ভারতের সৃজনশীল লেখক ও সাহিত্যক-অগ্নিমিতা দাসের একটি মেয়ের বাস্তব জীবনের অনুভূতির গল্প “ভিজে ভিজে শুকনো মন”

535
অগ্নিমিতা দাসের একটি মেয়ের বাস্তব জীবনের অনুভূতির গল্প “ভিজে ভিজে শুকনো মন”

ভিজে ভিজে শুকনো মন
অগ্নিমিতা দাস


শাক্যর আজ বন্ধু দীপ্তর বাড়িতে নেমতন্ন। নেমতন্ন মানে অফিসিয়াল পার্টি। শাক্য নামী ইংরেজি পত্রিকার রিপোর্টার। আজ ওর সিনিয়ার দীপ্তর প্রমোশন হয়ে এডিটার পদ লাভ করায় এই পার্টি। মুস্টিময় কয়েকজন ছাড়া বেশি কেও ছিলো না। তাই খুব তাড়াতাড়ি পার্টি শেষ হয়ে যায়। দীপ্ত পার্টি শেষের অগোছালো ঘর গোছাতে শুরু করলে, শাক্য ও হাত লাগায়। _
তোকে আজ আর অত দূরে বাড়ি যেতে হবে না।আমার বাড়িতে থেকে যা। কাল এখান থেকেই একসাথে অফিস যাবো।
শাক্য দুএকবার না না করে রাজী হয়েই গেল। চাকরি সূত্রে শাক্যর সাথে দীপ্তর বেশ ঘনিষ্টতা আছে। শাক্যর বাড়ি বর্ধমানে। যাদবপুরে মাস কমিউনিকেশন নিয়ে পড়ার পর চাকরি পেয়ে যাওয়ায় এখানেই ঘর ভাড়া নিয়ে থাকে। ও ব্যাচিলর ছেলে, তাই বাড়ি ফেরার গরজ ও তার নেই। জামাকাপড় ছেড়ে দীপ্তর ট্র্যাক প্যান্ট আর গেঞ্জি পরে একটু হাঁটতে বেরোলো। দীপ্তর শরীরটা একটু ডাউন লাগছিলো বলে ও বেরোলো না।
স্লটলেকের এই রাস্তাগুলোতে শাক্যর রাতে হাঁটতে ব্যাপক লাগে। যখনই ও দীপ্তর বাড়িতে থেকে যায় তখনই এই ঝাঁ চকচকে রাস্তায় হাঁটতে বেরোয়। চওড়া রাস্তায় নীল সাদা নিয়নের আলো পড়ে এক অদ্ভুত পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছে। রাত বেশি হয়
নি, তবু ও এই সব অঞ্চলে খুব বেশি লোকজনের আনাগোনা নেই। হুশ করে দুএকটা গাড়ি পাশ দিয়ে চলে যাচ্ছে। একটু পথ হাঁটার পর হঠাৎ শাক্যর ঠিক গা ঘেঁষে একটা গাড়ি ব্রেক কষলো। শাক্য একটু অবাক হয়ে দেখলো গাড়ি থেকে নামলো একটা তরুনী। গাড়ি থেকে নেমে দরজা বন্ধ করে শাক্যকে পিছু ডাক দিলো।
_ একটু হেল্প করবেন প্লিজ। শাক্য সবে হাঁটা দিয়েছিল , বাধ্য হয়ে থেমে গাড়ির দিকে এগিয়ে এসে বলল গাড়ি গন্ডগোল করছে? এখানে আশেপাশে কিন্তু কোন গ্যারেজ নেই। মেয়েটা হাঁফাতে হাঁফাতে বলল_ না, না সে সব কিছু নয়। আমায় বাঁচান। শাক্য এবার মেয়েটার দিকে ভালো করে তাকিয়ে দেখলো। বড়লোকের অতি আধুনিকা বলতে যা বোঝায়, সামনে দাঁড়ানো মূর্তিটি ও তাই। নিশ্চয়ই কোন বদলোকের পাল্লায় পড়েছে। শাক্য এবার গম্ভীর হয়ে জানতে চাইলো কি ধরনের সাহায্য সে চাইছে। মেয়েটা ফর্সা মুখ টকটকে লাল হয়ে গেছে, ঘামে মুখ ভিজে গেছে। কপালে পড়ে থাকা চুলগুলো তুলে সে ধীরে ধীরে বললো আমি একটু জল খাবো। আমার লেগেছে, একটু ওষুধ। শাক্য দ্রুত ভেবে নিলো একে দীপ্তর বাড়ি নিয়ে গেলে কেমন হয়! কিন্তু অচেনা একটা মেয়েকে এত রাতে বাড়িতে নিয়ে গিয়ে কোন বিপদকে ডেকে আনবে না তো? চিন্তা করতে করতে মেয়েটা অসহায় গলায় বলল আমি আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারছি না। আই নিড হেল্প। শাক্য তাড়াতাড়ি বলে উঠলো আপনি কি গাড়ি চালাতে পারবেন? কাছেই আমার বন্ধুর বাড়ি। মেয়েটা মাথা নাড়ালো। শাক্য গাড়িতে উঠে ড্রাইভারের সীটে বসলো, মেয়েটা গাড়িতে উঠতে গিয়ে সামান্য টলে গেলো। মেয়েটা কি ড্রিংক করেছে নাকি? নানারকম সাতপাঁচ ভাবার আগেই দীপ্তর ফ্ল্যাটের সামনে গাড়ি থামালো। মেয়েটা গাড়ি থেকে নেমে আর নিজের পায়ে হাঁটতে পারছে না।
শাক্যকে জড়িয়ে ও হাঁটতে লাগলো। একটা মিষ্টি সুবাস, সেটা মেয়েটার চুলের না গায়ের বোঝা না গেলেও শাক্যর সাথে লেপ্টে থাকলো। মেয়েটা যে থরথর করে কাঁপছে, সেটা ওকে ধরে থাকার ফলে শাক্য বেশ বুঝতে পারছে। ভাগ্যিস এত রাতে আশেপাশে কেও নেই। নাহলে ফ্ল্যাটের লোকজন ওদের এই অবস্থায় দেখলে খারাপ ভাবতো। দরজা খুলেই দীপ্ত ওদের দেখে চমকে উঠলে ও তাড়াতাড়ি ড্রইংরুমের সোভায় ধরাধরি করে মেয়েটা বসিয়ে দিল। এক গ্লাস ঠাণ্ডা জল মেয়েটার দিকে বাড়াতেই সেটা সে ছোঁ মেরে নিয়ে ঢকঢক করে খেয়ে নিলো। তারপর গ্লাসটা টেবিলে নামিয়ে ডুকরে কেঁদে উঠলো। শাক্য ভাবলো আচ্ছা নাটক তো! সাধ করে এই ফ্যাসাদকে দীপ্তর ঘরে নিয়ে এলো। মেয়েটা আস্তে আস্তে কালো শর্ট স্কার্টের ওপরের গোলাপী গেঞ্জির সাথে লেগে থাকা জ্যাকেটটা একটানে খুলে ফেললো। অনাবৃত সাদা ডানবাহুর কনুইটা থেকে ঝরঝর করে রক্ত পড়ছে। দীপ্ত আঁতকে উঠে ভেতরে ঘর থেকে তুলো আর ডেটল নিয়ে এসে ক্ষতস্থানে চেপে ধরলো।জ্যাকেটটা রক্তে মাখামাখি হয়ে গেছে। লম্বালম্বি হয়ে যাওয়া ক্ষতটা যে কোন ধারালো বস্তুর সেটা ওরা বুঝে গেল। কিন্তু মেয়েটা তখন কিছু বলার মতো অবস্থায় ছিলো না। ওরা রক্ত বন্ধ হয়ে গেলে বিটাডিন দিয়ে জায়গাটা পরিস্কার করে ব্যান্ডেজ করে দিলো।
_ একটা টিটেনাস নিলে খুব ভালো হতো। কিন্তু এত রাতে! ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করতে করতে শাক্য চুপ হয়ে গেল। মেয়েটা তখন সোভায় আধশোয়া হয়ে রয়েছে। গলা খাঁকরে দীপ্ত বললো_ কিছু কি খাবেন? ব্যাথার ওষুধ খেতে হবে তো। মেয়েটা চোখ বুঝে মাথা নাড়তেই,দীপ্ত দৌড়ে কিচেনে ছুটলো। শাক্য মেয়েটিকে দেখতে লাগলো। মডেলদের মতো সুন্দরী মেয়েটার লাবন্য সারা ঘরকে আলো করে দিচ্ছে। অনাবৃত দেহের অংশ বলে দিচ্ছে মেয়েটা কতটা ফর্সা , তার সাথে জড়িয়ে আসার সময়ে ও বুঝেছে হিল পরে থাকলে ও মেয়েটা বেশ লম্বা। টিকালো নাক, উঁচু গ্রীবা আর অবিন্যস্ত লাল আর সোনালী চুলে ওকে অনেকটা অপ্সরার মতো লাগছে। দীপ্ত খাবার আর দুধ এনে মেয়েটার দিকে এগিয়ে দিলো। মেয়েটা এবার ইষৎ হেসে ওদের দিকে হাত বাড়িয়ে বললো_ হাই! আমি আদৃতা। দীপ্ত আর শাক্য নিজের পরিচয় দিয়ে ওকে খেতে অনুরোধ করলো। আদৃতা পিৎজায় এককামড় দিয়ে দুধটুকু এক নিঃশ্বাসে খেয়ে ওষুধের জন্য হাত বাড়ালো। দীপ্ত ওকে পেইনকিলার দিয়ে রেষ্ট নিতে বলে ঘরের লাইট নিভিয়ে বেডল্যম্প জ্বেলে অন্য ঘরে চলে গেলো। বেড রুমে এসেই শাক্যকে বেদম ঝাড়। কি রে তুই কি দিনে দিন কচি খোকা হচ্ছিস? এই সব উটকো বিপদকে ঘাড়ে নিয়ে আমরা পুলিশের চক্করে ও পড়তে পারি।
শাক্য ওকে সামলাতে বলে ফেলল দেখ এখান থেকে নতুন কোন খবরের সোর্স পাবো নাতো? সোর্স পেতে গিয়ে ছবি না হয়ে যাস! চললো কিছুক্ষন কথার চাপানউতোর। আধঘন্টা পরে ওরা যখন বাইরের ঘরে এসে দাঁড়ালো, তখন ঘড়িতে রাত দেড়টা বাজছে। ওরা ওখানে আসতেই হাঁক এলো ভেতরে আসতে পারেন। আমি ঠিক আছি। আলো জ্বালাবেন না, এই আলোতেই আমি কর্মফাটেবল ফিল করছি। অগত্যা দুজনে ওর মুখোমুখি চেয়ারে বসলো। হলুদ আলোয় আদৃতাকে কেমন যেন রহস্যময়ী লাগছে। আমার ড্যাড কুনাল রায়চৌধুরী বড় ইন্ডাস্ট্রিয়ালিস্ট। ব্যাবসা সূত্রে আমাদের দিল্লি মুম্বাই ও ব্যাঙ্গালোরে ও বাড়ি আছে। কিন্তু আমরা এখানেই বাস করি। আমার দিদি আহেলী আমার থেকে পাঁচ বছরের বড়। আমি হবার পর ও বোনের এক অদ্ভুত সাইকোলজিক্যাল প্রবলেম শুরু হয়ে গিয়েছিল। সুযোগ পেলেই আমায় মারতো, বিছানা থেকে ঠেলে ফেলে দিতো। ডাক্তারের পরামর্শ মতো ড্যাড আর মম দুজনকেই সমান সময় দেওয়ার চেষ্টা করতো, কিন্তু ও সাময়িক ঠিক হলে ও আমার প্রতি মনে মনে রাগ গেলো না। আমার পনেরো বছর বয়সে খেলতে খেলতে দিদি আমায় দোতলার সিড়ি থেকে ঠেলে দেয়। আমি রেলিং ধরার চেষ্টা করে পারি নি। ওই অ্যক্সিডেন্টে আমার বাঁ পাটা অপারেশন করে স্টীলের পাত বসানো হয়। অতবড়ো ঘটনা ঘটার পর মম মনে মনে ভেঙে পড়েছিলো। দুজনকেই একই গর্ভে ধরেছে।অথচ এই প্রতিহিংসা দেখে মমের বুক কাঁপতো। ভেবে ভেবে মমের শারীরিক অবস্থা ক্রমশ খারাপ হয়ে গেল, একদিন হার্ট ফেল করে মারা গেল। ড্যাড তখন আমায় বিদেশে পড়তে পাঠিয়ে দিলো। আমার কলেজ লাইফ আমেরিকায় কেটেছে। ছমাস হলো আমি এখানে ফিরেছি। দীর্ঘদিন বোনের সাথে দেখা নেই, ফোনে কথা হতো টুকটাক। বাবা আগের ঘটনা নিয়ে ভয়ে থাকতো তাই আমায় পাঠিয়ে দেওয়া। আমি ছমাস হলো দেশে ফিরেছি। দিদি আমায় খুব আন্তরিকতার সাথে আপন করে নিলো। আমি ও ভুলে গেলাম পুরোনো ঘটনা। একটানা কথাগুলো বলে আদৃতা একটু থামলো। ওর মুখটা যেন কোন কথা মনে পড়ে যাওয়ায় ভয়ে শুকিয়ে গেল। আমার দিদি ড্যাডের কলকাতার লেদার বিজনেসের একাউন্টস দেখে। আমি ওখানে আর্ট নিয়ে পড়াশোনা করেছি। এখানে বছরের মাঝে আসার জন্য কোন ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হতে পারলাম না। ইচ্ছে ও ছিল না। একটু ঘুরবো বেড়াবো তারপর না হয়। দিদির সাথে দিব্যি ফ্যাকট্রি যেতাম, মল ঘুরতাম, মুভি দেখতাম। হঠাৎ আজ দিদি বাড়িতেই ক্যান্ডাল লাইট ডিনারের প্ল্যান করলো। ড্যাড দুদিন হলো বিজনেসের কাজে বাইরে গেছে। আমরা দুই বোন সেজেগুজে টেবিলের একপাশে বসে ক্যান্ডেল লাইট ডিনার করছি। মিউজিক বাজছে ধীরে। দিদি আমার খুব কাছে এসে আদর করতে লাগলো। আমার একটু অস্বস্থি হচ্ছিল যে, তা নয়! হঠাৎ দিদি খিলখিল করে হেসে উঠলো, দিদির মুখটা পাল্টে যেতে লাগলো। উফ্ কি ভয়ানক। দিদি রাগে আমার মুখটা ধরে বললো আবার এসেছিস, আমাদের সংসারে আগুন ধরাতে। এই রাজ্যের আমি একমাত্র রাজকন্যা। তুই তুই কেও নোস! তোকে তো মরতে হবে। অনেক দিন আগেই চেষ্টা করেছিলাম, পারি নি। আজ তোকে শেষ করে দেবো বলেই টেবিলের ওপরে রাখা ছুরি দিয়ে আবার হাতে আঘাত করলো । আমি তখন ভয়ে ওকে ঠেলে ফেলে মাঝের দরজাটার ল্যাচ লাগিয়ে দৌড়তে দৌড়তে নীচে নেমে গাড়ি নিয়ে পালিয়েছি। কোথায় যাবো, কি করবো বুঝতে পারছিলাম না। ড্যাডকে ফোনে পেলাম না। তাড়াহুড়োয় পার্স নিয়ে বেরোয় নি, শুধু জ্যাকেটের পকেটে মোবাইলটা ছিল বলে।
এই সময় আমার বন্ধুর সাথে আপনার দেখা তাই তো! দেখুন মিস আদৃতা আপনি আজ রাতটা এই সোফাতেই একটু কষ্ট করে কাটিয়ে দিন। এটা আপনাদের পারিবারিক ব্যাপার। আপনার দিদিকে একজন ভালো ডাক্তার দেখানো উচিত। বাবার সাথে কথা বলবেন, হয়তো আপনায় দেখে এতদিনের চাপা রাগ আবার চাগাড় দিচ্ছে। এনি ওয়ে টেক রেষ্ট। গুডনাইট বলে দীপ্ত শাক্যকে নিয়ে ঘর থেকে বিদায় নিলো। বিছানায় শুয়ে শাক্য বলল আদৃতা বাড়ি ঢুকবে কি করে? ওকে যদি আবার এট্যাক করে।
এই ধরনের মানসিক রোগীরা বিশেষ মুহূর্তে ক্ষেপে উঠে। আবার যতদূর জানা আছে আদৃতা কে দেখে আহেলি কোন বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখাবে না। সম্ভবত ওর মনে ও থাকবে না। যাক গে যাক! ওরা অনেক বড়লোক, ওর বাবা আছেন উনি নিশ্চয়ই কোন স্টেপ নেবেন। তুই এবার চোখ দুটো বন্ধ কর। কাল অফিস আছে। সকালে ব্রেকফাস্ট খেয়ে আদৃতা বিদায় নিতে চাইলে শাক্য ওর সাথে গাড়ি করে গেল, মেডিক্যাল স্টোরে ইন্জেকশন নেওয়াতে। দীপ্ত কিন্তু কিন্তু করে অফিস চলে গেল। শাক্য জানালো আদৃতা কে ড্রপ করে সে অফিস যাবে। টিটেনাস দেওয়ানোর পর শাক্য আদৃতা কে ড্রাইভ করে ও বাড়িতে পৌঁছতে গেলো। আদৃতা অবশ্য আপত্তি করছিলো, কিন্তু শাক্য শোনে নি। থিয়েটার রোডের মুখে এসে আদৃতা জানালো এই মোড় দিয়ে গেলে কয়েকটা বাড়ির পর ওর বাড়ি। আদৃতা ওর ঘন ভুরু তুলে ওর দিকে তাকিয়ে বললো আপনি গেলে অসুবিধা আছে। আমি গিয়ে পরিস্থিতি বুঝে মেসেজ করে দিচ্ছি। ততক্ষন না হয় এই গলির মুখে দাঁড়ান। অগত্যা শাক্য নেমে অপেক্ষা করতে লাগলো। কিছুক্ষন পরে মেসেজ এলো এভরিথিং ইস্ ফাইন।
এরপর আদৃতার সাথে অনেকবার ক্যাফেতে, মলে, শাক্যর বাড়িতে দেখা হয়েছে। সম্বোধন আপনি থেকে তুমিতে চলে এসেছে। আদৃতা ভীষন কথা বলতে ভালোবাসে। আবার কখনো কখনো উদাস হয়ে যেন কোন অতলে ডুব দেয়। শাক্যর তখন ইচ্ছে করে ওর গভীর চোখের তারায় হারিয়ে যেতে। মেয়েটা বড্ড ভালোবাসার কাঙাল। ছোটবেলায় মায়ের মৃত্যু তারপর পরিবার ছেড়ে দীর্ঘ প্রবাসে থাকা। ফিরে এসে নিজের আপন দিদির প্রতিহিংসার রূপ ওকে বিধ্বস্ত করে তুলেছিলো। কিন্তু শাক্যকে কে পেয়ে যেনো ও প্রাণ ফিরে পেয়েছে। আদৃতা বলেছে আহেলী আর ওর সাথে কোন খারাপ ব্যবহার করে নি। এমনকি সেদিনের ঘটনা ও যেন ভুলে গেছে।উল্টেই ওকে বকবকি করেছে রাতে ওকে দরজা লাগিয়ে একা একা রাতে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে যাবার জন্য। আদৃতা একটু খুড়িয়ে হাঁটে। শাক্য বুঝতে পারে দিদির ঠেলে দেওয়ার ফল।
_ তুমি তোমার ড্যাডকে তো বলতে পারো , সেইদিনের ঘটনাটা। ওই ঘটনা আবার যে কোন সময়ে ঘটতে পারে। ইমিডিয়েট আহেলীদির কাউন্সেলিং দরকার। ওকে যে ডাক্তার আগে দেখতো তার সাথে যোগাযোগ করো। না হলে আমার চেনা অনেক ভালো ভালো সাইকোলজিষ্ট আছে। আদৃতা মুখে মূহুর্তের মধ্যে যেনো বিষাদের ছায়া নেমে এলো। শাক্য তাড়াতাড়ি ওকে কাছে টেনে এনে বলল তুমি এত আপসেট হচ্ছো কেন? আবার যদি এক ঘটনা ঘটে তখন? আদৃতার মায়াবী সরল চোখ দুটোতে তখন জল টসটস করছে। _ আমার এই জীবন আর ভালো লাগে না। ড্যাড এত ব্যস্ত থাকে, তার ওপরে হাই সুগার প্রেশার। কি যে করি? বললে যদি টেনশনে মায়ের মতো কিছু হয়ে যায়। তুমি একদিন কায়দা করে আহেলীদির সাথে আমার পরিচয় করিয়ে দাও। ব্যাস! আমার ওপরে সব ছেড়ে দাও।
_ না, না ও তোমাকে আমার কাছ থেকে কেড়ে নেবে। তুমি ওকে চেনো না। ও আমায় সহ্য করতে পারে না। আমার ভালোবাসার মানুষকে ও শেষ করে দেবে। বলতে বলতে শাক্যকে জড়িয়ে ধরে। ঠিক আছে। আহেলীদির ডাক্তারের ফোন নাম্বারটা আমায় দিও। আমি দেখছি কি করা যায়।
আদৃতা কোনদিন শাক্যকে নিজের বাড়ির সামনে আনতো না।মোড়ের মাথায় শাক্যর বাইক থেকে নেমে যেতো।
এক রবিবার অঝোরে বৃষ্টি নেমেছে। শাক্যর ঈচ্ছে করছে না কিছুতেই বিছানা থেকে নামতে। খাটে শুয়ে শুয়ে হেডফোনে গান শুনছিলো আর মনে মনে আদৃতাকে চাইছিলো। জোরে ডোরবেলের আওয়াজ শুনে শাক্য দরজা খুলে দেখলো আদৃতা কাকভেজা হয়ে দাঁড়িয়ে। শাক্যর বাড়ি বড় রাস্তা থেকে গলির মধ্যে ঢুকতে হয়, তাই আদৃতা এখানে এলে ক্যাবে আসে। গাড়ি থেকে নেমে বাড়ি আসতে আসতেই ভিজে একাকার।
এখানে দাঁড়িয়ে থাকলে তো ঘরটা পুরো নদী হয়ে যাবে। বাথরুমে যাও। গীজার চালিয়ে দিচ্ছি। আদৃতা মোবাইল আর ব্যাগ টেবিলের ওপর রেখে বাথরুমে ঢুকলো। শাক্য তাড়াতাড়ি মোবাইল থেকে জল মুছতে লাগলো, ভাগ্যিস ব্যাগটার মধ্যে ছিলো, না হলে এত দামী মোবাইল পুরো শেষ হয়ে যেতো। ব্যাগেটা পুরো ভিজে জবজবে হয়ে গেছে। শাক্য ব্যাগ থেকে সব জিনিস বার করে টেবিলের ওপর শুকোতে দিলো। পার্সটা কিন্তু কিন্তু করে খুলে কতগুলো ডেবিট ক্রেডিট কার্ড আর কিছু পয়সা পেলো যেগুলো শুকোতে গিয়ে দেখলো, একটা ভিজে ন্যাতা হয়ে যাওয়া ভিজিটিং কার্ড আর একটা সাদা কাগজ। ভিজিটিং কার্ডটা হাতে নিয়ে শাক্য চমকে উঠলো। নিজের মোবাইল থেকে দুটো জিনিস খুব কাছ থেকে ছবি তুললো।যদি ও ভিজে সব অস্পষ্ট তবু এখন তো শুকনোর কোন উপায় নেই। একটা রঙিন ভাঁজ হয়ে যাওয়া ছবি রয়েছে যাতে একটা মিষ্টি বাচ্চা মেয়ের দুপাশে একজন ভদ্রলোক আর ভদ্রমহিলা দাঁড়িয়ে আছে। মাঝের মেয়েটা যে আদৃতা সেটা বুঝতে অসুবিধা হলো না, ওর গালের টোল দেখে। মোবাইল চেক করে দেখলো পাস ওয়ার্ড দেওয়া।দরজায় খুট করে আওয়াজ হলো। শাক্যর চোখ চুম্বকের মতো আটকে আছে আদৃতার শরীরের ওপর। সারা চুল বেয়ে জল ফোঁটা ফোঁটা চুইয়ে পড়ছে। নীল তোয়ালতে মোড়া ওর দেহের দিকে বেশিক্ষণ শাক্য তাকাতে পারছিলো না। চোখ চলে যাচ্ছিল ধবধবে ফর্সা বক্ষ বিভাজিকার মাঝে “এ” লেখা লকেটটার দিকে। কি হলো আমায় হাঁ করে দেখবে না,কোনো শুকনো জামা দেবে পড়তে। শাক্য লজ্জিত হয়ে ঘরের কার্বাড থেকে একটা গেঞ্জি আর বারমুডা নিয়ে দিল।
_
এই গুলো কোথায় মেলবো? হাতের ভিজে পোষাক দুটো দেখিয়ে আদৃতা বলল।
_ একমিনিট ! দাঁড়া ও ওটা বারান্দায় মেলে দিই। জল ঝরে গেলে, ঘরের মধ্যে মেলে দেবো। ফ্যানের হাওয়ায় শুকিয়ে যাবে।
_ আমি মেলে দিচ্ছি, দেখিয়ে দাও। কি মুস্কিল। এই পোষাকে তুমি বারান্দায় যাবে। রাস্তা দিয়ে লোক যাতায়াত করছে।
না, আমি মেলবো, এখানে আমার আন্ডার গার্মেন্টস আছে। আদৃতা বাথরুমে পোষাক পাল্টিয়ে জামাকাপড় মেলে দিলো। আদৃতার না বলাটা একটু যেন বেশি জোরে হয়ে গিয়েছিল শাক্যর একটু খারাপ লাগলেও কিচেনে চা বসাতে গেলো। মনে মনে ভাবলো চালে ডালে খিচুড়ি বসিয়ে দিলে কেমন হয়, তার সাথে ডিম ভাজা। ঘরে এসে দেখে আদৃতা খাটে শুয়ে আছে। খিচুড়ির কথা শুনেই ছেলেমানুষের মতো লাফিয়ে উঠলো। শাক্যকে কাছে টেনে বলল_ আমি একদিন তোমাকে নিজের হাতে রান্না করে খাওয়াবো। খেতে পারবো তো? বলতেই দুমদাম করে কিল পড়লো ওর পিঠে। শাক্য আদৃতাকে একটু বেশি কাছে টেনে নিলো। বাইরে আরো জোরে বৃষ্টি নামলো।
_
এনি ওয়ে আহেলীদির কোন ছবি তোমার কাছে নেই।
_ প্লীজ এই রোমান্টিক ওয়েদারে ওর কথা বলে আমার মুড খিঁচড়ে দিও না। তুমি নিজেই বুঝতে পারছো না। তুমি আগুন নিয়ে খেলছো, তোমার ড্যাডকে সেইদিনের কথা বলো নি। দিদির ডাক্তারের সাথে কোন কথা বললে না। আমার তো তোমাকে নিয়ে চিন্তা হয় ।
দিদির ডাক্তারের কোন ফোন নাম্বার নেই। ড্যাড ফিরলে তোমায় দিয়ে দেবো। তুমি এবার যা করার করো। এখন দিদি পুরো নর্মাল। বলতে বলতে মোবাইল স্ক্রোল করতে করতে একটা ছবি শাক্যর দিকে এগিয়ে দিলো। ছবিটা কোন ফটো থেকে নেওয়া। বেশ সুন্দরী, আদৃতার দিদি বোঝা যাচ্ছে। কিন্তু ফটো থেকে নেওয়া কেনো? ছবিটা ও বেশ পুরনো মনে হচ্ছে। হিসাব করলে এখন তাহলে মহিলার বয়স বেশ হয়েছে। আমতা আমতা করে শাক্য বললো মানে, রিসেন্ট কোন ছবি নেই। মোবাইলে তোলা । তোমার সাথে ও কোন ছবি নেই?
দিদি ছবি তুলতে ভালোবাসে না। ক্যান্ডেল লাইট ডিনারের দিন দুজনে অনেক ছবি তুলেছিলাম কিন্তু আমি সব ডিলিট করে দিয়েছি। এটা কখন থেকে গেছে আমি নিজেই জানতাম না। তোমার বাবার কোন! কথা শেষ করার আগেই বিকট শব্দে বিদুৎ চমকে উঠলো। শাক্যকে আদৃতা জড়িয়ে ধরলো। মুখের কাছে আঙ্গুল এনে চুপ করিয়ে দিলো। আদৃতার গরম নিঃশ্বাস শাক্যকে সম্মোহিত করছিলো। বাইরের বৃষ্টির সাথে সাথে ঘরে দুটো শরীর বিছানায় গলতে শুরু করলো। কতক্ষন খেয়াল নেই। শাক্য নিজের টিশার্টটা গলিয়ে খাট থেকে আস্তে আস্তে নেমে বারান্দায় আদৃতার জামাগুলো ঘরে আনতে গেলো। জিন্সটা যা ভিজে গেছে তাতে আজ শুকনো হওয়ার কোন চান্স নেই। জিন্সটা হাতে নিতেই পকেটে একটা শক্ত মতো ধাতব কোন জিনিস ওর হাতে ঠেকলো। মোবাইল তো ওর কাছে আছে তাহলে? পকেট হাতড়াতে যাবে এমন সময় পেছন থেকে আদৃতার ডাক তুমি আবার আমার জামায় হাত দিয়েছো। আদৃতা শুধু গেন্জি পরেই চলে এসেছে এবং শাক্যর হাত থেকে জামাগুলো নিয়ে ঘরে চলে গেলো। শাক্য ওর চোখে স্পষ্ট বিরক্তি দেখতে পেলো। এত ঘটনার পর এই সামান্য জিনিসেই কি এমন মহাভারত হয়ে যাবে শাক্য বুঝতে পারলো না। কিচেনে গিয়ে খিচুড়ি চাপালো। জোর সে খিদে পেয়েছে। বেলা কত হয়েছে ক্ষিদের আর দোষ কিআমি এখন আসছি। বৃষ্টি থেমে গেছে।
শাক্য দেখলো ওর গেঞ্জি আর নিজের ভিজে জিন্সটা পরে আদৃতা দাঁড়িয়ে আছে।
যাবে মানে? তুমি বললে বলে খিচুড়ি চাপালাম। আশ্চর্য। আমি তোমায় ছেড়ে দিয়ে আসবো। দরকার হবে না। ক্যাব বুক করে দিয়েছি।
আদৃতার হঠাৎ পরিবর্তনে শাক্য অবাক হলেন ও কিছু বললো না। শুধু বললো_ ভিজে জিন্সটা রেখে গেলে পারতে, শরীর খারাপ হয়ে যাবে। আদৃতা উত্তর না দিয়ে ব্যাগ মোবাইল নিয়ে বাই করে দিলো। আদৃতা অনেকক্ষণ চলে গেছে, খেয়েদেয়ে শাক্য সিগারেটে সুখটান দিচ্ছে। সারা বিছানায় আদৃতার দামী পারফিউমের গন্ধে মৌ মৌ করছে। শাক্যর জীবনে আদৃতাই প্রথম মেয়ে যাকে আজ ও এইভাবে পেলো। কিন্তু কোথায় যেন হঠাৎ ছন্দ কেটে গেলো। আদৃতা আর ওর মিলনসুখের মূহুর্তটাটে উপভোগ করার চেষ্টা করলেই মাথায় জিন্সের পকেটে শক্ত জিনিসটার কথা মনে পড়ছে। মনে পড়ছে আচমকা আদৃতার না খেয়ে বাড়ি চলে যাওয়া। শাক্যর কি একটা মনে পড়তেই মোবাইলটা খুলে ওর ভিজে কাগজগুলোর ছবি জুম করে দেখতে লাগলো। পরে আদৃতার সাথে দেখা হওয়াতে সেইদিন ওইভাবে চলে আসার প্রসঙ্গ ও কিছু তোলে নি। জেনো কিছুই হয় নি এমন ভাবে আদৃতা শাক্যকে বলেছে এবারে ড্যাড এলে ও শাক্যর কথা, দিদির কথা সব বলবে। শাক্যকে বিয়ে করে এবার থেকে ওর সাথেই থাকবে। শাক্য ওর সরল চোখের দিকে তাকিয়ে বলতে পারে নি যে সব কিছু অতো সহজ নয়। সে ও একটা পরিবারের ছেলে। এইভাবে হুট করে কিছু হয় না। কিন্তু আদৃতার আকুলতা ওকে বিবশ করে তুলতো। একদিন শাক্য আদৃতা কে বাইকে করে ওর বাড়ির মোড়ের কাছে নামিয়ে ফিরছে হঠাৎ ক্রসিং দীপ্তর সাথে দেখা। দীপ্ত ওখানে কি একটা কাজে এসেছিলো। হইহই করে শাক্যকে টেনে কাছের একটা ক্যাফে ঢুকলো। আশীক হো তো এ্যসা ! আমাদের খবরের হেডলাইন হয়ে যাবে। তুই তো বেটা ছুপা রুস্তম রে! অফিসের অনেকের কাছেই শুনি আদৃতা ছুটির সময় অফিসের সামনে দাঁড়িয়ে থাকে। দুজনে একসাথে ডেট করছিস, আর শুরুয়াতে যে ছিল তাকেই ভুলে গেলি। হাসতে হাসতে দীপ্ত বললো। খাবারের অর্ডার দিয়ে দীপ্ত একটু ওয়াশরুমে গেলো। সেই সুযোগে শাক্য ফোন লাগালো।
হ্যালো। কি করছো। একটু আসতে পারবে গো। দীপ্তর হাতে আজ ক্যাচ কট কট । খুব রাগ করছে জানো তো। এই তো কাছেই। চট করে চলে এসো। না গো, আমি এক্ষুনি চেন্জ করে নিলাম। তাছাড়া দিদি কতগুলো ফাইল দিয়েছে ওগুলো ল্যাপটপে সেফ করতে হবে। আজ হবে না সুইট হার্ট। পরে একদিন তোমার দীপ্তর সাথে দেখা করবো।
তোমরা কতক্ষন আছো?
তোমার সাথে মিট করবো বলেই বসলাম, এক্ষুনি কাটবো, আচ্ছা রাখি। দীপ্তকে শাক্য আদৃতাকে ফোন করার ব্যাপারে কিছু বললো না। অনেকক্ষণ আড্ডা দেওয়ার পর দীপ্ত শাক্যর বাইকে ওকে ছেড়ে দিতে বললো। মোড়ের মাথায় সিগন্যালের কাছে হঠাৎ দীপ্ত বলে উঠলো_ আরে আদৃতা না?
শাক্য ও হেলমেটের ফাঁক দিয়ে দেখলো যে ড্রেস পরে আদৃতাকে ছেড়েছিলো সেই ড্রেস পরেই ও একটা সল্টলেকগামী বাসে উঠলো। সিগন্যাল হতেই বাস আর বাইক দুটোই ছাড়লো।

আজ আদৃতার জন্মদিন। ওরা সারাদিন গঙ্গার ধারে ঘুরে একটা বড় রেস্টোরেন্টে খেয়ে লং ড্রাইভে বেরিয়েছে। আদৃতার গাড়ি শাক্য ড্রাইভ করছে।
শাক্য বলেছে আদৃতা কে সারপ্রাইজ গিফট গাড়িতে যেতে যেতে দেবে। গাড়ি চলছে মহানগরীর মায়াবী আলো মেখে। বাইরে ঝিরিঝিরি করে বৃষ্টি পড়ছে।হঠাৎ শাক্য এফ. এমটা চালু করে দিলো। চ্যানেল সার্ফ করতে করতে ঘোষিকার কন্ঠস্বর _ আপনারা শুনছে ” গোপন ও কথাটি রবে না গোপনে” সঙ্গে থাকছি আমি সাক্ষী। চটপট করে নিজেদের প্রিয় মানুষের গোপন কথাটা যা আপনি জেনে গেছেন অথবা জানতে গিয়ে খুব মজার এক্সিপিরিয়েন্স হয়েছে। আমাদের সাথে শেয়ার করুন এই নাম্বারে।অবশ্যই গৃহযুদ্ধ এড়িয়ে না হলে আমাদের পুলিশ ফোর্সের সাহায্য নিতে হবে। জোক এপাটস। তাহলে সঙ্গে থাকুন শুনতে থাকুন নাইটি থ্রি পয়েন্ট এইট রেড এফ. এম। সাথে সাথে শুরু হয়ে গেল শাওন বরষে তরসে দিল, কিউনা নিকলে ঘর সে দিল।
শাক্য আদৃতার দিকে তাকালো, আজ ও ডেনিম ব্লু জিন্সের ওপর ব্ল্যাক টপ পড়েছে, চুলটা উঁচু করে বাঁধা। ড্রেসটা শাক্য দিয়েছে। ওকে আজ কোন প্রসাধন ছাড়াই ভীষন সুন্দর লাগছে। একদম অন্যরকম। আদৃতা আজ আবদার করেছে শাক্যর সাথে রাতে থাকবে, তাই ঘরে ফেরার কোন তাড়া নেই। আদৃতা শাক্যর কাঁধে মাথা রেখে গান শুনছিলো। শাক্য ফোনে কাকে কল করছিলো। গান শেষ হওয়ার সাথে সাথেই ঘোষিকার কন্ঠস্বর ভেসে এলো_ হ্যালো, আমাদের সাথে কোন বন্ধু, তার প্রিয় বা প্রেয়সীর গোপন কথার ঝুড়ি নিয়ে আছেন।শুনতে পারছেন হ্যালো। হ্যালো আমি শাক্য রায় বলছি। আজ আমার উডবির জন্মদিন। তাকে একটা সারপ্রাইজ গিফট দিতে চাই। আদৃতা এবার অবাক চোখে শাক্যর দিকে তাকালো।
শাক্য যেন ভূত পাওয়ার মতো বলতে লাগলো এই রকম এক রাতে রাস্তায় আদৃতা রায়চৌধুরীর সাথে আলাপ। আলাপ থেকে প্রেম । আদৃতা তখন ও হাসিহাসি মুখে শাক্যর দিকে তাকিয়ে। আদৃতা বেচারি সবসময় ওর দিদি আহেলির ভয়ে কাঁটা হয়ে থাকে। ওর দিদির মেন্টাল
ডিজঅর্ডারে ভোগে, প্রবটা ওকে নিয়ে। ছোটবেলায় ওকে সিড়ি থেকে ফেলে দেয় এবং ওর মা মারা যায় এই আতঙ্কে এবং ওকে বিদেশে পাঠানো হয় । তাই না আদৃতা? আদৃতার মুখটা থেকে কে যেনো সব রক্ত শুষে নিয়েছে, ভীষন ফ্যাকাশে হয়ে গেছে।
একদিন আদৃতা বৃষ্টিতে ভিজে আমাদের বাড়ি আসে।ওর ভিজে যাওয়া জিনিস পত্র থেকে আমি একটা ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন, ভিজিটিং কার্ড আর একটা পুরনো ফটো পাই। আমি রিপোর্টার। কিছু কিছু জিনিসে সন্দেহ হওয়াতে হাতে আসা কাগজগুলোকে নিয়ে তদন্ত চালাই। আদৃতা ততক্ষণে চোখ বুজে ফেলেছে। এই কার্ড আর প্রেসক্রিপশনের সাহায্যে ডাক্তারের খোঁজ পাই। উনি স্বীকার করেছেন পেশেন্ট আদৃতা রায়চৌধুরী। কুনাল রায়চৌধুরীর একমাত্র মেয়ে, যিনি বহুদিন আগেই মারা গেছেন ফ্লাইট এক্সিডেন্টে। এনাফ ইজ এনাফ। শাক্য তুমি তোমার লিমিট ক্রস করছো। একটু বেশি ড্রিঙ্ক করে উল্টোপাল্টা বকছো। বলেই ফোনটা হাতে থেকে কাড়তে গেলো।
শাক্য শক্ত হাতে ওকে সরিয়ে বলতে শুরু করলো আদৃতা ছোটবেলায় পড়ে গিয়ে একটা আঘাত পায়, যাতে পায়ে স্টীলের পাত বসে।বাবা মারা যাওয়ার পর ওর বাবার এক ক্লোজড ফ্রেন্ডের সাহায্যে নিয়ে মা ব্যাবসা দেখতে থাকে। পনেরো বছর বয়সে মায়ের সাথে ওই ভদ্রলোকের মেলামেশা পছন্দ করতে পারে না। মাকে অকারণ সন্দেহ, অযথা চিৎকার চেঁচামেচি করতে থাকে। একদিন কথাকাটাকাটি হতে হতে টেবিলে রাখা ফলের ছুরি মায়ের বুকে বসিয়ে দেয়। কিন্তু মিসেস রায়চৌধুরী ছুরির আঘাতে নয়, মেয়ের ওই খুনী রূপ দেখে হার্ট ফেল করে মারা যান। স্বামীর মৃত্যু, মেয়ের এই মানসিক বিকারের স্ট্রেস নিতে পারছিলেন না। কোর্টে কেস উঠলে ও মৃত্যু ছুরির আঘাতে নয় এবং আদৃতা নাবালিকা বলে ছাড়া পায়। আদৃতার সেই কাকু তখন তাকে বিদেশে পাঠানোর ব্যাবস্থা করেন। উনি নিজে একজন সফল ব্যবসায়ী ছিলেন। আদৃতার এক মামা ছাড়া দুইপক্ষেই কে ও ছিলো না। তাই আদৃতা সত্যি বিদেশে পড়াশোনা করতে যায়। কিন্তু মাঝে টাকা পাঠানো বন্ধ হয়ে যাওয়ায় কাকু ফোন করে বলে কোম্পানীর অনেক লোকসান হয়ে গেছে। বিদেশের এত টাকা তিনি বহন করতে পারবেন না। দেশ থেকে ওর মামা জানায় সত্যি কোম্পানি লসে রান করছে। ওকে দেশে আসতে বলে। কিন্তু আদৃতা স্কলারশিপ জোগাড় করে পড়াশোনা চালাতে চালাতে সেখানে ওর রুমমেটের সাথে ঝামেলায় জড়িয়ে পড়ে, ওখানের পুলিশের নির্দেশে ওকে দেশে ফেরত পাঠানো হয়। শাক্য মাঝরাস্তায় গাড়ি থামিয়ে ওর দিকে ঘুরে বললো আদৃতা কি হয়েছিল? মেয়েটাকে তুমি কেন ছুরি দিয়ে মারতে চেয়েছিলে।তারপর এখানে ফিরে এসে তুমি দেখো ব্যাবসা পুরো দেউলিয়া হয়ে গেছে। তখন থিয়েটার রোডের বাড়ি বিক্রি করে দীপ্তর বাড়ির কাছাকাছি ওই কাকুর দেওয়া ফ্ল্যাটে থাকতে। ওই কাকুর লেদারের বিজনেসের একাউন্টস তুমি দেখাশোনা করো। আহেলী বলে কে ও নেই তোমার পৃথিবীতে। তাই তুমি দিদির কোন ছবি দেখাতে পারো নি। যে ছবিটা দেখিয়েছিলে ওটা তোমার মায়ের। মা বাবার সাথে তোমার ফটোগ্রাফটা আমি দেখেছি। তাই তুমি মোড়ের মাথা থেকে আমায় বিদায় দিতে। কিছুক্ষন চেনা পাড়ায় ঘোরাঘুরি করে আবার কখনো বাসে বা কখনো কাকুর দেওয়া গাড়িতে ফিরতে। তুমি সেদিন নাটক করেছিলে, নিজে নিজেকে আঘাত দিয়ে আমার কাছে সিমপ্যাথি নিয়েছিলে। ছোটবেলা থেকে আদরে মানুষ তুমি এই অবস্থাটা মেনে নিতে পারছিলে না তাই কাকুকে ব্যবহার করছিলে এই সব শৌখিনতা তোমার চিকিৎসার খরচ জোগানোর জন্য। তুমি কেন আমায় সব খুলে বলো নি? ঠিকমতো ওষুধ খেতে না চেকআপে যেতে না। কেন?? আমার কাকু নয়। আই হেট দ্যাট ম্যান। ও ইচ্ছে করে আমাদের ব্যাবসার টাকা পয়সা নয়ছয় করে ব্যাবসা কে দেউলিয়া করে। আমাদের বিজনেস ডুবে গেলে ও কিছু বড় এমাউন্টের টাকা আমার নামে ফিক্সট আছে। নমিনি কাকু। বিশ্বাস করো সেদিন কাকু ডিনারের সময় কাছে আসতে চাইলে আমি ওর বদলে ভয় দেখিয়ে নিজেকেই ছুরি দিয়ে মেরে পালাই। আমি তোমায় ভালোবাসি বলতে বলতে আদৃতা মাথাটা গাড়ির গায়ে এলিয়ে দিলো।
ডুকরে কেঁদে আদৃতা বলল _ তুমি এই কথাগুলো সবার সামনে বলতে পারলে। যারা এই প্রোগ্রাম শুনছে সবাই ! আদৃতা চোখ খোলো! আমি লাইনে এসেই ফোন ডিসকানেকট করে দিয়েছিলাম। তুমি আমার কথা শুনতে শুনতে ঘোরে ছিলে তাই খেয়াল করো নি।
যে সম্পর্ক মিথ্যা দিয়ে শুরু তাকে বাঁচিয়ে রাখা যায় না। ধরা গলায় কথাটা বলেই শাক্য গাড়ি চালাতে লাগলো।
আমার শরীর কেমন করছে, জোরে গাড়ি চালাও। আমায় বাড়ি নিয়ে চলো। শাক্য চিন্তিত মুখে ফাঁকা রাস্তায় গাড়ির স্পিড বাড়িয়ে দিলো। আমি তোমার আহেলীদি, যার খোঁজে তুমি গোয়েন্দাগিরি করেছিলে। আদৃতার চোখমুখ কেমন পাল্টে গেছে, মুখে নিষ্ঠুর হাসি নিয়ে কেটে কেটে বললো ভালোবাসার সময়ে আমি আদৃতা আর খুন করার সময় আহেলী। কেমন? প্যান্টের পকেট থেকে যে জিনিসটা বার করলো সেটা অন্ধকারে ঝলসে উঠলো। _ না , আহ্! আদৃতা_ আ_ আ_আ সবুজ পর্দায় ঘেরা একটা কেবিনে, ন্যাড়া মাথা একটা তরুনী সাদা দেওয়ালের দিকে তাকিয়ে। হঠাৎ দরজায় ছায়ামূর্তি। পায়ে পায়ে ডক্টর মুখার্জি এসে মাথার কাছে দাঁড়ালো। বাইরে দুজন ছেলে এটেনডেন্স, কারন এই ধরনের রোগীরা হঠাৎ ফেরোসাস হয়ে যায়। তরুনী শুকনো মুখে বললো শাক্য এলে আমায় ছেড়ে দেবেন তো?
মিসেস মুখার্জী কি করে বলেন যে সেই রাতে আচমকা আদৃতার ছুরির আক্রমনে শাক্যর গাড়ি গতি হারিয়ে রাস্তার পাশের লোহার রেলিং ধাক্কা খায়। স্পট ডেথ। আদৃতা গুরুতর জখম হয়ে বহুদিন হসপিটালে ভর্তি ছিলো।
মাথায় অনেকগুলো স্টিচ করতে হয়েছিলো বলে কত সুন্দর চুল কেটে ফেলা হয়েছে। হাতে ও একটা অপারেশন হয়েছে। আদৃতা স্কিজোৎফেনিয়া রোগের শিকার। এই রোগে ডিলিউশনে মানুষ নিজেকে কখনো খারাপ কখনো ভালো ভাবে। নিজের তৈরি করা জগতে থাকতে ভালোবাসে, তার জন্য সে মাঝে মাঝে খুন পর্যন্ত করতে পিছপা হয় না।
মিসেস মুখার্জী আদৃতার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন
এই তো বাইরে বৃষ্টি পড়ছে। বৃষ্টি থামলেই শাক্য গাড়ি করে তোমায় নিয়ে যাবে। এখন লক্ষ্মী মেয়ের মতো ইন্জেকশনটা নিয়ে ঘুমিয়ে পড়ো।
রাত অনেক হয়েছে। ডাক্তার মুখার্জী অনেকক্ষণ চলে গেছেন । আদৃতা ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে অপেক্ষা করছে বৃষ্টি থামার।
( সমাপ্ত)
© মিতার কলমে অগ্নি

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here