মীর শাহীন আহমেদ এর মৃত্যুর খবর ও বিবেকের প্রশ্ন !!
সৈয়দা ইয়াসমীন
সকালে ঘুম থেকে উঠেই একটা মৃত্যুর খবর পেলাম, তাও এমন একটা মৃত্যু যা কল্পনা করা যায় না। নির্বাক ছিলাম সারাটা দিন, নিজেকে কিছুতেই বিশ্বাস করাতে পারছিলাম না। আগের দিনও তো ফোনে কথা হয়েছে সব ঠিকঠাক ছিল। হঠাৎ এমন কি হলো যে একটা মানুষ চিকিৎসার অভাবে গাড়িতে মারা গেল, তার পরিবারের সামনে। সেই পরিবার দেখছিল আপন মানুষটাকে চিকিৎসার অভাবে চোখের সামনে মরে যেতে; কারও জন্য এর চেয়ে বড় কষ্ট আর কী হতে পারে? ফোন দিচ্ছি সত্যটা জানার জন্য, ফোন যাচ্ছে না। সারা দিন চেষ্টা করলাম, তারপর মনে হলো খবরটা ঠিক, নাহলে ফোন যাবে না কেন! হঠাৎ দেখি ফেসবুকে মসজিদের ইমাম সাহেবের ঘোষণা, মীর শাহীন আহমেদ দেশে ইন্তেকাল করেছেন। তারপর আরও অনেকের সাথেই কথা হলো। ইংল্যান্ড থেকে দুইজন ফোন করে বললেন, সেই করুণ কাহিনী। বুঝতে পারলাম, এজন্যই শাহীন ভাইয়ের স্ত্রীর ফোন বন্ধ। আমার শুধু মনে পড়ছিলো তাদের কথা।কত আশা করে দেশে গিয়েছিলেন বেড়াতে। তখন করোনা ভাইরাসের কোন সমস্যা ছিল না। শাহীন সাহেব হৃদরোগে আক্রান্ত ছিলেন। এখানে (ইতালিতে) পরিবারসহ বসবাস করতেন। দুই বার হার্টের অপারেশন হয়েছে। তার চিকিৎসা চলছিল। হঠাৎ অসুস্থ্য হয়ে যেতেন এবং তার পূর্ব লক্ষণই ছিল জ্বর। প্রায়ই ফোন দিলে শুনতাম ভাবী (শাহীন সাহেবের স্ত্রী) বলতেন হাসপাতালে। কী সমস্যা জিজ্ঞেস করলেই বলতেন, তার স্বামীর জ্বর হয়েছিল; তাই তাকে নিয়ে হাসপাতালে আছেন। আমি প্রথম প্রথম বলতাম জ্বরের জন্য হাসপাতালের ইমার্জেন্সীতে যাওয়ার দরকার কী? এখানে তো সবারই নিজস্ব ডাক্তার আছে। উনি বলতেন, শাহীন সাহেবের যখন জ্বর হয়, সেটা সাধারণ জ্বর না। উনার হার্টের সমস্যা দেখা দিলে জ্বর হয়। তাই ডাক্তার বলে হাসপাতালে নিয়ে যেতে। তখন উনি সারা দিন জব করে রাতে স্বামীর কাছে হাসপাতালে পড়ে থাকতেন। কোন অবস্থায়ই স্বামীর একটুও অযত্ন হতে দেন নি। এভাবেই চলছিল।
গত এক বছর ধরে শাহীন সাহেব দেশে যাওয়ার জন্য, পরিবারের সবাইকে দেখার জন্য অস্থির ছিলেন কিন্তু তার অসুস্থ্যতার কারণে তার স্ত্রী অনেকবার সবকিছু গুটিয়েও দেশে যাওয়ার সাহস করতে পারেন নি। অবশেষে তিনি সুস্থ্য হয়ে উঠেন কিন্তু তাকে নিয়মিত ঔষধ নিতে হতো। গত জানুয়ারী মাসে ডাক্তার অনুমতি দিলে তারা কিছুদিনের জন্য দেশে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। তারপর এয়ারপোর্টে তাদের কি একটা সমস্যার কারণে নির্দিষ্ট ফ্লাইটে যেতে পারেন নি। তাই পূনরায় টিকেকের তারিখ পিছিয়ে ফেব্রুয়ারীতে ফ্লাইট করতে বাধ্য হন। তখনও এখানে করোনা ভাইরাস পরিস্থিতি ছিল না। আমরা শুধু মিডিয়াতে শুনছিলাম….চীনে ভাইরাসের কথা। তারা দেশে গেলেন ঠিকঠাক মতোই। যখন ফিরবেন, তখন ফ্লাইট কনফার্ম করতে পারছিলেন না কারণ ট্রাভেলস থেকে জানানো হলো টিকেট নেই তাদেরকে অপেক্ষা করতে হবে। এদিকে প্রতিদিন করোনা ভাইরাস আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছিলো, ইতালি সরকার ফ্লাইট বন্ধ করে দেয়, তারপর লক ডাউন ঘোষণা করে। তারা আটকে যান দেশে। তার বাড়ি সিলেটের বেয়ানী বাজারে। তাদের দেশের বাড়িতে অনেকবার পুলিশ গেছে তাদেরকে কোয়ারেন্টেইনে নেওয়ার জন্য। কিন্তু পাসপোর্টে সীল দেখে প্রমাণ হয়েছে তারা করোনা ভাইরাসের অনেক আগে গেছেন তাই তাদেরকে কোয়ারেন্টিনে নেওয়ার প্রয়োজন বোধ করেন নি। কয়েক মাস চলে গেলো। শাহীন সাহেব সুস্থ্যই ছিলেন। তার প্রয়োজনীয় ঔষধ ইতালি থেকে সাথে করে নিয়েছিলেন, সেগুলো চলছিল। মারা যাওয়ার আগের দিন তার স্ত্রীর সাথে আমার ফোনে কথা হয়। বললেন, সবকিছু ঠিক আছে, শাহীন সাহেব সুস্থ্য আছেন। পরের দিন তার মৃত্যুর সংবাদ শুনে আমি হতবাক। তারপর আমি আর তাদের সাথে কোন যোগাযোগ করতে পারিনি। গতকাল আবার ভাবীর (শাহীন সাহেবের স্ত্রীর) সাথে আমার কথা হয়। তখন তার মুখেও শুনলাম সেই করুণ কাহিনী। গত ২৪ এপ্রিল সকালে হঠাৎ করে শাহীন সাহেব অসুস্থ্য হয়ে যান। বুকে ব্যথা সাথে জ্বর আসে। এ্যাম্বুলেন্স বাড়িতে আনতে কয়েক ঘন্টা লেগে গেলো। তারপর সিলেটের কোন একটা ক্লিনিকে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলেন কিন্তু কোন ক্লিনিকেই রোগী গ্রহন করতে চায়নি। শেষ পর্যন্ত পরিচিত একজন ( Oasis Hospital) নামে একটা ক্লিনিকে সুযোগ করে দিলেন। ওখানে যাওয়ার পরেই ডাক্তার ঔষধ আনতে বলেন। তারা কিনে আনলে একজন নার্স এসে তাকে অনেকগুলো ট্যাবলেট ( আনুমানিক আট/দশটা) এক সাথে খাইয়ে দেয়। তার স্ত্রী জানতে চাইলেন কিসের ঔষধ তাকে খেতে দেওয়া হলো কিন্তু তার উত্তর পাননি। একটু পরে আরেকজন এসে তার স্ত্রীকে জিজ্ঞেস করে আপনাদের পরিবারের কেউ কি বাইরে থাকে? ইতালি থেকে গেছেন শুনেই তারা রোগীকে জোর বের করে দেয় এবং বলে আগে ওসমানী মেডিক্যাল কলেজে টেস্ট করে নিশ্চিত হতে হবে তার করোনা আছে কি না। তার আগে মোটা অঙ্কের টাকা পেমেন্ট করিয়ে নেয় ক্যাবিন ভাড়াসহ। তারপর অনেক কান্নাকাটি করে অনুরোধের পর নিরুপায় হয়ে অন্য এক ক্লিনিকে যান। সেখান থেকেও তাড়িত হয়ে যান সরকারী ওসমানী মেডিক্যাল কলেজে। সেখানে তাদের জন্য গেইটই খোলা হয়নি, ইতালি থেকে গেছেন বলে। এই অবস্থায় রাতের বেলা গাড়িতেই তার অকাল মৃত্যু হয়। তার স্ত্রী হাউমাউ করে কেঁদে বলছিলেন ” আমি আমার স্বামীর সবকিছু জানি; তাকে দেখলেই বুঝতে পারি কী সমস্যা। তার হার্টের সমস্যা হয়েছিল, করোনা না”।
নির্বাক হয়ে শুনছিলাম আর ভাবছিলাম, এ কেমন চিকিৎসা ব্যবস্থা; আর কেমনই বা আমাদের ডাক্তারদের মানবতাবোধ! খুবই কষ্টদায়ক! যে পরিবারকে কখনও দেখিনি সঞ্চিত একটা টাকা ইতালির ব্যাংকে জমা রাখতে। মাস শেষে কয়টা টাকা বাঁচাতে পারলেই দেশে ছেড়ে দিতেন। তাদের একটাই কথা পরের দেশে ব্যাংকে টাকা রেখে লাভ কী? ব্যাংকে রাখতে হলে নিজের দেশেই রাখবো। অতিরিক্ত খরচ দিয়েও টাকাটা দেশের ব্যাংকে রেখে শান্তি পাওয়া মানুষগুলোকে দেশ এ কেমন উপহার দিলো! বিদেশ থেকে প্রবাসী বাংলাদেশিরা সবাই করোনা ভাইরাস বয়ে নিয়ে যান নি, অনেকেই পরিস্থিতির কাছে নিরুপায় ছিলেন; যার প্রমাণ দিয়ে গেলেন শাহীন সাহেব। বাংলাদেশের সর্বমোট আয়ের একটা বিরাট অংশ আসে বিদেশি রেমিটেন্স থেকে, এটা দেশের মানুষ কি করে ভুলে যায়! আজ যারা ডাক্তার হয়েছেন, তাদের পড়াশুনার জন্য পরিবারের অর্থ যেমন ব্যয় হয়েছে, তেমনি হয়েছে সরকারের। আর সরকার এইসব মেহনতি মানুষের কাছ থেকেই টাকা পেয়েছে।
তাদের কি দেশের প্রতি, দেশের মানুষের প্রতি কোন দায়বদ্ধতা নেই? তাহলে ডাক্তার হওয়ার আগে চুক্তি করা উচিৎ যে, আমি শুধু স্বর্দি-জ্বরের রোগীর চিকিৎসা করবো; কোন জঠিল রোগের চিকিৎসা করে ঝুঁকি নেবো না। অন্যান্য দেশে দেখছি, ডাক্তাররা নিজেদের দেশে করোনায় আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসা করে শেষে নিজের পকেটের টাকা খরচ করে বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছেন অন্য দেশের করোনা আক্রান্ত রোগীদেরকে সাহায্য করার জন্য। বর্তমানে কোন দেশেই করোনা ভাইরাসের সাথে যুদ্ধ করার মতো পর্যাপ্ত পরিমানে সামগ্রী নেই কিন্তু কেউ তো বসে থাকছে না। যে যার মতো চেষ্টা করে যাচ্ছে অন্যকে সাহায্য করতে। সিলেটের ওসমানী মেডিকেল কলেজের মতো জায়গায়ও যদি একজন রোগীকে দেখে করোনা ভাইরাস আক্রান্ত ভেবে গেইট বন্ধ করা হয়, তাহলে তো বাংলাদেশের চিকিৎসা ব্যবস্থা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়! !!!