ভারত চীন যুদ্ধ কি আসন্ন ?
হাসানুজ্জামান
ভারত ও চীনের মধ্যে যুদ্ধ কি আসন্ন এ প্রশ্ন সম্প্রতি ভাবিয়ে তুলেছে বিশ্ববাসীকে। লাদায়েক সীমান্তের নিয়ণÍ্রণরেখা নিয়ে পরমাণুশক্তিধর এই দুটি রাষ্ট্রের মধ্যে উত্তেজনা বেশ উদ্বেগ ও উৎকন্ঠার সৃষ্ঠি করেছে। ২০ জন ভারতীয় জওয়ানের হতাহতের মধ্যদিয়ে এই উত্তেজনা এখন যুদ্ধের দিকে ধাবিত হচ্ছে বলে মনে হচ্ছে। একদিকে করোনা মোকাবেলায় হিমশিম খাচ্ছে ভারত। তার উপর সীমান্ত উত্তেজনা ভারতকে বাড়তি টেনশনে ফেলে দিয়েছে। চীনের সাথে সাথে নেপাল তার দেশের মানচিত্রকে বর্ধিত করে নতুন মানচিত্র তৈরী করে তাদের রাজ্যসভায় সেটা পাশ করিয়ে নিয়েছে। সেখানে তারা ভারতের মধ্যকার কিছু স্থান তাদের বলে দাবী করে আসছে। এদিক দিয়ে ভারতের দীর্ঘদিনের শত্রু পাকিস্থানও বসে নাই। কাশ্মীরকে নিয়ে ভারতের সাথে পাকিস্থানের দীর্ঘদিনের বৈরিতা পুনরায় নতুন করে দৃশ্যপট ঘটছে বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন। বিশ্বরাজনীতিতে চীনের নতুন দাপটের সম্ভাবনাকে আমেরিকা,অস্ট্রেলিয়া বাঁকা চোখে দেখে আসছে। ভারত-চীনের এই যুদ্ধাবস্থায় ভারতের প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে পাকিস্থান ও নেপাল তাদের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে। তবে বাংলাদেশ এখনও সেই ভাবে কোন প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেনি। পররাষ্ট্রমন্ত্রী আকার ইঙ্গিতে বাংলাদেশের স্বাধীনতায় ভারতের সমর্থনের কথা উল্লেখ করে তাদের প্রতি বাংলাদেশের বিশেষ দূর্বলতার কথা বলে আসছেন।
গেল ১৫ জুন ভারত-চীন সীমান্তের লাদাখের গলওয়ান উপত্যকায় দু’দেশের জওয়ানদের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। এই সংঘর্ষে ভারতের একজন কর্নেলসহ ২০ জন জওয়ান নিহত হয়। ১৬ জুন প্রথমে খবর আসে ভারতের তিন জন মারা গেছে। কিন্তুতে পরবর্তীতে মৃত্যুর সঠিক চিত্র আর্ন্তজাতিক মিডিয়ায় আসে। তাতে দেখা গেছে মারা যাওয়ার সংখ্যা তিন জন নয় ২০ জন, তাদের মধ্যে একজন কর্নেল রয়েছে। । আহত হয়েছে ৭৬ জন জওয়ান। চীনা ড্রাগন আটককৃত ভারতীয় ২ জন অফিসারসহ ১০ জন জওয়ানকে ফিরত দিয়েছে চীন। অপরদিকে চীনের হতাহতের কোন খবর পাওয়া যায়নি। তারা ভারতের সাথে সংঘর্ষের কথা স্বীকার করলেও নিজেদের কত জন সৈন্য হতাহত হয়েছে তা উল্লেখ করেনি বা বলেনি। তারা বিষয়টি গোপন রেখেছে। চীনের কোন পত্র-পত্রিকা বা মিডিয়াতে অথবা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও হতাহতের এ ঘটনা আসেনি। চীনের পিপলস লিবারেশন আর্মি ( পিএলএ) এর মুখপাত্র কর্নেল ঝাংশুইলি বলেছেন- ‘ গলওয়ান উপত্যকায় সংঘর্ষে দুই পক্ষেরই হতাহত হয়েছে। কিন্তু চীনের কতজন হতাহত হয়েছে তা তিনি জানাননি।’ চীন বরাবরই সীমান্তে সংঘর্ষে তাদের হতাহতের খবর গোপন রেখে আসছে। ১৯৬২ সালের ভারতের সাথে সীমান্ত সংঘর্ষে চীন তাদের জওয়ানদের হতাহতের খবর প্রকাশ করেনি। তবে আর্ন্তজাতিক বেশ কয়েকটি মিডিয়া থেকে জানা গেছে- চীনের সর্বমোট ৪৩ জন জওয়ান হতাহত হয়েছে। তবে এ হতাহত ঘটনার কোন সত্যতা পাওয়া যায়নি।
সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১৪,০০০ ফুট উপরে লাদাখের এই গলওয়ান উপত্যকা অবস্থিত। নীচে গলওয়ান নদী। এখানকার তাপমাত্রা হিমাঙ্কের নীচে। বৈরী এই আবহাওয়ায় এখানে মানুষের স্বাভাবিক চলাচলে বিঘ্ন ঘটে। এই অবস্থায় সেখানে ভারতীয় জওয়ানদের সাথে চীনের জওয়ানদের সংঘর্ষ হয়। এই সংঘর্ষে কোন পক্ষই ¯য়^ংক্রিয় অস্ত্র ব্যবহার করেনি। তবে পেরেক লাগানো রড ব্যবহার হরা হয়েছে এই সংঘর্ষে। পিটিয়ে হত্যা করা হয় একে অপরকে। যা মধ্যযুগীয় বর্বরতাকেও হার মানিয়েছে। ভারতীয় কিছু জওয়ান সংঘর্ষের সময়ে উপত্যকা থেকে গলওয়ান নদীতে পড়ে গিয়ে মারা যায়। উল্লেখ্য যে, ১৯৯৬ সালে ভারত-চীনের মধ্যকার চুক্তি অনুযায়ী কোন পক্ষই সীমান্ত এলাকার ২ কিলোমিটারের মধ্যে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র ব্যবহার করতে পারবে না।
চীন হঠাৎ করেই ভারতের উপর কেন এতো ক্ষিপ্ত হলো এ নিয়ে আর্ন্তজাতিক পরিমন্ডলে ব্যাপক আলোচনা শুরু হয়েছে। ভারত এক সময় বিশ্বের দুটি পরাশক্তির একটি রাশিয়ার ব্লকেই ছিল। কিন্তু বিশ্ব রাজনীতিতে রাশিয়ার প্রভাব কমে যাওয়ায় বর্তমানে একক ও বৃহত্তর শক্তিশালী রাষ্ট্র আমেরিকা ব্লকে প্রবেশ করে। সম্প্রতি ভারত ,জাপান,যুক্তরাষ্ট্র ও ফিলিপাইনের সাথে সম্মিলিতভাবে নৌমহড়ায় অংশ নেয়। যেটা অনুষ্ঠিত হয়েছে বিরোধপূর্ণ দক্ষিণ চীন সাগরে। ১৯১৯ সালে অনুষ্ঠিত এই মহড়ার পর চীন সতর্ক হয় ভারতের বিষয়ে। এদিকে ভারত কয়েক সপ্তাহ আগে অস্ট্রেলিয়ার সাথে মিউচুয়াল লজিষ্টিক সাপোর্ট অ্যাগ্রিমেন্ট করেছে। এই চুক্তির আওতায় দুই দেশ তার নৌঘাটি বিভিন্ন সামরিক কারণে ব্যবহার করতে পারবে। অস্ট্রেলিয়ার সাথেও চীনের বিরোধ রয়েছে। কোভিড-১৯ ছড়ানোর দায়ে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সুর মিলিয়ে চীনের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে অস্ট্রেলিয়া।এদিকে ভারতের সংবিধানের ৩৭০ ধারা বাতিল এবং কাশ্মীর ও লাদাখ অজ্ঞলকে আলাদা করে ইউনিয়ন টেরিটরি ঘোষণা চীনকে ক্ষুব্ধ করে। ভারতের সাথে চীনের সম্পর্কের অবনতির পিছনে এই সব কারণগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভ’মিকা রেখেছে বলে অনেকে মনে করছে।
লাদাখ বা লাদ্বাগস ভারতের একটি কেন্দ্র শাসিত অজ্ঞল। যার উত্তরে কুনলুন এবং দক্ষিণে হিমালয় পর্বত অবস্থিত। ইন্দো- আর্য এবং তিব্বতী বংশোদ্ভুত ঐতিহাসিকভাবে বালটিস্তান উপত্যকা, সিন্ধুনদ উপত্যকা, জাংস্কার, ল্হাুল ও স্পিটি, রুদোকও গুজসহ আকসাই চিন এবং নুব্রা উপত্যকা লাদাখের অংশ ছিল। লেহ জেলা ও কার্গিল জেলা নিয়ে লাদাখ গঠিত। তিব্বতী সংস্কৃতির দ্বারা লাদাখ প্রচন্ডভাবে প্রভাবিত বলে এই অজ্ঞলকে ক্ষুদ্র তিব্বতী বলা হয়ে থাকে।
১৯৪৭ সালে ভারত স্বাধীন হলে কাশ্মীরের ডোগরা শাসক হরিসিং অর্ন্তভুক্তির চুক্তিতে সই করে কাশ্মীর রাজ্যকে ভারতের কাছে দিয়ে দেয়। এ সময় পাকিস্থানী সেনাবাহিনী লাদাখ ও কাশ্মীরের অন্যান্য অংশ দখল করে নেয়। কিন্তু পুনরায় যুদ্ধের মধ্যদিয়ে ভারত এই অজ্ঞল পূর্ণদখল করে। ১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দে চীন জিনজিয়াং ও নুব্রী উপত্যকার মধ্যের সীমান্ত বন্ধ করে দেয়। ১৯৫৫ খ্রিস্টাব্দে চীন জিনজিয়াং ও তিব্বতের মধ্যে সড়ক নির্মাণ করেন। পরবর্তীতে এই সড়ক পাকিস্থানের কারাকোরাম মহাসড়কের সাথে যুক্ত করে দেয়। এদিকে ভারত কাশ্মীরের রাজধানী শ্রীনগর থেকে লেহ পর্যন্ত ১ ডি নং জাতীয় সড়ক নির্মাণ করেন। ২০১১ সালের আদমশুমারী অনুযায়ী লাদাখের জনসংখ্যা ২ লাখ ৯০ হাজার ৪৯২ জন। লাদাখের দর্শনীয় স্থানগুলোর মধ্যে নুব্রাজালি , প্যাংগং লেক ,খারদুংলা পাস , তুতুর্ক গ্রাম, নল্যান্ড , লে সাইট সিংহ উল্লেখযোগ্য।
লেখকঃ সহকারী অধ্যাপক ও সদস্য, খেলাঘর কেন্দ্রিয় কমিটি।
মোবাইল ঃ ০১৭১১-১০৮৭৩৬