পিঁয়াজের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি : উৎকন্ঠিত জনগণ
হাসানুজ্জামান
হঠাৎ করেই পিঁয়াজের মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে। তিনদিন আগেও পিঁয়াজের মূল্য ছিল কেজিপ্রতি ৫০ থেকে ৫৫ টাকা । বর্তমানে খুচরা বাজারে ১০০ থেকে ১২০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। পিঁয়াজের এই অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধিতে আমজনতার মাঝে উদ্বেগ ও উৎকন্ঠা তৈরী হয়েছে।
উপমহাদেশে পিঁয়াজের গুরুত্ব অনেক বেশী। মসলা হিসাবে তরিতরকারীতে পিঁয়াজের ব্যবহার আদিকাল থেকে হয়ে আসছে। সুস্বাদু তরিতরকারী রান্নাতে একটি প্রয়োজনীয় উপাদান হিসাবে পিঁয়াজ ব্যবহার হয়ে থাকে। ফলে পিঁয়াজের ব্যবহার বন্ধ করা এখন আর সম্ভব নয়। বাংলাদেশে প্রতিবছর ৩০ থেকে ৩২ লক্ষ টন পিঁয়াজের প্রয়োজন হয়। তার মধ্যে দেশে উৎপাদন হয় ২৩ লক্ষ টন। অবশিষ্ঠ ৯ লক্ষ টন পিঁয়াজ বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। বেশ কয়েক বছর থেকে ভারত থেকে পিঁয়াজ আমদানী করে আসছে সরকার। গেল বছর এই সময় আকস্মিকভাবে ভারত পিঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ করে দেয়। বিপদে পড়ে আমাদের সরকার। জরুরি ভিত্তিতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় বিমানে করে পাকিস্থান থেকে পিঁয়াজ নিয়ে আসে। কিন্তু সেই পিঁয়াজ দিয়ে দেশের চাহিদা মেটানো সম্ভব হয়নি। ফলে পিঁয়াজের সংকটে পড়ে জনতার নাভিস্বাস উঠেছিল। নভেম্বরে গিয়ে নতুন পিঁয়াজ উঠলে সেই সংকট এমনিতেই কেটে যায়। পিঁয়াজের জন্য মূলত বাংলাদেশ ভারতের উপর নির্ভরশীল। বর্তমানে কুটনৈতিক দিক দিয়ে বাংলাদেশের সাথে ভারতের সম্পর্ক অনেক ভাল।কিন্তু ভারত আগে ভাগে না জানিয়ে পিঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ করে দিয়ে বাংলাদেশকে বিপদের মধ্যে ফেলে দিয়েছিল। এবারও একই ঘটনারই পুর্নাবৃত্তি ঘটাল ভারত।
কিছুদিন আগেও কলকাতার বাজারে পিঁয়াজ কেনাবেচা হয়েছে ১৫ টাকা কেজি দরে। সেই পিঁয়াজ এখন বিক্রি হচ্ছে ৩০ টাকা কেজিতে। অবশ্য দিল্লীর বাজারে পিঁয়াজের দর আরো বেশী। ভারতের সবজায়গাতেই যে পিঁয়াজ আবাদ হয় তা কিন্তু নয়। মূলত কর্নাটক, মধ্যপ্রদেশ এবং গুজরাটে সর্বাধিক পিঁয়াজ আবাদ হয়। ভারতে উৎপাদিত পিঁয়াজ গুণগত মানের দিক দিয়ে বিশ্বের সেরা। ভারত ছাড়াও তুরস্ক, মিশর, মায়ানমার,পাকিস্তান এবং বাংলাদেশে পিঁয়াজ আবাদ হয়। এই পিঁয়াজ দেশের চাহিদা পূরণ করে বিদেশে রপ্তানি করে ভারত। এবারে ভারতে অতিবৃষ্ঠি, লোকডাউন এবং বর্ষার পানিতে নষ্ঠ হয়ে যাওয়ায় পিঁয়াজের সংকট শুরু হয়েছে। পিঁয়াজের সংকটের সাথে ভারতের রাজনীতির সম্পৃক্ততা রয়েছে। পিঁয়াজের দাম যখন ১০০ থেকে ১২০ টাকা কেজি। সেই সময় দিল্লীতে অনুষ্টিত হয়েছিল নির্বাচন। নির্বাচনে পিঁয়াজের দর ব্যাপক প্রভাব ফেলে। ফলে অরবিন্দ কেজরিওয়ালা সহজেই ক্ষমতাসীনদলকে হারিয়ে বিজয়ের মালা ছিনিয়ে নেয়। সামনে বিহার প্রদেশের নির্বাচন। ফলে এই সময়ে পিঁয়াজের মূল্যবৃদ্ধি নিয়ণÍ্রণে রাখতে না পারলে দিল্লীর নির্বাচনের মতই ভরাডুবির আশংকা করছে বিজিপি সরকার। এই সব বিষয়গুলো পিঁয়াজ রপ্তানি বন্ধের উল্লেখযোগ্য কারণ বলে মনে করা হচ্ছে। শুধু তাই নয় পিঁয়াজের মূল্য নিয়ণÍ্রণে রাখতে ভারতের সরকার পিঁয়াজ আমাদানি করার কথাও ভাবছে। কিন্তু ভারতের পিঁয়াজ ব্যবসায়ি কোলকাতার জয়ন্ত ঘোষ এবং দিল্লীর বিনিত দাশ সরকারের এই নীতির সমালোচনা করেছে। তাদের দৃষ্টিতে পিঁয়াজ রপ্তানি বন্ধের সিদ্ধান্তে পিঁয়াজ আবাদকারি এবং ব্যবসায়িকরা ক্ষতির সন্মুখিন হবে। এদিকে আমাদের দেশের মধ্যে কথা উঠেছে ভারতের একতরফা পিঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ নিয়ে। বন্ধু প্রতিম এই দেশটাকে আগে থেকে জানালে সরকার আগেভাগে অন্যদেশ থেকে পিঁয়াজ আমাদানির প্রস্তুতি নিতে পারতো। ফলে সরকারের পক্ষে পিঁয়াজের দাম নিয়ণÍ্রণে রাখা সহজ হতো। কিন্তু এখন অবস্থা বেগতিক হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বিজিপি সরকার বাংলাদেশে গরু রপ্তানি বন্ধ করে দেয়। ফলে দেশে কোরবানির গরুর সংকট এবং দ্রুতই মাংসের মূল্যবৃদ্ধি ঘটে। পরবর্তীতে সরকারের সহযোগিতায় দেশের বেকার যুবকরা গরুর খামার গড়ে তোলে। তাতে দেশে মাংসের সংকট দূর হয় এবং কোরবানির গরু ক্রয়ক্ষমতার নাগালে চলে আসে। দেশে ২৩ লক্ষ টন পিঁয়াজ উৎপাদিত হলেও প্রায় ৫ লক্ষ টন পিঁয়াজ সংরক্ষণের অভাবে নষ্ঠ হয়ে যায়। আলু সংরক্ষণের জন্য কোল্ড ষ্টোর তৈরী হওয়ায় আলুর মূল্য এখন আর আগের মত উঠানামা করে না। কিন্তু পিঁয়াজ সংরক্ষণের ব্যবস্থা না থাকায় দেশে উৎপাদিত পিঁয়াজের একটি অংশ নষ্ঠ হয়ে যাচ্ছে। বিষয়টি নিয়ে কৃষিমন্ত্রণালয়ের ভাবার সময় এসেছে। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনষ্টিটিউট ইতোমধ্যে বারমাসি পিঁয়াজ আবাদে সফলতা এনেছে। তারা বছরে ৭ লক্ষ টন পিঁয়াজ আবাদের লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে এগিয়ে চলেছে। কিন্তু তাদের এই সফলতা এখনও কৃষকদের দ্বারগোড়ায় পৌঁছেনি। সবঠিকঠাক থাকলে আগামীতে ভাল কিছু হতে পারে।
আমাদের দেশের ব্যবসায়িকদের গুদামে অনেক পিঁয়াজ সংরক্ষিত রয়েছে। গেল রবিবার ভারতের আমদানি বন্ধের খবরের সাথে সাথে তারা বেশি মুনাফার লোভে পিঁয়াজের মূল্য বাড়িয়ে দিয়েছে। এ ক্ষেত্রে সরকারের কঠোর ভ’মিকা দরকার। বাজার মনিটরিং বৃদ্ধি করলে কিছুটা হলেও সাধারণ জনগণ স্বস্থির নিঃশ্বাস ফেলবে।
লেখক ঃ সাংবাদিক ও গবেষক। ০১৭১১-১০৮৭৩৬