠাক পয়সা দিয়ে চলে যেত । এই কাজ তুমিও করেছো । ক্লাসের তাড়া থাকলে নিজেই নিয়ে খেয়ে যেতে । - বাব্বা ! তোমার মনে আছে ?
- থাকবে না । সেন্ট্রাল লাইব্রেরির পেছনের রাস্তা ধরে গান করতে করতে টিফিন করতে আসতে , তোমাদের গানের আওয়াজে বাবা বুঝতে পারতেন আমাদের তাড়া দিতেন , ওই যে সব দিদিরা আসছে খাবার দিতে হবে । তোমাদের সবার পছন্দ আমরা জানতাম তাই আমাদের অসুবিধে হতো না । তুমি খেতে ডিম্ টোস্ট । কি ঠিক কী না !
-হ্যাঁ, আমি ডিম্ টোস্ট খেতাম ,মালাই টোস্ট ভালো লাগতো না ।আচ্ছা হারুদা , সেই - কত যুগ ধরে তোমাদের দোকান চলছে , না জানি কত নামীদামী লোক এখানে এসেছেন ,চা খেয়েছেন , আড্ডা দিয়েছেন ,
- এমন কোনো মজার গল্প আছে ?
- হ্যাঁ গো , আমাদের দোকানে একসময় বিশ্বভারতীর অনেক বিখ্যাত মানুষ আসা যাওয়া করতেন, কার নাম উল্লেখ করবো,
কার বাদ দেব। ঘন্টার পর ঘন্টা সবাই বসে নানা বিষয় নিয়ে আলোচনা করতেন , গল্প হতো ,গান হতো , সেইসব দিনগুলো চোখের সামনে ভাসে। কত বিদেশী ছাত্র আমাদের এখানে এসে খাওয়া দাওয়া করতো। তাদের সুবাদে ভারতবর্ষের বাইরেও আমাদের দোকানের পরিচিতি পেয়েছিলো।
আশি সালের প্রথম দিকে আমিদভজন নামে একটি ছেলে আফ্রিকা থেকে এসেছিলো সঙ্গীতভবনে পড়াশুনা করতে। গায়ের রং কুচকুচে কালো আর অনেকটাই স্বাস্থ্যবান , লম্বায় প্রায় সাত ফিটের কাছাকাছি। একটা রিক্সাতে ও একাই যেত। সেইসময় একটা এটলাস সাইকেল কিনেছিলো। চমৎকার ছেলে ছিল। খুব অল্পদিনের মধ্যেই বাংলাভাষা বেশ রপ্ত করে নিয়েছিল। আমাদের দোকানে টিফিন করতে আসত। আর আমার বাবাকে ‘বাবাঘোষ’ বলে ডাকতো।
‘বাবাঘোষ খিদে পেয়েছে , খেতে দাও।’
মোটামুটি ওর খোরাক ছিল এই চারটে থেকে ছ’ খানা ডিমের পোচ,গোটা তিরিশেক কচুরি , সাত আটখানা মিষ্টি আর দু – গ্লাস দুধ ,এই ছিল ওর টিফিন।
সেইসময় আমিও যথেষ্টই স্বাস্থ্যবান ছিলাম কিন্তু ওর পাশে হেঁটে গেলে সবাই বলতো , হাতির পাশে ইঁদুর হাঁটছে। বিশ্বভারতীর ছাত্ররা চিরকালই ফুটবল প্রেমী এবং ছুটির দিন গুলোতে প্রায়ই টুর্নামেন্ট লেগে থাকতো। সেদিন পূর্বপল্লীর মাঠে সংগীতভবন আর বিদ্যাভবনের ম্যাচ , প্রচুর লোক জমা হয়েছিল। আমিদ গোলকীপার। ন’খানা গোল খেয়ে গো হারা হেরে দোকানে আসে।
বাবা জিজ্ঞেস করে , ‘টুর্নামেন্ট কেমন হলো বাবা ?’ - বাবাঘোষ, ন’টা গোল।’
সেদিন ওর মনটা বেশ খারাপই ছিল, অন্যদিনের থেকে কম খেয়ে বলে ,’আজ বেশি খাবো না ,ন’টা গোল খেয়েছি’, বলে চলে গেলো।
ওর আরেকটা বিস্ময়কর দিক ছিল যে মহম্মদ রফির গান হুবহু গাইতো। গান শুনলে মনে হতো যেন রফিসাবই গান গাইছেন।
রফি সাহেবের সাথে বেশ কিছু ছবি আমাদের দেখিয়েওছিলো । বড় দুঃখের বিষয় যে বিশ্বভারতীর কিছু দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়ে কোর্স শেষ না করেই ও দেশে ফিরে গেছে। - আমাদের সময় তোমাদের সঙ্গে ছাত্রছাত্রীদের একটা ঘরোয়া সম্পর্ক ছিল, অনেক সময় রাতের ট্রেন থাকলে তুমি ছাত্রীদের ট্রেনে তুলে দিতে এ কথা আমার মনে আছে। এখন তোমার সাথে ছাত্রদের সম্পর্ক কেমন ?
- সেদিন আর কোথায় গো দিদি ,এখন বিশ্বভারতীর চারিদিকে পাঁচিল উঠে যাবার দরুণ পূর্বপল্লী বয়েজ হোস্টেলের ছেলেরা অনায়াসে আমাদের দোকানে পৌঁছুতে পারে না। চারিদিকে পাঁচিল দিয়ে ঘিরে থাকায় আমাদের দোকানে আসার রাস্তা কমে গেছে , তারফলে,অনেকেই মনে করেন আমাদের দোকান বন্ধ হয়ে গেছে। যারফলে ব্যবসার হালও খারাপ। তখন, বিশ্বভারতীর বিভিন্ন বিভাগে আমাদের দোকান থেকে টিফিন যেত ,মহিলা সমিতি ক্লাবে কোনো মিটিং থাকলে আমরাই জলখাবার করে পাঠাতাম। মেলা এবং বসন্ত উৎসবের সময় তো এতো ভীড় হতো যে আমরা জায়গা দিয়ে উঠতে পারতাম না।
- ‘ঘোষদার দোকান’ নিয়ে তোমার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কি ?
- এই দোকানের বয়স প্রায় পঞ্চাশের কাছে। এতগুলো বছরে শান্তিনিকেতনের চেহারা অনেকটাই পাল্টে গেছে কিন্তু ‘ঘোষদার দোকান ‘ যেমন ছিল তেমনটাই আছে। আমার খুব ইচ্ছে দোকানের ভীতটা একই রকম রেখে এর সাথে আরো আধুনিক সুযোগ সুবিধা যোগ করে একে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। আমাদের এখানে থাকার ব্যবস্থা অনেকদিন ধরেই আছে। সেই ব্যবস্থাই আরো ভালো করে তৈরী করবো। বিশ্বভারতীর প্রাক্তন ছাত্রছাত্রীরা প্রায়ই এখানে আসে তাদের সুবিধামতো থাকার বন্দোবস্ত করার ইচ্ছে।
জানিনা কতদূর আমি এই ইচ্ছা পূরণ করতে পারবো , প্রথমে পাঁচিল , তারপরে করোনা সব ওলোটপালোট করে দিয়েছে।
তোমাদের মতো প্রাক্তনীরা যদি স্বেচ্ছায় এগিয়ে আসে তাহলে আমিও নিশ্চিন্ত হয়ে এগোতে পারবো। বাকিটা ঈশ্বরের হাতে।
সবশেষে, হারুদার বাবার আদর্শ ও স্বপ্নের এই দোকানকে গড়ে তোলার
রহস্যের চাবিকাঠির সন্ধান পেলাম হারুদার মেয়ে রিমার কাছে । বলা হয় ,Behind every successful man there is a woman – রিমার মতে ওর ঠাকুরদাদার এই স্বপ্নপূরণে ঠাকুরমার অবদান অনেকখানি। ছেলে মেয়েদের বড় করার সব কাজ সামলে উনি স্বামীকে সাহায্য করতেন। বাড়িতে মিষ্টি তৈরী করতেন, আবার কখনো মিষ্টির রস আর বাদাম দিয়ে পাটালি বানাতেন। পাড়ার বাচ্চারা দু-পাঁচ পয়সার বিনিময়ে সেই পাটালি কিনে মজা করে খেত। এই সবের পেছনে যে হাড়ভাঙা পরিশ্রম, দিনের শেষের অর্থ উপার্জন সেই কষ্ট মলিন করে দিত।
কালের নিয়মে শান্তিনিকেতন অনেক বদলে গেলেও আমরা চাইব ‘বেঙ্গল সুইট হাউজ’ বা ঘোষদার দোকান’ যেন ঠিক এমনই থাকে।
(শ্রীনাথ মুন্সী , শ্রীমতি শিপ্রা সাই, সবার প্রিয় আনন্দ পাঠশালার মঞ্জুমাসি, অধুনা ছাত্র সপ্তর্ষি সরকার ও প্রাক্তনী সুমনা আজাদ – সকলে পাশে না থাকলে না বেঙ্গালুরুতে বসে শান্তিনিকেতন সম্পর্কে ব্যা আজকের লেখাটি সম্ভব হতো না। জানি, আগামী দিনেও সবাইকে পাশে পাবো। এই অকৃত্রিম ভালোবাসার জন্য আন্তরিক ধন্যবাদ।) - অজন্তাপ্রবাহিতা