সমাজ সংস্কৃতি ও বাউল অঙ্গে রবীন্দ্রনাথ
———হাসান আহমেদ চিশতী
মনুষ্য বসতির সকল সভ্যতা ঘিরে লোকাচারের অঙ্গ প্রত্যঙ্গ জুড়েই রবীন্দ্রনাথের বিচরণ, বাংলার মনন সংস্কতৃতিতে একান্ত আশীর্বাদ। ধন্য প্রকৃতির বিপুলায়তন নিয়ে যার লিলায়িত নিকেতন। নম্নিবর্গ থেকে উচ্চ মার্গ র্পযন্ত যিনি পরিভ্রমনে অপরিনামদর্শী যেন দশাননে। চিত্তের চৈতন্যে বিত্তের বিভাজনে জন-জীবনের অমূল্য মহাজন রবীন্দ্রনাথ এর সৃজন সৃষ্টির ভাবনা বলয়। কাল আর মহাকালের বিজন বৈরাগ্য ছুয়েছিল তাঁর অন্তর। বাসনার বনেদী আতর ঢেলে রূপ কল্পের কলকী পুরান যেন তাঁর সাহিত্য সম্ভার। যেখানে যুক্তি বিজ্ঞান আর বিজ্ঞতার বুননমাত্রা মতিভ্রম ছাড়িয়ে গতির যাত্রায় তীর্থগামী।
জীয়ন কাঠির মত বাউল বাসনার রসনায় এক টুকরো শলাকা আলোকায়ন বাংলার চিত্রিত আঁধার এ মুক্তির মালিকানা টেনে ধরেছেন তিনি। ঘুম জাগানিয়া ভুমি পুত্ররা সূর্য সকাল দেখেছিল। ছলনায় রমনিরা রাত্রি নিবাস ছেড়ে ছেউড়ি ছাঁয়ায় পবিত্র শপথ নিতে শিখেছিল। সূরের কুশল বিনিময়ে পাখিদের কলতান সুমধুর হয়েছিল। সবুজ বৃক্ষের নিচে পান্থজন প্রশান্তরি প্রাপ্তিতে প্রত্যাশা পেয়েছিল। সভ্যতার সুশৃক্সক্ষলে সংগ্রামী মানুষ দণ্ডদায়রে দাবীতে দিব্য দৃষ্টি পেয়ে গেলো। আজও সেই প্রতশ্রিুততিইে চলমান সাহিত্যে অনন্য রবীন্দ্রনাথ।
যদি বলি সামাজিকতার ভেতরে বাউল অঙ্গে রবীন্দ্রনাথ কেমন ? তাহলে সহজেই বলা যায় বাউলের কোনও সামাজিক প্রতিবাদ নেই কিন্তু রবীন্দ্রনাথের আছে অনেক বেশি। কেননা তিনি স্বজল সংসারি আন্তঃ বৈরাগ্যে বসত গড়েছেন প্রানান্তকর রূপমার্গে। তাইতো তিনি ধ্বনন্তরী সমৃদ্ধ ভাষা সম্ভারে। বাউলের কোন নির্দিষ্ট সূর নেই রবীন্দ্রনাথ সূরকে বেঁধেছেন আপনার করে। রবীন্দ্র বলয়ে যে বাউল বৈরাগ্য তার নৈসর্গিকতা যেন মনন কৌলিন্যে সমাসীন ।
নদীয়া বা কুষ্টিয়া অঞ্চলের বাউল ধারা থেকেই তার একান্ত আকৃষ্টতা। যেখানে লালন সাঁই অনন্য এবং সেই সুত্রে গগন হরকরা। মূলতঃ বাংলা গানে বাউলের যে প্রকৃতি তাতে সুর ও বানীর একাত্মতায় যে বৈশিষ্ট্য তাই বাংলার শেকড়ে টানে। এই মগ্নমানস চিত্রে অবগাহন করে রবীন্দ্রনাথ নিজস্ব সূর নির্দেশে বানীর বন্ধন নির্মাণে আবিষ্ট হয়েছেন। বিষাদ আর নিষাদে যে আনন্দ ধ্বনির মিশ্রভাব থাকে। “রাঙিয়ে দিয়ে যাও- আমার সকল কর্মে লাগে- যাওগো এবার রাঙিয়ে দিয়ে যাও। রক্তে তোমার চরণ দোলা।” এমনই গীত ও ধারায় রবীন্দ্রবলয় প্রভাবিত কষ্টি মাপে, সূরের কাঠামোতে যেন “বিদ্যাপতির রাধা বিরহে কাতর,
চণ্ডিদাসের মিলনেও সুখ নেই। এ উপলব্ধীতে বাউল অঙ্গ বাঁধা। তারপরও ব্যক্তিগত সংকট, সামাজিক সংকট এবং অন্যান্য বহু অনুসঙ্গ থেকে ত্রিশূল ভেদী শক্তিতে রবীন্দ্রনাথের আধুনিকতা। এই জন্যই “মোর নামে বলে খ্যাত হোক, আমি তোমাদেরই লোক।” জীবনানুসঙ্গের কতটা কাছে এলে এটা বলা যায় রবীন্দ্র সাহিত্যেই তার প্রমাণ মেলে দুঃখে, বিষ্ন্নতায় এবং আশ্রয়ে।
যে প্রকৃতির আপন আলয়ে রবীন্দ্রনাথের কূল পরিচয় এর মালিকানা সেখানে তাঁর লোক সাহিত্য অনবদ্য। লোক সাহিত্যকে ‘জনপদের হূদয়-কলরব’ বলা হয়। তথ্যগত প্রকরণের লোক সাহিত্যে স্রষ্টা নিজেই বুঝতে পারে না লোক সাহিত্য ভাবনা বলয়ের একান্ত রুপ । এক্ষেত্রে রাবীন্দ্রিক বলয় তার নিজস্বতা নির্মাণে প্রকট। যেমন লোক অনুভূতির সাথে কল্পনা কাব্যগ্রন্থে স্বপ্ন কবিতা দূরে বহুদুরে। স্বপ্নলোকে উজ্জয়িনীপুরে। খুঁজিতে গেছিনু কবে শিপ্রানদী পাড়ে । মোর পুর্ব জনমের প্রথমা প্রিয়ারে-। যদিও লোক সাহিত্য তার প্রাণশক্তি বলে এক স্থান থেকে নানা স্থানে যায় এবং এর বিশেষত্ব তার অলিখিত রুপ যা oral literature (মৌখিক সাহিত্য) হিসাবেই খ্যাত। কাব্যগত প্রসাধন কলার ধরণই ভিন্নতা এবং সরস রসের সরল কারবারী। অপরদিকে যুগ বা কাল বিবেচনায় লোক সাহিত্যের মত উচ্চতর সাহিত্যের সঞ্চারন ক্ষমতা নেই বরং যা আছে তা প্রচারিত। বড় আশ্চর্য্য হলো সাহিত্যের মায়া ছায়া আর কায়া বাঁধনে রবীন্দ্রনাথ যেন কুলাধিপতি। তাঁর সকল ব্যাপৃতিতেই মূলাধার সংযোজিত। রবীন্দ্রনাথের ভাষায় নিয়ত পরিবর্তিত আন্তরাকাশের ছায়া মাত্র, তরল স্বচ্ছ সরোবরের উপর মেঘ ক্রীড়িত নভোমণ্ডলের ছায়ার মতো’ নয়। তাই এ মানব মনে আপনি জন্মানো ফসল নয়। এ কাব্য সৃষ্টিতে কবির সর্বাঙ্গীন ও ধীর প্রযত্ন দুর্লক্ষ্য নয়। ভীষণ লোক সাহিত্য প্রিয়তা এবং সংগ্রহ রেখেছেন কবি গুরু তার একান্ত ধারায়।
টমাস ম্যুর এর কথাটি এমন যে “ইচ্ছা করলে ফুলদানিটাকে ভেঙ্গে ফেলতে পারো, করতে পারো চূর্ণ বিচুর্ণ কিন্তু তবুও গোলাপের সৌরভটুকু ছড়িয়ে থাকবে তার চারদিকে।” রবীন্দ্রনাথ সাহিত্যে এমনটাই প্রনোদনা সৃষ্টি করেন। বাংলা ভাব ও ভাবের ভাষা। বাঙালি মাত্রই যথার্থ প্রাণের ভাষার জন্ম নিধি।
রবীন্দ্রনাথ এর বয়স যখন মাত্র বাইশ বছর (১৮৩৩ খৃঃ) যখন তাঁর চোখে রোমান্টিকতার অপরূপ মায়াঞ্জন এর গাঢ় প্রলেপ তখন ভারতী পত্রিকাতে (বৈশাখ ১২৯০ পৃঃ ৩৪-৪১) একটি প্রবন্ধ লেখেন, ‘বাউলের গান’। এই প্রবন্ধের মধ্য দিয়েই সর্বপ্রথম বাঙালীকে এ দেশীয় গান কবিতা ও বাংলার লোক সাহিত্য সংগ্রহের গুরুত্ব অনুধাবন করতে শেখান অর্থাৎ তিনি বাংলার লোক সাহিত্য চর্চার ক্ষেত্রেও দীক্ষা গুরু। ফলে রবীন্দ্র সময়ের বাউল ধারা কিংবা লোক সংস্কৃতি চর্চার আগ্রহজাত অসংখ্য গ্রন্থ রচিত হয়েছে, শ্রীস চন্দ্র মজুমদার, অঘোরনাথ চট্টপাধ্যায় রচিত গ্রন্থ সহ লোক রূপকথায় দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদার, দীনেশ চন্দ্র সেন (১৮৬৬-১৯৩৯) কেদারনাথ মজুমদার প্রমুখ। তবে রবীন্দ্রনাথের সংগ্রহ এবং বিচার নিষ্ঠতায় ছিল অনন্যমাত্রা। ড. শ্রী আশুতোষ ভট্টাচার্য মহাশয় এ বিষয়ে উল্লেখ যোগ্য মন্তব্য করেছেন। সাহিত্য বিচারে রবীন্দ্রনাথ এর বিজ্ঞান চেতনা, আত্মোউপলব্ধি, ভাষা, ইতিহাস এবং সময়কাল ও রসোউপকরণ সহ আত্মপরিচয় বাংলার প্রকৃতি।
রবীন্দ্রনাথের লোকসাহিত্য গ্রন্থটি প্রথম প্রকাশিত হয় ১৩১৪ বঙ্গাব্দে অর্থাৎ স্বদেশী আন্দোলনের দুবছর পরে। মোট চারটি প্রবন্ধ নিয়ে এই গ্রন্থ অঙ্গন। যথাক্রমে ১৮৯৪ খৃষ্টাব্দ আর ১৮৯০ খ্রীষ্টাব্দের মধ্যে সাধনা সাহিত্য পরিষদ পত্রিকা, সাধনা ও ভারতীতে প্রকাশিত হয়। তৎকালীন জীবন মানের সেই এক মূল্যবোধের ধারণা যেন পরিমার্জিত মূল্যবোধের ভিন্নতা নিয়ে দাঁড়াতে শুরু করেছিল সাহিত্যের সৃজন ভাবনা বলয়ে।
কবি গুরু সেই ধারাতেই বলেন যে, সকল ক্ষণকালজাত ক্ষণস্থায়ী সাহিত্য ভাষা ও ভাবের ইতরতা, সত্য এবং সাহিত্য নীতির ব্যাভিচারে ও সর্ব বিষয়ই রূঢ়তা ও অসংযম দেখতে পাওয়া যায়। ক্ষণস্থায়িত্ব, রসের জলীয়তা এবং কাব্য কলার প্রতি অবহেলায় রচিত গান শুধু ক্ষণিক উত্তেজনাই সৃষ্টি করে। অর্থাৎ মন ভুলানো স্তাবক আছে ছায়াময় মরিচীকা যাতে মনন মাত্রা ভেঙ্গে টানে বিচিত্র গুঞ্জনে।
তবু ইতিহাসের অনেক ধাপ পেরিয়ে সাহিত্য সংস্কৃতির যে সরলিকরণ বাঙালীর অস্তিত্বে তার মূল মন্ত্রণায় কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ। জগত সংসারে নানা ভ্রান্তির সাথে ছলনা ও তুলনা দুই-ই আছে যেখানে বেদ-বৈদ্য বাঁধন প্রকৃতিই বাউল, যে দাসত্ব মানে না, আছে তার অন্তর বেদনা, অরূপধনে রূপের সাধনা। জনম যে প্রভায় নিখিল সংসার আকীর্ণ হয়ে থাকে। ধীবরের মত ঐক্যজাল নিক্ষেপ করে ভাবের একান্ত গভীর সরোবরে। বাউল ঘারানা থেকে এই বাংলায় কবি গুরুর আপন সত্ত্বা এসে ধরেছিল “রূপের রসাভিব্যক্তি/ রসের রূপ পরিণতি। আমির ভাবনা/ তুমির ধারণা-” কৃত্তিমতা বিবর্জিত কৌলিন্যের মাপকাঠি বিজনে বুনন করেছেন কায় ও ক্লেশে সংসার কাননের কাব্য কথা। তাই তো রবীন্দ্রনাথ চরিত্রে দম, ত্যাগ, অপ্রমাদ এই তিন অমৃত পদে প্রতিষ্ঠিত। তবে ইন্দ্রিয় ভোগের তীব্রতা ভোগাবসাদের ক্লীষ্টতা, কামনার মদির জ্বালা, কামার্তের বিমূঢ় বেদনা কিংবা ভোগভীত শুস্ক সন্যাসীও তাঁকে বলা যাবে না।
সাহিত্য প্রচেষ্টায় তিনি প্রজন্মের তত্বাবধায়ক, জীবনের নেতিবাচক অবস্থানে ইতিবাচক করে দেখা, প্রতিকুল অবস্থাকে অনুকুল অবস্থায় রূপান্তর করা এবং সমাজ জীবনে পথের অবরোধকে উন্নতির সোপানে পরিবর্তিত করাই রবীন্দ্র কাব্য কলার অনুরনন।
নাগরিক মূল্যে বাউলের অবস্থান কতটা নির্নিত হয় এবং রবীন্দ্রনাথ কতটা সহায়ক। তবে বলতেই হয় রবীন্দ্রনাথ তাঁর সার্বজনীন সংযোজন শিক্ষা দীক্ষায়, পরিবেশ ও রুচির অনুজ্ঞাকে অব্যাহত মাত্রায় রেখেছেন। যেমন আজ দূর্গার অধিবাস, কাল দূর্গার বিয়ে নামক বিখ্যাত ছড়াটি শেষ দুচরণের মূলে ছিল-
বোন কাঁদেন বোন কাঁদেন খাটের খুরো ধরে
সেই-যে বোন গালি দিয়েছেন ভাতারখাকী বলে।
এখানে রবীন্দ্রনাথ শেষ চরণে ভাতারখাকী শব্দটিকে স্বামী খাকী করে পাল্টে দিয়েছেন। তবে এর জন্য তাঁর আত্মপক্ষ সমর্থনে দীর্ঘ্য বক্তব্যও রয়েছে। এছাড়া তাঁর ছেলে ভুলানো ছড়া-প্রবন্ধ যে সুক্ষ্ম সমাজ দর্শন ও ইতিহাস চেতনার পরিচয় তা অনন্য। সর্বকালেই তিনি ভাবনার আধুনিকতম জীবনালেখ্য রচনায় পারদর্শীতা দেখিয়েছেন এবং সেই জ্ঞান ও গবেষণা লব্ধও বটে।
ঘরকন্যায় লোক সাহিত্য বাউলের সাথে সম্পর্কে শ্বশুর-ভাশুরের মতো। লোক সাহিত্যের আপন জঠরে নষ্ট পরমায়ুকে ছেদ করে বাউল অঙ্গ। আর ধ্র“পদ সাহিত্য বিচারে মাটির টান ও আপনার রসদের জোগান না থাকলে তার ভিত্তি যেন কোনক্রমেই দাঁড়াতে পারে না এবং রবীন্দ্রকাব্যকলা বরং সেই মাত্রাই প্রকরণ প্রকারন্তরে শিক্ষা দিয়ে গেছেন। সুতরাং বাউল অঙ্গে রবীন্দ্রনাথ ও সমাজ সংস্কৃতির বাংলায় যে আধুনিকতার গণরূপ এর প্রভামূল তাই কবি গুরুর আপন আলয়ে নির্নিত সৌধ করটির আলোক উজ্জল মায়া মঞ্জুরীতে গাঁথা।
যে কোন ও জনগোষ্ঠীর ইতিবাচক সংস্কৃতির বিকাশ ধারা তার জীবিকাগত ও বাস্তব উপকরণগত তথা অর্থনৈতিক উন্নয়নের সাথে বিশেষভাবে সম্পর্কযুক্ত। শোষণভিত্তিক, শ্রেণী বিভক্ত সমাজ ব্যবস্থায় ভাবের ব্যত্যয় ঘটে বই কি! কিন্তু রবীন্দ্রনাথ চেতনার ধারালো প্রযুক্তি মননের গোলকায়ন এর স্বরুপ সাধনের নিমিত্তে হয়েছে সংসারে এবং আলোকায়ন মাত্রায় যাত্রা করেছে।
অপরাপর ঠাকুর পরিবারে সকল বিরোধের উর্ধ্বে দাঁড়াতে সক্ষম হয়েছিল রবীন্দ্রনাথ এবং তাঁর শান্তি নিকেতন। মেধা ভিত্তিক ঠাকুর পরিবার এ নারীদের বিচিত্র গুনে লোকশিল্প, রন্ধন সহ বিভিন্ন গীত ও বাদ্যের অনন্য ধারার বাতাবরন সংস্কৃতির মাত্রাকে তির্যকভাবে অবারিত করেছে বাঙালীর জীবন মানে একান্তভাবে। বাঙঙ্গালীর স্বভাবজাত ভাবের পরিমাণের ও পরিমিতি বোধের শুভ সংযোগ এর শিক্ষা ও সেখানেই নির্মাণ হয়ে এসেছে। অপরদিকে চেতন ছায়ার অচেতন ঐশ্বর্য্যে বাউল বন্দনার এ বাংলা ঘোরে কাটে বেলা অবেলার লিলায়। এ অনুসংগে কবিগুরুর দুটি চরণ “মাটিতে মিশিল মাটি
যাহা চিরন্তন
রহিল প্রেমের স্বর্গে
অন্তরের ধন।
আমাদের একটি প্রবাদ আছে- মানুষের মন কুমারের চাক/ পলকে দেয় আঠারো পাক
মানব মনে বিশ্বজগতের নিয়ত প্রতিবিম্ব এবং প্রতিধ্বনি ছিন্ন বিচ্ছিন্ন ভাবে ঘুরে বেড়ায়। এদের চিত্রায়ন বিচিত্র এবং অকস্মাৎ, প্রসঙ্গ থেকে প্রসাঙ্গন্তরে গিয়ে উপনীত হয়। মন তার মনন প্রক্রিয়ায় অনাবশ্যককে স্বযত্নে অনেকটা পরিহার করে দিতে পারে। রবীন্দ্রনাথের সজাগ দৃষ্টি সেইখানেই লক্ষ্যনীয়। তিনিই প্রথম গগন হরকরার সুবিখ্যাত লোক সঙ্গীত। আমি কোথায় পাব তারে, ইত্যাদি গানের স্মরলিপি প্রকাশ করেন। ডক্টর সুরেশচন্দ্র চক্রবর্তী, দীনেন্দ্রনাথ ঠাকুর এই গুলি প্রকাশ করেছেন। এছাড়া বাউল অঙ্গনের যে প্রকৃতি তা মূলতঃ বাঁধন ছেঁড়া মগজ উত্থিত জীবন ব্যাঞ্জনা সে ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথের শব্দকল্পের যে চিত্র তাতেও এর প্রকাশ কম নয়, যেমন-অচীন পাখি, পরশ পাথর, ক্ষ্যাপা মনের মানুষ, জীবন দেবতা কিংবা ভেঙ্গে মোর ঘরের চাবি নিয়ে যাবি কে আমারে ইত্যাদি। অথচ বাউল দর্শনের উৎপত্তি ঠিক কখন এবং ব্যবহারি জীবন দর্শন ইতিহাস অজ্ঞাত এবং এর স্থিতি শুধু ভক্ত চিত্তেই সমর্পিত হয়ে আছে। রবীন্দ্রনাথ মনে করেন মহাযান পন্থা হইতে বাউলদের উদ্ভব ঘটেছে। হারামনি গ্রন্থে এর উল্লেখ পাওয়া যায়। তবে ধর্ম যাচনায় মানুষের আদিতে যে আপন সুরের খেয়াল সেখানেই বাউল বন্দনার শব্দ সমাহার গঠিত হয়েছে বলে ধারনা করা যেতে পারে। কারণ পণ্ডিত ক্ষিতি মোহন সেন এ ব্যাপারে ব্যাপক ধারায় কাজ করেছেন এবং তার সূত্র ধরে যে অংক দাঁড়ায় তাতে এমনটাই স্বাভাবিক।
প্রসঙ্গতঃ লালন ফকিরঃ কথা কয়রে দেখা দেয় না/ নড়ে চড়ে হাতের কাছে খুঁজলে জনমভর মেলে না।”
অপরদিকে রবীন্দ্রনাথ ঃ আপনাকে এই জানা আমার ফুরাবে না। এই জানারই সঙ্গে সঙ্গে তোমার চেনা।——-।
কিংবা মমচিত্তে নীতি নৃত্যে কে যে নাচে——-।
সুতরাং সমাজ সংস্কৃতি ও বাউল অঙ্গে রবীন্দ্রনাথ আমাদের যুগ ভাবনায় এক যুগান্তকারী অনন্য ধারায় প্রতিষ্ঠিত।
হাসান আহমেদ চিশতী
লেখক ও প্রবন্ধকার।