ভারত থেকে সমাজ-সভ্যতার লেখক-মেরী খাতুনের লেখা “বিশ্ব নবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)”

336
মেরী খাতুনের লেখা "বিশ্ব নবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)"
"বিশ্ব নবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)"

কলমে:---মেরী খাতুন।

        "জীবে প্রেম করে যেই জন
        সেইজন সেবিছে ঈশ্বর।"
                             ----------বিবেকানন্দ
       "মানব দরদী ধর্মবীর হজরত মুহাম্মদ (সাঃ)"
ধর্মজগতে বিশ্ববাসীর পথ পরিক্রমায় যুগে যুগে,একজন করে মানুষরূপী দেবতা আলোকবর্তিকা হাতে পথপ্রদর্শকের ভূমিকায় মর্ত্যভূমিতে নেমে আসেন।যীশুখ্রিষ্ট,বুদ্ধদেব, চৈতন্যদেব,রামকৃষ্ণ হলেন এরকমই পথপ্রদর্শক।হজরত মুহাম্মদ (সাঃ) তেমনি আর এক অসামান্য দেবদূত যিনি সারা আরবদেশে অধর্মের গ্লানি দূর করে ধর্মসংস্থাপনের ব্রত উদযাপন করেছিলেন।
বিশ্ব নবী (সাঃ) আবির্ভাবের পূর্বে সমগ্র পৃথিবী ছিল অন্ধকারে আচ্ছন্ন। এই অবস্থায় একজন ত্রানকর্তার আবির্ভাব যেন অবশ্যম্ভবী হয়ে পড়েছিল।যিনি অমানিশার আঁধার বিদীর্ণ করে জ্বালবেন মুক্তির আলো।
এই অন্ধকার দূর করতে দুনিয়ার বুকে দুনিয়ারই মুক্তির আলোকবার্তা নিয়ে পৃথিবীতে এলেন নিখিলের চির সুন্দর সৃষ্টি মুহাম্মদ (সাঃ)। মা আমিনার কোলে নেমে এলেন বেহেশতের আলো শিশু মুহাম্মদ। আঁধারে ঢাকা পৃথিবী আলোয় ঝলমল করে উঠল। সমগ্র সৃষ্টি জগতে যেন বয়ে গেল আনন্দের ধারা।
হজরত মুহাম্মদের (সাঃ) এর জন্ম ৫৭০ খ্রিস্টাব্দে ২৯শে আগস্ট ১২ই রবিউল আউয়াল মাসের সোমবার মক্কা নগরীর বুকে জন্ম নিলেন সারাজাহানের নবী। তিনি যে বংশে জন্ম নিলেন সে বংশের নাম কোরেশ বংশ।তখনকার দিনে মক্কার কোরেশ বংশ আরবের সর্বাপেক্ষা সম্ভ্রান্ত বংশরূপে পরিচিত ছিল।তাঁর পিতার নাম আবদুল্লাহ্ এবং মাতার নাম আমিনা।
তিনি যে সময় জন্মগ্রহণ করেছিলেন সে সময় আরবের তো বটেই তদুপরি পৃথিবীর অন্যান্য দেশের অবস্থাও খুব ভালো ছিল না।গোটা আরব দেশটা তখন পাপে পরিপূর্ণ ছিল। মদ্যপান,জুয়াখেলা,ব্যভিচার তখনকার মানুষের নিত্য সহচর ছিল। ন্যায় বিচার বলে কিছু ছিল না। জোর যার মুলুক তার এই ছিল তখনকার রীতি। বড়লোকেরা সুদ খেত।ঠিক সময়ে সুদ দিতে না পারলে যারা ঋণী ব্যক্তি তাদের কঠোর শাস্তি ভোগ করতে হত।নারী জাতির অবস্থা ছিল আরও শোচনীয়। নারী জাতির ছিল না কোন সম্মান। গৃহপালিত পশুর মত আচরণ করা হত নারীদের সাথে।সদ্যজাত মেয়ে-সন্তানকে মাটিতে পুঁতে ফেলা হত।দেশে কোন রাজনৈতিক ঐক্য ছিল না। লোকেরা হাজার গোত্রে বিভক্ত ছিল।এক গোত্রের সঙ্গে অন্য গোত্রের সদ্ভাব ছিল না। প্রত্যেকেই নিজেকে  অপর অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ মনে করত।সামান্য বিষয়কে কেন্দ্র করে একে অপরের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করত।এই সময় পশুপাখি এমনকি পাথর পূজোর প্রচলন ছিল।এককথায় আরব দেশটা তখন নরক অপেক্ষা ভয়ঙ্কর আর নোংরামীতে পরিপূর্ণ ছিল।

মুহাম্মদ (সাঃ)-এর দাদুর নাম ছিল আব্দুল মোত্তালেব।সদ্যজাত মুহম্মদের অনিন্দ্যসুন্দর মুখখানি যখন তাঁর চোখে উদ্ভাসিত হয়ে উঠল,তখন তিনি যেন বেহেশতের চাঁদ দর্শনে আনন্দে অধীর হয়ে উঠলেন। তিনি আদর করে নাতির নামকরণ করলেন 'মুহাম্মদ'।মুহাম্মদ শব্দের অর্থ চরম প্রশংসিত।মা আমিনা রাখলেন 'আহম্মদ'।আহম্মদ শব্দের অর্থ চরম প্রশংসাকারী।পরবর্তী যুগে উভয় নামই তাঁর সার্থক হয়েছিল। বিশ্বের নবী হিসাবে একদিকে যেমন তিনি বিশ্বজনের কাছ থেকে ভুরি ভুরি প্রশংসা লাভ করেছিলেন, অপরদিকে তেমনি তিনি করুণাময় আল্লাহ্তায়ালার প্রশংসায় সমস্ত মন-প্রাণকে উৎসর্গ করেছিলেন।

তখনকার দিনে আরবের অভিজাত পরিবারে সেই যুগে শিশুর মা শিশুকে দুগ্ধ পান করাতো না।ধাত্রীগণ তাদের বুকের দুধ পান করাতো এবং লালন-পালন করতো।কিন্তু মহম্মদকে  সর্বপ্রথম মা আমিনাই দুগ্ধ পান করান।তবে রীতি অনুযায়ী শিশু মহম্মদ ধাত্রী অর্থাৎ দুধ মা হালিমার কাছে পালিত হতে থাকলেন। শিশু মুহাম্মদের ধাত্রী হালিমার ঘরে আগমন হওয়ার পর থেকেই ইলাহি বরকতের জোয়ার শুরু হল।দুবছর দুগ্ধ পানের পর বিবি হালিমা শিশু মুহাম্মদকে নিয়ে তাঁর মায়ের কাছে ফেরত দিতে আসেন,এবং সাথে সাথে এই আকাঙ্ক্ষও ব্যক্ত  করেন যে, মুহাম্মদকে আরো কিছুদিনের জন্য তাঁর কাছে যেন থাকতে দেওয়া হয়। এদিকে মক্কায় তখন মহামারী চলছিল। উভয় দিক চিন্তা করে মা আমিনা শিশুপুত্রকে হালিমার কাছে ফিরিয়ে দেন।এই সময় শিশু মুহাম্মদ হালিমার ছেলেদের সঙ্গে খেলাধূলা এবং ছাগল চরাতে পাহাড়ের কোলে যেতেন।এইভাবে পাঁচ বছর শিশু মহম্মদ ধাত্রী মা হালিমার কাছে পালিত হওয়ার পর মা আমিনাকে ফিরিয়ে দেন।
ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর একাধারে পাঁচ বছর ধাত্রী মা হালিমার কোলে পালিত হওয়ার কারণে মুহাম্মদ মাতৃস্নেহ হতে দূরে থাকলেন। অবশ্য ধাত্রী মা হালিমা তাঁকে নিজ পুত্রের মত মায়া-মমতা দ্বারা সিক্ত করেছিলেন। শিশু মহানবীও তাঁর সেই স্নেহ-আদর ও যত্নের কথা জীবনে কোন দিন ভুলেননি; বরং তাঁকে মাতৃজ্ঞানেই ভক্তি-শ্রদ্ধা করেছিলেন।

পিতা আবদুল্লাহ্ শিশুপুত্র মুহাম্মদ (সাঃ)-এর জন্মের আগেই মারা গিয়েছিলেন মদিনায়।পুত্রকে নিয়ে মা আমিনা স্বামীর কবর জিয়ারত করতে গেলেন মদিনায়। সেখান থেকে ফেরার পথে মাঝরাস্তায় মা আমিনা গুরুত্বর অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং মা আমিনাও মারা যান। এইভাবে কেবল ছ বছর বয়সেই মাতা-পিতা উভয়কেই হারিয়ে সারা জাহানের এতিমের বন্ধু নিজেই এতিম হয়েছিলেন।
এরপর শিশু মুহাম্মদ (সাঃ)-এর লালন-পালনের ভার পড়ল দাদু আব্দুল মোত্তালেবের ওপর।কিছুদিন পর তিনিও দুনিয়ার মায়া কাটিয়ে পরলোক গমন করলেন। এবার তাঁর প্রতিপালনের ভার পড়ল চাচা আবুতালেবের ওপর।আবুতালেব এতিম ভাইপোকে নিজের ছেলের মতই ভালোবাসতেন ও স্নেহ করতেন। পেশাতে তিনি ছিলেন ব্যবসায়ী। ব্যবসা উপলক্ষে মাঝে মাঝে তিনি মক্কার বাইরে বিভিন্ন দেশ-বিদেশে যাতায়াত করতেন। কখনও কখনও কিশোর মুহাম্মদ (সাঃ)-ও তাঁর সঙ্গী হতেন।এই সময়ে একের পর এক বিচিত্র দেশ,শহর, নগর, গাছপালা ও নদনদী তাঁর চোখের ওপর পটের ন্যায় ভেসে উঠতে লাগল।এইভাবে চাচার সহচর্যেই বাইরের জগতের সঙ্গে তাঁর পরিচয় ঘটে।

সেকালে মক্কার অনতিদূরে 'ওকাজ' নামক স্থানে একটি মেলা বসত। সেখানে নানা দেশের নানা জিনিস আমদানি হত।দেশ-বিদেশ থেকে বিভিন্ন লোকজন আসত ব্যবসা উপলক্ষে। আরবের লোকেরা ছিল খুব কাব্যপ্রিয়।তারা কাব্য লিখতে ও শুনতে ভালোবাসত।মাঝে মাঝে কবিদের মধ্যে লড়াই চলত।একদিন এই কবির লড়াইকে কেন্দ্র করে পরস্পর পরস্পরের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল।বহুদিন এই লড়াই বা যুদ্ধ চলল।মুহাম্মদ (সাঃ) তখন যুবক। তিনিও চাচার সঙ্গে এই যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। কিন্তু যুদ্ধ শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গে তাঁর একটা বিরাট পরিবর্তন দেখা দিল।যুদ্ধে হাজার হাজার লোকের মৃত্যু ও অসহায় নর-নারীর আকাশভেদী কান্না তাঁর হৃদয়কে গভীর বেদনায় ভরিয়ে তুলল।

তিনি যুদ্ধে হতাহত ব্যক্তিদের সেবার জন্য ' হিলফুল ফজুল' নামে একটি সমিতি গঠন করলেন।' হিলফুল ফজুল' শব্দের অর্থ কল্যাণ বা সেবা সংগঠন। এই সেবা সংঘ তাঁর অসাধারণ সংগঠনী শক্তিরই পরিচয়।

বাল্যকাল থেকেই মুহাম্মদ (সাঃ) ছিলেন শান্ত,নম্র-ভদ্র,ও সৎচরিত্রবান। কোন ভয় বা লোভের বশবর্তী হয়ে তিনি জীবনে কখনো মিথ্যা কথা বলতেন না। আরববাসীরা তাঁর সততাও মধুর ব্যবহারে মুগ্ধ হয়ে তাঁর নাম দিয়েছিলেন 'আল-আমিন'।'আল-আমিন' কথার অর্থ বিশ্বাসী। বাল্যকাল থেকেই তিনি অত্যন্ত পরিশ্রমী এবং কর্তব্যনিষ্ঠ ছিলেন।

এই সময় মক্কায় একজন সম্ভ্রান্ত বিধবা বাস করতেন। তাঁর নাম খাদিজা।তিনি খুব উন্নত চরিত্রের অধিকারী ছিলেন। এই জন্য লোকে তাঁকে তাহেরা বলে ডাকতেন। 'তাহেরা' শব্দের অর্থ পবিত্র আত্মা।তিনি ছিলেন অগাধ ধন-সম্পত্তির মালিক। দেশ-বিদেশে তাঁর ব্যবসা ছিল।ঠিকভাবে ব্যবসা চালানোর জন্য প্রয়োজন একজন বিশ্বাসী লোকের। তিনি একজন বিশ্বাসী লোকের সন্ধান করছিলেন। এমন সময় আল-আমিনের কথা তাঁর কানে পৌঁচ্ছাল। তিনি তাঁকে ডাকলেন,এবং যাবতীয় বৃত্তান্ত খুলে বললেন। তিনি চাচার অনুমতি নিয়ে খাদিজার ব্যবসা পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করতে রাজী হলেন। অল্পদিনের মধ্যে প্রচুর লাভ দেখে খাদিজার হৃদয় আনন্দে নেচে উঠল।তিনি  মুহাম্মদ (সাঃ)-এর ব্যবহার ও কর্মদক্ষতায় ভীষণ খুশি হলেন।চাচা আবুতালেবের সম্মতিক্রমে চল্লিশ বছরের বিধবা খাদিজার সঙ্গে পঁচিশ বছরের যুবক মুহাম্মদের বিবাহ হয়।তাঁদের এই মিলন বড় পবিত্র মিলন। 

অগাধ সম্পত্তির অধিকারী হয়েও মুহাম্মদ (সাঃ) নিরাসক্ত ফকিরের ন্যায় জীবন যাপন করতে লাগলেন। এত বড় ত্যাগী পুরুষ শুধু আরবে কেন বিশ্বের ইতিহাসে বিরল।ক্রমে ক্রমে তিনি তিন পুত্র ও চার কন্যার পিতা হন।হজরত মহম্মদ (সাঃ) তৎকালীন সমাজের অধঃগতিতে অত্যন্ত চিন্তিত ছিলেন। মানুষের দুঃখ দেখলে তাঁর হৃদয় কেঁদে উঠত।এই বিরাট সৃষ্টির আড়ালে যে জ্যোতির্ময় সত্তা আছেন, মাঝে মাঝে তিনি হেরা পাহাড়ের গুহায় নির্জনে নিভৃতে ধ্যানে বিভোর হয়ে পড়তেন।এইভাবে দেখতে দেখতে প্রায় পনেরো বছর কেটে গেল। দীর্ঘ পনেরো বছর ধ্যান সাধনার পর ৪০ বছর বয়সে ধ্যানমগ্ন অবস্থায় আল্লাহ্-র প্রেরিত দূত জিবরাইল(আঃ) তাঁর সামনে আবির্ভূত হলেন। সেই নির্জন গুহায় অপরিচিতের রহস্যময় কন্ঠ শুনে তিনি ভয়ে চমকে উঠলেন। জিবরাইল (আঃ) কাছে এসে মুহাম্মদ(সাঃ)-এর কাছে নিজের পরিচয় দিয়ে নুরের অক্ষরে লেখা আল্লাহ্-র বাণী তাঁকে পড়তে বললেন। মুহাম্মদ জানালেন তিনি নিরক্ষর কিছুই পড়তে জানেন না।তখন জিবরাইল তাঁকে বুকে জড়িয়ে ধরে বললেন,পড় তোমার সৃষ্টিকর্তার নাম যিনি তোমাকে সৃষ্টি করেছেন। সৃষ্টি করেছেন মানুষকে রক্তপিন্ড থেকে।
জিবরাইল (আঃ) অদৃশ্য হলে মহম্মদ (সাঃ) কাঁপতে কাঁপতে ঘরে ফিরে এলেন এবং বিবি খাদিজাকে বললেন তাঁকে চাদর দিয়ে ঢেকে দিতে।কিছুক্ষণ পর স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে এলে তিনি খাদিজাকে সমস্ত ব্যাপার খুলে বললেন। খাদিজা শুনেই সঙ্গে সঙ্গে " লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ.....(এর অর্থ আল্লাহ্ এক এবং অদ্বিতীয় এবং মুহাম্মদ আল্লাহ্ প্রেরিত রসুল।)বলে স্বামীর সদ্য প্রচারিত ধর্ম  গ্রহণ করলেন। এরপর একে একে কয়েকজন ঘনিষ্ঠ আত্মীয় এই পবিত্র ধর্ম গ্রহণ করলেন। তিন বছর তিনি এইভাবে গোপনে ইসলাম ধর্ম প্রচার করতে লাগলেন।

চতুর্থ বছর তিনি প্রকাশ্যে ইসলাম প্রচারে নামলেন। ফলে মক্কাবাসীরা তাঁর বিরুদ্ধে মাথা তুলে দাঁড়াল।তারা প্রথমে তাঁকে বিদ্রুপ করল,গালাগালি করল।শেষ পর্যন্ত কিছুতেই তাঁকে নিরস্ত্র করতে না পেরে তাঁর ওপর দৈহিক নির্যাতন শুরু করে দিল।তারা তাঁকে পাথর ছুঁড়ে মারল,পথে কাঁটা বিছিয়ে দিল,নামাজ পড়ার সময় মাথার ওপর উটের দুর্গন্ধ নাড়ী-ভুঁড়ি চাপিয়ে দিল,শিষ্যদের গায়ের চামড়া ছাড়িয়ে নুন মাখিয়ে দিল,কিন্তু তবুও তিনি থামলেন না।তিনি খোদার দেওয়া শক্তিতে বলীয়ান। জগতের সব শক্তি তাঁর কাছে তুচ্ছ। আশ্চর্য তিনি কিন্তু কারো প্রতি রুষ্ট হলেন না বরং পরম বন্ধুর ন্যায় সকলের সেবা করে যেতে লাগলেন। তাঁকেই পাথর ছুঁড়ে মারতে এসে যে লোকটা মরতে বসল,তিনি তাকে সেবা করে বাঁচিয়ে তুললেন। যে বৃদ্ধা তাঁর চলার পথে প্রতিদিন বিষমাখা কাঁটা বিছিয়ে দিত,তার রোগশয্যায় তিনি নিজে গিয়ে তাঁর মলমূত্র পর্যন্ত পরিষ্কার করে দিলেন, এবং সেবা-শুশ্রূষা করে সুস্থ করে তুললেন। তাঁর এই মহত্ত্বে মুগ্ধ হয়ে দলে দলে লোক ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করতে লাগল।

এইভাবে দীর্ঘ তের বছর অত্যাচার করেও যখন মক্কাবাসীরা তাঁর কিছু করতে পারল না, তখন গোপন হত্যা করার জন্য ষড়যন্ত্র করতে লাগল। এই সংবাদ পেয়ে মুহাম্মদ (সাঃ) তাঁর কয়েকজন বিশ্বস্ত অনুচর ও প্রিয়তম শিষ্য আবুবকরকে নিয়ে জন্মভূমি মক্কানগরী ত্যাগ করে মদিনার পথে যাত্রা করলেন। এই ঘটনাকে 'হিজরত' বলে।মদিনাবাসীরা নবীকে পরম সমাদরের সঙ্গে গ্রহণ করলেন। তারা হাসিমুখে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করলেন এবং তাঁর নাম অনুসারে ঐ শহরের নাম রাখলেন 'মদিনাতুন নবী' অর্থাৎ নবীর নগর। তিনি মদিনাকে ইসলামী রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেন। এই হিজরতের দিন থেকেই মুসলমানরা হিজরী সাল গননা শুরু করেন।

সমগ্র বিশ্বে ইসলাম ধর্ম প্রচার ও প্রসারের জন্য শান্তির নবীকেও যুদ্ধ করতে হয়েছে। যুদ্ধের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল বদর,উহুদ,খাইবার,তায়িফ,হুনাইন,আহযাব প্রভৃতি। ৬৩০ খ্রিস্টাব্দে সম্পূর্ণ বিনা রক্তপাতে মুহাম্মদ (সাঃ) মক্কা জয় করেন। পৃথিবীর ইতিহাসে এমন রক্তপাতহীন নিরঙ্কুশ বিজয় আর দ্বিতীয় নেই।

মহানবী প্রচারিত ধর্মের নাম ইসলাম ।

ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভ---(১) পাঁচ ওয়াক্ত কালিমা,(২) পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ, (৩) রোজা,(৪) হজ ও (৫) জাকাত।এই পাঁচটি নির্দেশ অবশ্যই মানতে হবে।

চরম অরাজক সমাজে তাঁর ধর্ম শান্তির দূত হয়ে সমাজটাকে বদলে দেয়। নিষ্ঠুর মানুষগুলোর মাঝে মানবীয় মূল্যবোধ জাগ্রত হয়। তিনি মদ্যপান,কন্যা-সন্তান হত্যা, ব্যাভিচার প্রভৃতি সামাজিক অনাচার নিষিদ্ধ করলেন। ক্রীতদাস প্রথাকে বিলুপ্ত করে জায়েদ নামে একজন ক্রীতদাসকে সকলের সামনে নিজের পুত্ররূপে গ্রহণ করেন।নারীদের মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হয়। নারীরা কন্যা হিসেবে, স্ত্রী হিসেবে এবং মাতা হিসেবে যথাযথ মর্যাদায় অধিষ্ঠিত হন।

সুদ ও সর্বপ্রকার অর্থনৈতিক শোষণকে হারাম অর্থাৎ সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করলেন।শুধু তাই নয় ,ধনী ও দরিদ্রের ধনবৈষম্য দূর করার জন্য ধনীদের ওপর শতকরা আড়াই টাকা হিসেবে জাকাত দেবার নির্দেশ দিলেন। এই নির্দেশ ফরজ বা নামাজ রোজার ন্যায় অবশ্য পালনীয় রূপে গণ্য করা হল।ফেৎরা ও বিভিন্ন প্রকার দান খয়রাতের ব্যবস্থা করে দরিদ্রের প্রতি ধনীদের হৃদয়হীনতা অবসান ঘটাবার জন্য তিনি চেষ্টা করলেন।শ্রমিকদের গায়ের ঘাম শুকিয়ে যাবার আগেই তার ন্যায্য প্রাপ্য মিটিয়ে দেবার নির্দেশ দিলেন। জিনিষপত্রের মূল্য যাতে বাজারে বৃদ্ধি না পায় সেজন্য তিনি যে কোন প্রকার মালকে মজুত রাখা(৪০ দিনের বেশি) নিষিদ্ধ ঘোষণা করলেন। ব্যবসাক্ষেত্রে জিনিসপত্রে ভেজাল দেওয়া ও ওজনে কম দেওয়াকে কঠোর শাস্তিযোগ্য অপরাধ বলে ঘোষণা করলেন। ঘুষ,ফাঁকি ও প্রতারণাকে মহাপাপ বলে ঘোষণা করলেন।

আরবের লোক যখন দলে দলে এসে তাঁর ধর্ম গ্রহণ করতে লাগল, হজরত মুহাম্মদ (সাঃ) মনে করলেন এবার তাঁর কাজ সম্পূর্ণ হয়েছে এবং শেষ হয়ে আসছে ইহজীবন----এই ধারনায় তিনি মনস্থির করলেন মক্কায় গিয়ে বিদায় হজ্জ উদযাপন করবেন। ২৫ জুলকাদ(২৩শে ফেব্রুয়ারি ৬৩২ খ্রিস্টাব্দে) বহু সংখ্যক মুসলমানদের সঙ্গে নিয়ে  নবী মুহাম্মদ (সাঃ) মদিনা ত্যাগ করলেন। জুলহজ্জ ৭-ই মার্চ মক্কায় পৌচ্ছে হজের আচার-অনুষ্ঠান সম্পূর্ণ করার আগে জনতার উদ্দেশে জবল উল আরাফতের (আরাফত পাহাড়) চূড়ায় দাঁড়িয়ে তিনি যে ভাষন দিলেন তা এখনো সমস্ত মুসলমানের অন্তরে অক্ষয় হয়ে আছে।
হে জনগণ!আমার কথা শোন এবং তা উপলব্ধি কর।
অন্যায় আচরণ থেকে নিজেদের বিরত কর।স্ত্রীর ওপর তোমাদের অধিকার আছে এবং তোমাদের ওপর রয়েছে স্ত্রীদের অধিকার। স্ত্রীদের প্রতি সদয় ব্যবহার করো।আর তোমাদের দাসদাসী, লক্ষ্য রেখো, তাদের এ রকম খাবার দাও,যে রকম খাদ্য তোমরা নিজে আহার কর। তোমরা যে পোশাক পরো তাদেরকেও সেই পোশাক পরিধান করাবে,আর যদি তারা এমন কোন অপরাধ করে যা তোমরা ক্ষমা করতে পারবে না, তাহলে তাদের ছেড়ে দাও কারণ তারাও আল্লাহ্ পাকের সেবক এবং রূঢ় ব্যবহার পাওয়ার যোগ্য নয়।

বিদায় হজ্জের পর মহানবী বাড়ি ফিরলেন। বাড়ি ফেরার কিছুদিন পর মহানবী জ্বরে আক্রান্ত হন।অসুস্থ অবস্থাতেও তিনি এগারো দিন নামাজের ইমামতি করেন।অবশেষে ১১ হিজরি সালের ১২-ই রবিউল আউয়াল মাসের সোমবার সন্ধ্যায় ৬৩ বছর বয়সে তিনি মহান প্রতিপালনের সানিদ্ধে চলে যান ( পরলোক গমন করেন)।

মহানবী (সাঃ) ছিলেন মানবজাতির অনুকরণীয় ও অনুসরণীয় উত্তম চরিত্র ও মহানুভবতার একমাত্র আঁধার।তিনি ছিলেন একাধারে সমাজ সংস্কারক, ন্যায় বিচারক,বীরযোদ্ধা, যোগ্য রাষ্ট্রনায়ক, দক্ষ শাসক এবং সফল ধর্মপ্রচারক।সকল ক্ষেত্রে মানবজাতির জন্য তিনি ছিলেন সর্বোত্তম আদর্শ।

গোটা বিশ্বের মানবজাতি তথা শ্রেষ্ঠ চিন্তাবিদ, দার্শনিক, কবি সাহিত্যিক, বৈজ্ঞানিক ব্যক্তিরা তাঁর সত্য-সুন্দর আদর্শের প্রতি গভীর আস্থা ও বিশ্বাস স্থাপন করেছেন। গভীর শ্রদ্ধা জানিয়েছেন বিভিন্ন লেখা ও বর্ণনায়। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, মহাত্মা গান্ধী, গুরু নানক,সরোজিনী নাইডু, মাইকেল হার্ট,নেপোলিয়ান বোনাপার্ট  প্রমুখ মনীষীর রচনা, বর্ণনা ও বাণীতে  মহানবী (সাঃ) সম্পর্কে তাঁদের ভক্তি-শ্রদ্ধার নিদর্শন খুঁজে পাই।

             "কোথায় স্বর্গ, কোথায় নরক কে বলে তা বহুদূর?
        মানুষেরি মাঝে স্বর্গ-নরক,মানুষেতে সরাসুর।"
                                      ------কবি শেখ ফজলুল করিম।

বিদ্র:---মহানবী হজরত মুহাম্মদের নাম নেওয়ার পর "সাল্লাল্লাহু অলাহি ওয়া সালাম" উচ্চারণ করতে হয়।আর লেখার সময় সংক্ষেপে (সাঃ) লেখা হয়ে থাকে।অনেকের হয়ত এটা নিয়ে জিজ্ঞাসা থাকতে পারে তাই লিখলাম।
>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>><<<<<

@Copy right মেরী খাতুন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here