ভারতের জীবন বোধের লেখক অজন্তা প্রবাহিতার ভাষা নিয়ে লিখা “আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারী,আমি কি ভুলিতে পারি”

346
অজন্তা প্রবাহিতার ভাষা নিয়ে লিখা “আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারী,আমি কি ভুলিতে পারি ”

আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারী ,আমি কি ভুলিতে পারি
অজন্তাপ্রবাহিতা

” মোদের গরব মোদের আশা, আ-মরি বাংলা ভাষা “,
বিশ্বের প্রতিটি জাতির কাছে নিজস্ব ভাষা ও সংস্কৃতি রয়েছে । এ নিজস্ব ভাষাই হচ্ছে মাতৃভাষা। যেমন – ইংরেজদের কাছে ইংরেজি , জার্মানিদের কাছে জার্মান ঠিক তেমনি বাঙালিদের কাছে বাংলা ভাষা। কবির কথায়, ” যে ভাষাতে প্রথম বোলে,ডাকিনু মায়ে মা মা বলে ” সে ভাষাই আমাদের মাতৃভাষা। এই ভাষায় আমরা আমাদের ভালোবাসা, প্রেম, রাগ দুঃখ ,অভিমান প্রকাশ করি। বাঙালি হিসেবে বাংলা সাহিত্য ও বাংলা ভাষা নিয়ে আমাদের একটা ভাবাবেগ ভীষণ ভাবে কাজ করে। সরস্বতী পুজোর আনন্দের সাথে হাতে খড়ি দিয়ে মা বাবার মুখে মুখে শেখানো বুলির মতন , “ভোর হলো দোর খোলো ,খুকুমণি ওঠরে ,” অথবা “তোমার কাছে আমিই দুষ্টু ,ভালো যে আর সবাই “, আউড়ে বড় হয়েছি । বাংলা ভাষার সুমিষ্টতাকে প্রতি মুহূর্তে উপলব্ধি করি। যত সহজে নিজের অনুভূতি বাংলায় প্রকাশ করতে পারি সেই একই অনুভূতি যখন বিদেশী ভাষায় প্রকাশ করবার চেষ্টা করি ,কোথাও যেন একটা অতৃপ্তি থেকে যায়।

মানুষের দৈনন্দিন জীবনধারণ ও কাজকর্মের ক্ষেত্রে ভাষা একটি অতি প্রয়োজনীয় মাধ্যম। সভ্যতা সৃষ্টির সূচনা লগ্নে একটা সময়ে মানুষ আকারে ইঙ্গিতে প্ৰকাশ করতো। সভ্যতার বিবর্তনের সাথে সাথে মানুষের মনের ভাবপ্রকাশের তাগিদে সৃষ্টি করেছে
নতুন নতুন ভাষা। ভাষা সভ্যতা ও সংস্কৃতির অন্যতম ধারক ও বাহক।
একই ভাষা বলা কোনো অপরিচিত ব্যক্তি নিমেষের মধ্যে আপন হয়ে যেতে পারে ,এই কথা বহু বছর ধরে বাংলার বাইরে থেকে ভীষণ ভাবে অনুভব করেছি। ভাব ও ভাবনা পৃথক হলে তার প্রকাশের ভাষাও পৃথক হয়। শ্রীজাতর লেখা উপন্যাসের একটি উক্তি খুবই প্রাসঙ্গিক,”আমরা প্রত্যেকেই প্রতিটা কথাই তো আসলে অনুবাদ করি -অন্তরের আবেগের -অনুভূতির বা বোধের অনুভব সেটাই তো আমার ভাষা। ” এক্ষেত্রে মাতৃভাষার সুবিধে হলো তাকে আমরা চিনতে শিখি সেই ছ’মাস বয়স থেকেই। এ ছাড়াও শিক্ষার ক্ষেত্রে মাতৃভাষার হাত ধরে এগোলে বিষয়ের জটিল বাঁক গুলো ঢের বেশি সহজবোধ্য হয়ে ওঠে।
বাঙালিই পেরেছে মাতৃভাষাকে বিশ্বের দরবারে রাজসিংহাসনে বসাতে। তার মাথায় তুলতে সেরার মুকুট।
বাংলাদেশ ও বাঙালি জাতির ইতিহাসে ভাষা আন্দোলন একটি ঐতিহাসিক ঘটনা। প্রতি বছর ২১ শে ফেব্রুয়ারী দিনটিকে ভাষা শহীদ দিবস হিসেবে আপামর বাঙালিরা পালন করি। ইতিহাস ঘাঁটলে বুঝতে পারা যায়,বাংলা ভাষাকে কেন্দ্র করে ভাষা আন্দোলনের তীব্রতা,রক্তক্ষয়ী আন্দোলন কি ব্যাপক চেহারা নিয়েছিল। ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারী ,১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দেবার জন্য প্রত্যয়ী ছাত্রসমাজ মিছিল বের করে। তাদের থামানোর জন্য নির্বিবাদে গুলি চালায় পুলিশ। রক্তাত্ব শরীরে রাস্তায় লুটিয়ে পড়ে সালাম ,বরকত ,রফিক ,শফিক ,জব্বর আরো অনেকে। কপালে গুলিবিদ্ধ হয়ে সেই মুহূর্তেই মারা যায় রফিক। উরুতে গুলিবিদ্ধ হয়ে বরকত সেই রাতে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করে। সেদিন ও পরদিন ভাষা আন্দোলনে কতজন শহীদ হয়েছিলেন সেবিষয়ে সঠিক সংখ্যা এখনো পাওয়া যায় না।
পৃথিবীর ইতিহাসে মাতৃভাষার জন্য রাজপথে বুকের রক্ত ঢেলে দেয়ার প্রথম নজির এটি। এই একদল যুবকের তাজা রক্তের বিনিময়ে শৃঙ্খলমুক্ত হয়েছিল দুঃখিনী বর্ণমালা। দীর্ঘ ৫৯ বছর পার হবার পরেও প্রাসঙ্গিকতা হারায় নি সেদিনের আন্দোলন। বাংলাকে নিজের প্রাণের মতো, শরীরের রক্তের মতো ভালোবাসতে পারার যে অনুভূতি এই ভাষা আন্দোলন দিয়েছিলো, সেই গভীর অনুভূতি আজও প্রতিটি বাঙালির প্রাণে আছে। একুশে ফেব্রুয়ারী বাঙালির কাছে চির প্রেরণার প্রতীকে পরিণত হয়েছে। হৃদয়ের সবটুকু আবেগ ঢেলে দিয়ে সবার কণ্ঠে বাজে একুশের অমর শোকগীত ,- আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারী ,আমি কি ভুলিতে পারি।

একুশে ফেব্রুয়ারী আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। বীর সন্তানের আত্মত্যাগের ফলস্বরূপ বাংলা ভাষা যেমন আন্তর্জাতিক মর্যাদা লাভ করেছে তেমনি দিনে দিনে হয়ে উঠেছে বিশ্বায়নের অন্যতম মাধ্যম। কিন্তু একটা জায়গায় চোরকাঁটার মতো একটা দুঃখ বারেবারে বুকে বেঁধে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে ব্যবহার বাংলা ভাষা ব্যবহারকারী একটি দেশ – বাংলাদেশ,বহির্বিশ্বে ৩০ টি বিশ্ববিদ্যালয়ে ১০০ টি বিশ্ববিদ্যালয়ে চালু রয়েছে বাংলা বিভাগ, প্রতি বছর হাজার হাজার অবাঙালি পড়ুয়া বাংলাভাষা শিক্ষা ও গবেষণার কাজ করেছে।

আসলে, মাতৃভাষাকে কে না ভালোবাসে ? তবু বাংলা ভাষাকে সংরক্ষণ ,ব্যবহারিক ভাষা হিসেবে রক্ষা করার তাগিদ বর্তমান প্রজন্মের মধ্যে খুব কম পরিলক্ষিত হয়। আমাদের সন্তান সন্ততি ক্যারিয়ারের স্বার্থে ও বৃহৎ প্রতিযোগিতার স্বার্থে অন্য ভাষায় পড়াশোনা করতে বাধ্য হয়। তবুও একটাই কথা মনে হয় বিদেশী ভাষার পাশাপাশি প্রাণের ভাষা মাতৃভাষাটাও তারা শিখুক। বাংলা ভাষার যে বিপুল সমৃদ্ধি ,সাগরের মতো গভীর ব্যাপ্তি এসব থেকে যেন তারা বঞ্চিত না হয় সেই দায়িত্ব অভিভাবকদেরই নিতে হবে। মনে রাখতে হবে ,ভাষা আন্দোলন বাঙালীর ঋণ। মাতৃভাষার প্রতি ভালোবাসা বাঙালির উত্তরাধিকার। এই ভালোবাসাকে প্রজন্মের পর প্রজন্ম বয়ে নিয়ে যাওয়াই ভাষা আন্দোলনের শহীদের প্রতি বাঙালীর ঋণশোধ।

বিখ্যাত কবি ও সংগীতকার শ্রী প্রতুল মুখোপাধ্যায়ের কয়েকটি লাইন উদ্ধৃত না করলে কোথাও অতৃপ্তি থেকে যাবে , “আমি বাংলায় গান গাই ,আমি বাংলার গান গাই। আমি আমার অমিকে চিরকাল এই বাংলায় খুঁজে পাই। বাংলা আমার জীবনানন্দ ,বাংলা প্রাণের সুখ। আমি একবার দেখি বারবার দেখি ,দেখি বাংলার মুখ। “

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here